নিউজ ডেস্ক: শুরু হল বাংলা ক্যালেন্ডারের নতুন পাতা। ১৪৩২-কে স্বাগত জানিয়ে শুরু হল নতুন বছর। তাই এ দিনকে উৎসব-আনন্দে বরণ করে নেয় বাঙালি। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। অতীতের সব ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ (Bengal New Year)। সত্যি বলতে, বাংলা নববর্ষ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—আমরা বাঙালি, আমাদের রয়েছে একটি নিজস্ব ইতিহাস, একটি গর্বিত পরিচয়।
বাংলা নববর্ষ (Bengal New Year) কেবল একটি তারিখ নয়। এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক, সংস্কৃতির দিগন্তে গর্বিত একটি পতাকা। এই দিনটি আমাদের জাতিসত্তা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির নিদর্শন। হালখাতা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, লাল-সাদা পোশাক, আর মিষ্টিমুখ—সবকিছু মিলিয়ে এটি এমন এক উৎসব, যেখানে ধনী-গরিব, শহর-গ্রাম, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একসাথে উদযাপন করে। তবে অতীতের নববর্ষ পালনের রীতিনীতির সঙ্গে আধুনিক যুগের নববর্ষ পালনের রীতিনীতি অনেকটাই আলাদা। আসলে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে বদল এসেছে বাঙালির সংস্কৃতিতেও।
বাংলা নববর্ষের সেকাল
অতীতের পয়লা বৈশাখ (Pohela Boishakh 2025) পালনের বেশ কিছু নিয়ম রীতি লক্ষ্য করা যেত। যেমন নববর্ষের প্রথম দিনে হালখাতা খুলতেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়াও নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে বসত বৈশাখী মেলা। আর এই বৈশাখী মেলাতেই চলত সাংস্কৃতিক চর্চা।
বাংলা নববর্ষ (Bengal New Year) উদযাপনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই দিনটির শিকড় অনেক গভীরে, বিশেষ করে বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজে। এক সময় পহেলা বৈশাখ ছিল মূলত খাজনা আদায়ের দিন। জমিদাররা বসতেন বারান্দায়, আর কৃষকেরা নতুন ফসলের মৌসুম শুরুর আগে সেই দিনের মধ্যেই খাজনা পরিশোধ করতেন। এই অর্থনৈতিক লেনদেনকে ঘিরেই তৈরি হতো উৎসবের আবহ—গান, বাজনা, নাচ, আর মিষ্টিমুখ। তখনকার দিনে এই আয়োজন ছিল গ্রামের প্রাণকেন্দ্র। গান-বাজনা, বাউল সংগীত, হাট-বাজার, পুতুলনাচ, হালখাতা—সব মিলিয়ে এক জমজমাট আয়োজন, যা মানুষকে বিনোদনের পাশাপাশি সামাজিকভাবে একত্রিত করত।
অন্যদিকে সেকালে নববর্ষ মানেই বাড়িতে পড়ার নতুন জামা, সাথে পেট পুড়ে পেটপুজো। আর বিকেল হলেই বাড়ির বড়দের সাথে দোকানে দোকানে হালখাতা করতে যাওয়া। এক প্রকার এভাবেই কাটত সেকালের নববর্ষের প্রথম দিনটি।
বাংলা নববর্ষের একাল
বর্তমানে সব কিছু যেন একটু বেশিই লোক দেখানো। আসল রীতিনীতির থেকেও সোশ্যাল জীবন বেশি প্রাধান্য পায়। বর্তমানে এখনও দোকানে দোকানে সেকালের মতোই হালখাতার চল রয়েছে, রয়েছে নববর্ষের প্রথম দিন সকালে মন্দিরে পুজো দিতে যাবার ঢলও। তবে সবই আবেগে গা ভাসানোর জন্য। সব রীতিনীতি আগের মত থাকলেও নেই পুরনো সেই জৌলুস। এখন নববর্ষ মানেই শুধু চৈত্র সেল থেকে বাড়ির জামা কাপড় কেনাকাটা নয়, বরং পুরোদমে চলে পুজোর মতোই কেনাকাটা। আর নববর্ষের দুপুরের পেটপুজো শুধু বাড়ির রান্না ঘরেই সীমাবদ্ধ নেই বরং রেস্টুরেন্টে রেস্টুরেন্টে বেড়েছে ভিড়। এখনকার পহেলা বৈশাখ (Pohela Boishakh 2025) মানেই—লাল-সাদা পোশাক, পান্তা-ইলিশের স্বাদ, ঢাক-ঢোল, আলপনা, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা আর হাজারো মানুষের ঢল। এটি এখন কেবল গ্রাম বাংলার নয়, বরং জাতীয় উৎসবে রূপ নিয়েছে।
তবে সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে বৈশাখী মেলা। আগের মত সেভাবে আর চোখে পড়ে না বৈশাখী মেলার, তবে বর্তমানে শহর হোক কিংবা গ্রাম, নববর্ষের বিকেলে পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের চল রয়েছে।
আর সবচেয়ে উল্লেখ্য যোগ্য বিষয় হল, বর্তমানে ইংরেজি নতুন বছর বাঙালিরা যেভাবে আড়ম্বরের সাথে পালন করে, রাত জেগে হৈহুল্লোড় করে, পার্টি করে ইংরেজি নতুন বছরকে (new year) স্বাগত জানায়, তার সিকিভাগ উচ্ছ্বাসও দেখা যায় না বাংলা নতুন বছরে।
সব শেষে এটাই বলার যে, বাংলা নববর্ষ (Bengal New Year) কেবল একটি দিনের উৎসব নয়—এটি বাঙালির হৃদয়ের উৎসব। আমাদের উচিত এই ঐতিহ্যকে ভালোবাসা ও যত্নের সঙ্গে আগামীতেও বাঁচিয়ে রাখা।