কলকাতা: কলকাতায় একাধিক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে জটিল সমস্যা হল ডেঙ্গি। ডেঙ্গি (Dengue) সংক্রমনের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। দিনে দিনে এর প্রকোপ এতটাই বাড়ছে যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে রীতিমত কালঘাম ছুটছে পুরসভার। তাই এবার বর্ষার আগেই শহরে ডেঙ্গি প্রকোপ এড়াতে আগাম সতর্কতা কলকাতা পুরসভার (KMC On Dengue)। এই রোগ প্রতিরোধে এক বছরের নকশা তৈরি করেছে কলকাতা কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ। নকশায় ৬৮টি ওয়ার্ডকে বিপজ্জনক চিহ্নিত করেছে কলকাতা পুরসভা। গত বছর এই ৬৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টির বেশি ওয়ার্ডে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা বেশ বেশি ছিল।
চলতি মাসের শুরুতে নবান্নে মুখ্যসচিবের পৌরহিত্যে একটি বৈঠক হয়। সেখানে শহরের পরিচ্ছন্নতা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, দুই ভাগে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সর্বস্তরের আধিকারিকদের। প্রতিটি পুরসভা, পঞ্চায়েত এলাকা ধরে ধরে পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনগুলিকে।
প্রসঙ্গত, প্রতিবছর বর্ষার জমা জলেই ডেঙ্গি মশার প্রকোপ বাড়ে। এই জমা জলেই ডেঙ্গি রোগ সৃষ্টিকারী মশার লার্ভা জন্মায়। তাই ডেঙ্গি মহামারি রুখতে এবছর একেবারে কোমর বেঁধে ময়দানে নেমেছে কলকাতা পুরসভা।
কোন কোন ওয়ার্ড রয়েছে তালিকায়? (KMC On Dengue)
২, ৪, ১৪, ২৬, ৭, ৩১, ৩৩, ৩৬, ৪৮, ৫৫, ৫৭, ৫৯, ৬১, ৬২, ৬৫, ৬৯, ৭৭, ৭৯, ৮১, ৮২, ৮৫, ৮৬, ৮৮, ১০৩, ১০৫, ১১০, ১১২, ১১৫, ১১৭, ১১৮, ১২১, ১২২, ১২৪, ১২৬, ১২৭, ১২৯, ১৩১, ১৪৪- সব মিলিয়ে মোট ৬৮ টি ওয়ার্ডকে বিপদজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমনকি নবান্নের তরফে এই ৬৮ টি ওয়ার্ডকে বিশেষ নজর দেওয়ার ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে।
ডেঙ্গি প্রতিরোধের কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে! আশঙ্কা দানা বাঁধছে পুরসভার অন্দরেই-
যখন ডেঙ্গি প্রকোপ এড়াতে আগাম সতর্কতা নিয়ে ব্যস্ত কলকাতা পুরসভা (KMC) সেই সময়ই রাজ্যের এক অন্য চিত্র সামনে এল। ডেঙ্গি প্রতিরোধে নিযুক্ত কর্মীদের জন্য বরাদ্দ অর্থ রাজ্য সরকার গত পাঁচ মাস ধরে বন্ধ করে রাখায় বিপাকে পড়েছে হাওড়া পুরসভা। বেতন না পেয়ে চরম সঙ্কটে পড়েছেন প্রায় আড়াই হাজার কর্মী। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চলতি বছরে খুঁড়িয়ে চলছে মশাবাহিত এই রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচি। পুরকর্তাদের দাবি, কর্মীদের পাঁচ মাসের বকেয়া বেতনের মধ্যে পুরসভার কোষাগার থেকে দু’মাসের বেতন মেটানো সম্ভব হয়েছে। এখনও বাকি আছে তিন মাসের বেতন। সব মিলিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে বকেয়া রয়েছে পাঁচ মাসের টাকা। তার জন্য বার বার আবেদন করা হলেও বরফ গলেনি। সব মিলিয়ে ঘোরালো হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরো পরিস্থিতি। কর্মীদের বিক্ষোভের জেরে ডেঙ্গি প্রতিরোধের কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা দানা বাঁধছে পুরসভার অন্দরেই।
ডেঙ্গির নতুন উপসর্গ-
ডেঙ্গির (Dengue) নতুন উপসর্গের পোশাকি নাম মাল্টিসিস্টেম ইনফ্ল্য়ামেটরি সিনড্রোম। চিকিৎসকদের দাবি, অনেকে ডেঙ্গি আক্রান্ত হওয়ার পর ফুসফুসে প্রভাব পড়ছে, দেখা দিচ্ছে শ্বাসকষ্ট। শরীরে কমছে অক্সিজেনের মাত্রা, যার প্রভাব পড়ছে হৃদযন্ত্রে, কমছে রক্তচাপ, মস্তিষ্কে দেখা দিচ্ছে এনসেফেলাইটিসের উপসর্গ। এর সঙ্গেই দেখা যাচ্ছে তলপেটে ব্য়থা, বমি, ডায়েরিয়া, দুর্বলতা।
কোন কোন ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে?
