নিউজ ডেস্ক: চেনা ছন্দে ফিরছে মুর্শিদাবাদ। খুলছে দোকানপাট, বসছে বাজার। মানুষজনও রাস্তায় চলাচল শুরু করেছেন। গত কয়েক দিনের অশান্তির ছবি (Murshidabad unrest) পাল্টাতে শুরু করছে মুর্শিদাবাদে। সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদে গত শুক্রবার থেকে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মুর্শিদাবাদের একটি অংশ। অশান্তির খবর প্রকাশ্যে আসতেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। শনিবার রাতেই মুর্শিদাবাদ চলে যান রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার। এ ছাড়াও, বিভিন্ন জেল থেকে ‘দক্ষ’ ২৩ জন পুলিশ আধিকারিককেও পাঠানো হয় সেখানে।
অশান্তির আবহে (Mursidabad situation Update) যাতে ভুয়ো এবং উস্কানিমূলক বার্তা ছড়াতে না পারে, সেই কারণে জঙ্গিপুর পুলিশ জেলার একটা বড় অংশে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই সমশেরগঞ্জ বাদে জেলার বাকি অংশে ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হয়েছে। তবে এখনই ১৬৩ ধারা উঠছে না। আপাতত বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিএনএসএস ১৬৩ ধারা (পূর্বে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৪ ধারা) বলবৎ থাকবে।
চরম ধোঁয়াশায় শিক্ষক থেকে ছাত্রছাত্রীরা
তবে এই পরিস্থিতিতে ধুলিয়ান-সামশেরগঞ্জের মতো এলাকায় চরম ধোঁয়াশায় শিক্ষক থেকে ছাত্রছাত্রীরা। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা তাদের স্কুলের শিক্ষকদের জানিয়েছেন, পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এদিকে উপদ্রুত এলাকার ছোট ছোট ছাত্র-ছাত্রীরা জানিয়েছেন, তাঁদের অনেকের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বইপত্র লুটপাট করে ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই ঘর ছাড়া। এই অবস্থায় তারা স্কুল যাবে কীভাবে? সব মিলিয়ে চরম সংশয় পড়েছেন স্কুলের শিক্ষক থেকে ছাত্র-ছাত্রী সকলেই।
অন্যদিকে মুর্শিদাবাদের অশান্ত এলাকায় (Mursidabad situation Update) ত্রাণ ইত্যাদি ত্রাণ দিতে চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে একটি সংগঠন। তাঁদের দাবি, ছোট ছোট টিম যাবে ওষুধ, খাবার পৌঁছে দিতে। বাকিরা গেলেও ওই সংগঠনকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই মামলা দায়ের অনুমতি মিলেছে। বৃহস্পতিবার বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে শুনানি।
মুর্শিদাবাদে অশান্তি (Murshidabad Chaos) ছড়ানোর পিছনে কারা?
তবে মুর্শিদাবাদের এই ঘটনায় প্রশ্ন একটাই, ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ। কিন্তু তার আগুনে কেন পুড়ল সাধারণ মানুষের বাড়ি? কেন লুঠ করা হল শপিং মলে? কী দোষ ছিল সাধারণ মানুষের?
