নিউজ ডেস্ক: ২০১৬ সালের এসএসসি প্যানেলে থাকা প্রায় ২৬ হাজার (২৫,৭৫৩) জনের চাকরি বৃহস্পতিবার বাতিল করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের ডিভিশন বেঞ্চ। ফলে এর প্রভাব পড়েছে রাজ্যের হাজার হাজার স্কুলের পঠনপাঠনে (Teacher Crisis for SSC Case)। রাজ্যের একাধিক স্কুলে তৈরি হয়েছে হাহাকার।
এসএসসি দুর্নীতি মামলা (SSC Recruitment case)-
২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এসএসসি-তে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। এর দু’বছর পর ২০১৮ সালের ১২ মার্চ প্রকাশ করা হয় চূড়ান্ত প্যানেল। ২৮ অগস্ট প্রকাশিত হয় প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের মেধাতালিকা। ২০১৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষক হিসাবে চাকরি পান নির্বাচিতেরা। এরপর ২০১৬ সালের সেই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০২১ সালে। কলকাতা হাই কোর্টে দায়ের হয় একগুচ্ছ মামলা। অভিযোগ ওঠে, গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মী, নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগে যথেচ্ছ দুর্নীতি হয়েছে। তারপর জল গড়িয়েছে বহুদূর। বৃহস্পতিবার ওই মামলাতেই রায় ঘোষণা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার জনের নিয়োগ।
এসএসসি-র গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি পদে বেআইনিভাবে নিয়োগের ঘটনায় প্রসন্ন রায়-
এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির খবর সামনে আসতেই তদন্তে নেমে এসএসসি-র গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি পদে বেআইনিভাবে নিয়োগের ঘটনায় এজেন্ট প্রসন্ন রায় ও তাঁর স্ত্রীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। সে সময়, প্রসন্ন রায় ও তাঁর স্ত্রীর নামে থাকা হোটেল, রেস্তরাঁ-সহ একাধিক ব্যবসা মিলিয়ে মোট ১৬৩ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ইডি।
তবে শুধু তাঁদের নয়, এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় একাধিক জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে আরও অন্যান্যদের বহু সম্পত্তির খোঁজ পান তদন্তকারীরা ৷ এসএসসি’র গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি পদে বেআইনি নিয়োগ-কাণ্ডে মোট ৫৮৮ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
মাধ্যমিক স্তরের পাশাপাশি ব্যাহত হতে চলেছে রাজ্যের উচ্চ মাধ্যমিকের পঠনপাঠনও-
মাধ্যমিক স্তরের পাশাপাশি ব্যাহত হতে চলেছে রাজ্যের উচ্চ মাধ্যমিকের পঠনপাঠনও। কারণ সোমবার থেকে উচ্চমাধ্যমিকে তৃতীয় সিমেস্টারের ক্লাস শুরু হতে চলেছে। শিক্ষকের অভাবে এর ওপরেও গভীর প্রভাব পড়তে চলেছে বলে অনুমান। শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যের স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পড়াতেন এমন শিক্ষকদের চাকরি শীর্ষ আদালতের রায়ে বাতিল হওয়ার প্রভাব পড়তে পারে প্রায় ৩,১২৫টি স্কুলে। নবম-দশম স্তরে পড়াতেন এমন শিক্ষকদের চাকরি বাতিলের প্রভাব পড়তে পারে ৫,৪২৬টি স্কুলে। গ্রুপ সি কর্মীদের চাকরি বাতিলের জের পড়তে পারে ২,২১৫টি স্কুলে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে গ্রুপ ডি কর্মীদের চাকরি বাতিলের প্রভাব ৩,৮৮৫টি স্কুলে পড়তে পারে বলে স্কুলশিক্ষা দফতর সূত্রে খবর। এর মধ্যে এমন স্কুল রয়েছে, যেখানে একাধিক শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীর চাকরি গিয়েছে। ফলে চাকরি যাওয়ার প্রভাব আদতে মোট কত সংখ্যক স্কুলে পড়েছে, তা এখনও জানা যায়নি।
জেলায় জেলায় বেনজির দৃশ্য-
আদালতের রায়ের (Supreme court) পর দুর্গাপুরের জেমুয়া ভাদুবালা হাইস্কুলে হেড মাস্টারকেই স্কুলের গেট খোলা থেকে শুরু করে ঘণ্টা বাজানোর কাজ করতে হয়েছে। জানা গিয়েছে, স্কুলের একজন করে গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মী ছিলেন। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে চাকরি গেছে দু’জনেরই। তারপর এদিন স্কুলে আসেননি দু’জনেই। প্রধান শিক্ষকের কথায়, ” স্কুল এসে আমি খুললাম। আমিই স্কুলে ঘণ্টা দিলাম। এটি হচ্ছে গ্রুপ-ডি-র কাজ। আমাদের একটিই গ্রুপ ডি আর একটিই গ্রুপ-সি ছিল। আজকের দিনটা সামলে দিলাম, এটা প্রতিদিন পারব না। আমার দুজন টিচার HS সেকশনে। দু’জন চলে গেলে ক্লাসগুলো কে নেবে?”
কলকাতা থেকে জেলা ছবিটা একই। দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর বিদ্যাপীঠে ক্লাস ইলেভেন ও টুয়েলভের ৬৭ জন পড়ুয়ার কম্পিউটার সায়েন্সের টিচার ছিলেন একজনই। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যার চাকরি চলে গেছে।
পাশাপাশি যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুলে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী মিলিয়ে তিন জন চাকরি হারিয়েছেন। এর ফলে স্কুলে আর কোনও অশিক্ষক কর্মী থাকল না।
শ্যামবাজারের দ্য পার্ক ইনস্টিটিউশনে চাকরি চলে গেছে গণিতের একমাত্র শিক্ষক-সহ ২ জনের।
দমদমের শ্রী অরবিন্দ বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক অসীমকুমার নন্দ জানিয়েছেন, মোট তিনজনের চাকরি বাতিল হয়েছে যাঁরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং বাণিজ্য বিভাগের বিষয়গুলি পড়াতেন। তিনি আরও বলেন, “আমরা চরম অসুবিধায় পড়েছি। আর্থিক সঙ্কট হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের খরচেই পঠনপাঠন চালু রাখতে দ্রুত তিনজন শিক্ষক নিয়োগ করা হবে।”
তবে কিছু অযোগ্য ব্যক্তিদের জন্য ভুক্তোভুগি এখন গোটা প্যানেলই। যারা আসলেই যোগ্য বলির পাঁঠা হতে হচ্ছে তাদেরও। আদালতের এই রায়ে কার্যত রাতারাতি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত অবস্থা। রাজ্যের এই দুর্নীতির শিকার এখন সকলকেই।