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নীলাঞ্জন ঘোষ বলেছেন, ‘এখন জ্বর যেগুলি আসছে, আমাদের প্রথমে ডেঙ্গি আছে কিনা, দেখে নিতে হবে। সতর্কবার্তা এটাই, জ্বর হলে কিন্তু রক্ত পরীক্ষা করে অবশ্যই দেখতে হবে। ডেঙ্গি এবং ম্যালেরিয়াটা রুটিন পরীক্ষা অনুযায়ী করতে হবে।’
ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষের মন্তব্য-
এই প্রসঙ্গে ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ জানিয়েছেন, “ প্রতি বছর ভারতে ডেঙ্গির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২৪-এ ডেঙ্গি বেড়েছে গোটা বিশ্বে। চিন, অস্ট্রেলিয়া-সহ একাধিক দেশে ডেঙ্গির বাড়বাড়ন্ত দেখা গিয়েছে। তাই আমাদের রাজ্যে কলকাতার ১৪৪ টি ওয়ার্ডের মর্নিং ডাটা কালেক্টর আমরা প্রথম শুরু করেছি। আর সেখানেই দেখা যাচ্ছে ১৩৯২৬ জন আক্রান্ত হয়েছে। এবং তার আগের বছর প্রায় ৯০% ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়েছে। তাই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।” নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ডেঙ্গি মহামারি রুখতে গত বছর অগাস্টে বিধাননগর পুরসভার উদ্যোগে গাপ্পি মাছ ছাড়া হয়েছিল কেষ্টপুর খালে। পুরসভার এই উদ্যোগ সম্পর্কে কৃষ্ণা চক্রবর্তী জানিয়েছিলেন, স্বাস্থ্য কর্মীরা পুরসভার অন্তর্গত প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে খতিয়ে দেখেন, যে কোথাও কেউ জল জমিয়ে রেখেছেন কিনা। ফুলের টব থেকে শুরু করে কোনও পাত্র জল জমে আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হয়েছিল গতবার। পাশাপাশি মানুষকেও সচেতন করা হয় প্রতিবার। যাতে কেউ বাড়িতে জল জমিয়ে না রাখেন।
আরও পড়ুন: বাগনানে বেকারি কারখানায় অগ্নিকাণ্ড, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা
হ্যান্ড মাইকিং এর মাধ্যমে প্রচার অভিযান-
ইতিমধ্যেই কলকাতা পুরসভা (KMC) অপরিচ্ছন্নতার জন্য ৩৯ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে শনিবার ও বুধবার হ্যান্ড মাইকিং এর মাধ্যমে প্রচার অভিযান চালানো হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জুন মাসের মধ্যেই শহরের সমস্ত অপরিচ্ছন্ন এলাকা পরিষ্কার করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া যেসব বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে সেগুলি পরিষ্কার করতে ৪৫৫ আর ৪৫৬ ধারার অধীনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। পুলিশ সহায়তা করতে ব্যর্থ হলে, পুলিশ কমিশনার কে চিঠি দিয়ে সহযোগিতা চাওয়া হবে। ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত ৪৫ টি মামলা দায়ের হয়েছে যার মধ্যে ২০২৪ সালের তিনটি মামলা অন্তর্ভুক্ত। ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে গঠিত .১৪৪টি ভেক্টর কন্ট্রোল টিম আর ৩২ টি মোবাইল টিম নির্ধারিত এলাকা গুলিতে সজাগ দৃষ্টি রাখছে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সর্বোপরি কলকাতা পৌরসভা ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দিচ্ছে এবং একইসঙ্গে জনসাধারণকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যাতে তারা বাড়ির চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখেন, জমা জল দ্রুত সরিয়ে ফেলেন আর প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করেন।
ডেঙ্গির (Dengue) ঊর্ধ্বগতি নিয়ে উদ্বেগ-
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গির (Dengue) এই ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ সিজনের শেষ দিকে এসে আরও বিপজ্জনক হতে পারে। মশাবাহিত এই রোগে প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা যেমন জল জমা বন্ধ করা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি, তেমনই আক্রান্ত এলাকাগুলিতে আরও সচেতনতা প্রয়োজন। রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতিতে দ্রুত পদক্ষেপ না করলে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।