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার থেকে সামশেরগঞ্জ, সূতি ও ধুলিয়ানের বিভিন্ন প্রান্তে যে হাঙ্গামা ও হামলা শুরু হয়েছিল, তাতে অংশ নিতে দেখা গিয়েছে মুখ ঢাকা এমন বেশ কিছু যুবককে, যাদের পিঠে ‘ব্যাকপ্যাক’ ছিল। সামশেরগঞ্জ, ধুলিয়ান ও সূতির বিভিন্ন প্রান্তে বাছাই করা যে সমস্ত বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়েছে, তাতেও ওই যুবকদের অংশ নিতে দেখা গিয়েছে। গোয়েন্দারা বলছেন, এরা বিহার-ঝাড়খণ্ড এবং বাংলাদেশ থেকে আসা ‘ভাড়া করা লুটেরা’। ওয়াকফ আইনের বিরোধিতাকে সামনে রেখে এরা দোকান ভেঙে ক্যাশবাক্স ও গৃহস্থ বাড়ির আলমারি ভেঙে টাকা, গয়না ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী লুট করেছে। পাশাপাশি শপিং মল থেকে প্যান্ট-শার্ট, শাড়ি, ইলেকট্রনিক সামগ্রী সহ বহু সামগ্রী তুলে নিয়ে গিয়েছে ওরা। গোয়েন্দারা আরও বলছেন, এই যুবকদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। তবে ধুলিয়ানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৈঠকে মুর্শিদাবাদ ও মহারাষ্ট্রের যে ‘চক্রী’রা হাজির হয়েছিল, তাদের কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জানা গিয়েছে, ওয়াকফ আইন বিরোধিতাকে মাধ্যম করে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্তে ‘দুষ্কৃতী’রা যে তাণ্ডব (Murshidabad Chaos) চালিয়েছে, তার ‘নীল নকশা’ তৈরি হয়েছিল ধুলিয়ানের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে। গত বছরের অক্টোবর মাসে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হাঙ্গামা, পুলিশকে আক্রমণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলার ষড়যন্ত্রের ‘বীজ বপন’ করা হয়েছিল। অপেক্ষা ছিল একটা ইস্যুর। সেটা ওয়াকফ আইন সংক্রান্ত প্রতিবাদ জুগিয়ে দিয়েছে।
আসলে মুর্শিদাবাদ বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া জেলা। এখানে বহিরাগত শক্তি ঢুকে পড়া খুব অস্বাভাবিক নয়। এছাড়াও ধুলিয়ান, সুতিও বাংলার অন্যতম স্পর্শকাতর এলাকা। একদিকে ঝাড়খণ্ড, অন্যদিকে বাংলাদেশ সীমান্ত রয়েছে। মাদক পাচার, জাল নোটের অন্যতম করিডর এটা। সেখানে দাঁড়িয়ে এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে, এলাকার দুষ্কৃতীরা আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই অশান্তির এই ঘটনায় ভিন রাজ্যের বা বা অন্য দেশের দুষ্কৃতীদের উসকানির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
কারন, এই অশান্তির ঘটনায় উঠে আসছে গভীর ষড়যন্ত্রের চিত্র। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, মুর্শিদাবাদের সূতি, ধুলিয়ান ও সামশেরগঞ্জে অশান্তি পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের দু’টি নিষিদ্ধ সংগঠন ও এপারের কিছু ব্যক্তির মদতে এই অশান্তি ছড়ানো হয়েছে। লালগোলা সীমান্তে বৈঠক, চোরাপথে অনুপ্রবেশ ও পাথর মজুতে মিলেছে সন্ত্রাসের ছাপ। তুরস্ক থেকে অর্থ ও মাদ্রাসায় লজিস্টিক সাপোর্টের প্রমাণও মিলেছে বলে খবর গোয়েন্দা সূত্রে। বিএসএফ ও গোয়েন্দারা ৭০টি মোবাইল কল চিহ্নিত করেছে। গোয়েন্দাদের ধারণা, হামলার উদ্দেশ্য ছিল সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস ও জনভীতি ছড়ানো। ঘটনাকে কাশ্মীরের পাথর ছোঁড়ার ঘটনার সঙ্গেও তুলনা করছেন তদন্তকারীরা।
মুর্শিদাবাদে এবার আসছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (NHRC)
এমত পরিস্থিতিতে অশান্ত মুর্শিদাবাদে এবার আসছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। বিশেষ টিম গড়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট কমিশনে জমা দেওয়ার নির্দেশ। পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে ডিজি (তদন্ত বিভাগ)-কে একটি বিশেষ টিম গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৩ সপ্তাহের মধ্য়ে তদন্ত রিপোর্ট কমিশনে জমা দিতে বলা হয়েছে। ডিজি (তদন্ত বিভাগ)-কে লেখা চিঠিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের আইন বিভাগ জানিয়েছে, ‘মুর্শিদাবাদে ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদের মাঝে সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশিত নানা প্রতিবেদনে বাবা-ছেলেকে খুনের অভিযোগ উঠে এসেছে। ঘটনায় পুলিশ কোনও পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ। এই মর্মে মুর্শিদাবাদে ঘটনাস্থল সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত বিভাগকে টিম গঠনের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।’