নিউজ ডেস্ক: টাটা ট্রাস্ট (Tata Trust) তার জাতীয় রিপোর্ট বের করেছে। আর সেখানে ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশি ব্যবস্থার নিদারুণ ছবি। দেশের মধ্যে সবচেয়ে নীচে স্থান পেয়েছে এই রাজ্য। বলা চলে, এর আগের বারের স্থানই ধরে রেখেছে বাংলা (West Bengal) । আর এভাবেই সারা দেশের কাছে বাংলার মাথা হেঁট হওয়া ছবি ফুটে উঠেছে ইন্ডিয়া জাস্টিস রিপোর্টে (India Justice Report 2025)।
২০১৯ সাল থেকে এই রিপোর্ট প্রকাশ করতে শুরু করে টাটা ট্রাস্ট। চারটি মাপকাঠির ভিত্তিতে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এগুলি হল – পুলিশ, জেল পরিচালনা, বিচার পরিষেবা ও আইনি সহায়তা। এককথায় প্রশাসন কতটা দক্ষ, পুলিশি ব্যবস্থায় কতটা সুখে আছে রাজ্য, তা বিচার করতেই এই ইন্ডিয়া জাস্টিস রিপোর্ট। আর সেখানেই ২০২৫ সালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সবার নীচে বাংলা।
১৮টি বড় ও মাঝারি রাজ্যের মধ্যে এই ছবি উঠে এসেছে। নাগরিকদের বিচার পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবার প্রথমে আছে কর্ণাটক। তালিকায় সবার উপরে জায়গা করে নিয়েছে দক্ষিণেরই ৫ রাজ্য। এগুলি হল – কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কেরালা ও তামিলনাডু। এখানে চোখে পড়ার মতো উন্নতি করেছে তেলেঙ্গানা। গত বছর তারা ১১ তম স্থানে ছিল। এবছর উঠে এসেছে তৃতীয় স্থানে।
ছোট রাজ্যের মধ্যে সিকিম তার ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছে। সবচেয়ে ভালো কাজ করেছে তারা। ছোট ক্যাটাগরিতে ৭ রাজ্যের মধ্যে সবার নীচে গোয়া। এই রাজ্যেই সরকার গড়ার লোভে দৌড়েছিল তৃণমূল। তবে সেখানকার ভোটে তারা কোনও দাগ কাটতে পারেনি। গত ৩ বছরে পুলিশ বিভাগে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে বিহার। এই সময়ে বিচার বিভাগের কাজে উন্নতি করেছে রাজস্থান, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ। কারাগার পরিষেবায় ভালো কাজ করেছে ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড।
কিন্তু এই রিপোর্টে বাংলার হাল এতো বেহাল কেন? তালিকায় চোখ রাখলে দেখা যাচ্ছে, কর্ণাটকের সার্বিক স্কোর যেখানে ৬.৭৮ সেখানে পশ্চিমবঙ্গ মাত্র ৩.৬৩ পেয়েছে। বাংলার উপরে রয়েছে ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ । গোটা দেশের মধ্যে সিভিক পুলিশের সংখ্যা সবথেকে বেশি হারে বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু রাজ্যের পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল পদে প্রায় ৪১ শতাংশ পদ খালি পড়ে রয়েছে। বিরোধীরা যে অভিযোগ তোলে যে, সব দিক দিয়েই সিভিকেই চালাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, এই রিপোর্টেই তা পরিষ্কার হয়েছে। সিভিক পুলিশের অনুমোদিত পদ পশ্চিমবঙ্গে ২০২২ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে ১,২১,০১২ থেকে বেড়ে ১,২৭,৭২৭ হয়েছে। অর্থাৎ ৬,৭১৫টি সিভিক পুলিশের পদের সংখ্যা বেড়েছে। আর কোনও রাজ্যে সিভিক পুলিশের সংখ্যা এত বাড়েনি। আবার আর কোনও রাজ্যে এত হারে কনস্টেবলের পদও খালি পড়ে নেই। ১৮টি বড় ও মাঝারি রাজ্যের মধ্যে জেল পরিচালনার মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে ১১-তম স্থানে। আইনি সহায়তার মাপকাঠিতে ১৫-তম স্থানে।
পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র মুখ রক্ষা করেছে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। সেখানে কোনও এক্সিকিউটিভ পদ খালি নেই। যা বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছিল, সবটাই ব্যবহার করেছে তারা। তবে তা সত্ত্বেও এখনও কর্মী নিয়োগ বাকি আছে ২৫ শতাংশের ওপর। আর তাই ওপর মহলে সব আসন ভর্তি করলেও, নিচুর দিকে কতটা কাজ হচ্ছে, তা প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে। প্রশ্ন তুলছে, তারা রাজ্যের মানুষকে কতটা ন্যায়বিচার দিতে পেরেছে। ন্যায় বিচার দেওয়ার ক্ষেত্রে সবার উপরে রয়েছে কর্ণাটক।
আবার নাগরিকদের বিচার পাইয়ে দেওয়ার নিরিখে কর্নাটক প্রথম স্থানে থাকলেও, রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোনও রাজ্য পুলিশ বাহিনীতে সংরক্ষিত আসনে মহিলা নিয়োগ করেনি। দেশের ২০.৩ লক্ষ পুলিশ বাহিনীতে উচ্চপদে ১ হাজার জনেরও কম মহিলা রয়েছেন। দেশের ১০টির মধ্যে তিনটি থানায় কোনও মহিলা হেল্প ডেস্ক নেই। ১৭ শতাংশ থানায় কোনও সিসিটিভি নেই।
চতুর্থ ইন্ডিয়া জাস্টিস রিপোর্ট ২০২৫-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে মোট পুলিশ কর্মীর সংখ্যা ২০.৩ লক্ষের মতো। তার মধ্যে মহিলা পুলিশ কর্মীর সংখ্যা ২ লক্ষ ৪২ হাজার ৮৩৫। আইপিএস র্যাঙ্কে রয়েছেন ৯৬০ জন মহিলা পুলিশ আধিকারিক। দেশজুড়ে আইপিএস আধিকারিকের সংখ্যা ৪ হাজার ৯৪০। রিপোর্ট বলছে, ১ লক্ষ জনসংখ্যা পিছু দেশে পুলিশ আছে গড়ে ১৫৫। এই সংখ্যা বেড়ে হওয়া উচিত ছিল ১৯৮। কিন্তু জাতীয় স্তরে এই ছবি থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাটা আরও লজ্জার।
এখানেই প্রশ্ন উঠছে, এই পরিস্থিতি কবে বদলাবে? পশ্চিমবঙ্গে অসংখ্য পুলিশ পদ খালি অবস্থায় পড়ে রয়েছে। নিয়োগের নামগন্ধ নেই। শুধু নিয়োগের সংখ্যা বেড়েছে সিভিকের। এটা কীসের জন্য? নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা শাসকের হাতে রাখার জন্য? প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। আর বাংলার মানুষ বলছে, বদল দরকার পরিস্থিতির। এই সিভিক নিয়োগ কমিয়ে যোগ্য পুলিশ অফিসার নিয়োগ হলে হয়তো আরজিকরের মতো ঘটনা আটকানো যেত। হয়তো জেলায় জেলায় বিশৃঙ্খলা রোধ করা যেত। কিন্তু কীভাবে সেই পরিস্থিতির বদল আসবে, তারই উত্তর খুঁজছে গোটা বাংলা।