নিউজ ডেস্ক: প্রতি বছর ১৮ এপ্রিল বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস (World Heritage Day 2022)। এই দিনটি প্রতিটি দেশের জন্য বিশেষ, যারা তাদের সংস্কৃতির সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, অনন্য শৈলী, ভবন এবং স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণ করতে চায় এবং আগামী প্রজন্মের কাছে তাদের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে চায়। ইউনেস্কো (UNECO) প্রতি বছর প্রায় ২৫টি ঐতিহ্যবাহী স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, যাতে সে সব ঐতিহ্যগুলোকে রক্ষা করা যায়।
বিশ্ব ঐতিহ্য দিবসের তাৎপর্য
বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস আন্তর্জাতিক স্মৃতিস্তম্ভ এবং স্থান দিবস হিসেবেও পরিচিত। এর পিছনের লক্ষ্য সর্বদাই ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ঐতিহাসিক স্থান এবং উল্লেখযোগ্য স্মৃতিস্তম্ভগুলিকে রক্ষা করা।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে, বিশ্ব ঐতিহ্য দিবসের “ঐতিহ্য পরিবর্তন” প্রতিপাদ্যের অধীনে, দুটি নতুন ভারতীয় স্থান, হোয়সল এবং শান্তিনিকেতনের পবিত্র সমাহার, তালিকায় যুক্ত করা হয়েছিল। প্রতি বছর এই দিনে, বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা একে অপরের ইতিহাস এবং রীতিনীতি সম্পর্কে আলোচনা এবং জ্ঞান বিনিময় করার জন্য একত্রিত হন।
চলুন জেনে নেওয়া যাক এ শহরের কিছু ঐতিহ্যবাহী স্থানের নাম ও তার গুরুত্ব-
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল
তিলোত্তমার ঐতিহাসিক স্থানের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জায়গা হল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল৷ এই দুর্দান্ত মার্বেল প্রাসাদটি কেবল স্থাপত্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন নয় বরং ঐতিহাসিক নিদর্শন যা শিল্পকর্মের ভাণ্ডারও বটে।
রবীন্দ্র সদন
ইতিহাসে সমৃদ্ধ এবং সাংস্কৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ একটি শহর তিলোত্তমা৷ এই জায়গা উপভোগ করার জন্য সেরা ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলির মধ্যে অন্য আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থান হল রবীন্দ্র সদন। নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে নামকরণ করা এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে থিয়েটার, নৃত্য, সঙ্গীত এবং কবিতা আবৃত্তি-সহ বিভিন্ন পরিবেশনার আয়োজন করা হয়।
কলেজস্ট্রিট
কলকাতার সাহিত্য-ঐতিহ্যর আরও একটি নিদর্শন কলেজস্ট্রিট যা বইপাড়া। এই ব্যস্ততম এলাকাটিতে প্রচুর বইয়ের দোকান রয়েছে, যা এটিকে বইপ্রেমীদের কাছে স্বর্গ করে তোলে। এখানে রাস্তার চা ও বিখ্যাত৷ আর এখানেই রয়েছে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস বা ইন্ডিয়ান কফি হাউজ, যা উত্তর কলকাতার এক ঐতিহ্যময় জায়গা৷
হাওড়া ব্রিজ
আর কলকাতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক রত্ন হল হাওড়া ব্রিজ৷। ১৯৪৩ সালে নির্মিত এই আইকনিক ক্যান্টিলিভার ব্রিজটি কলকাতার বহু ইতিহাসের সাক্ষী। বর্তমানে হাওড়া ব্রিজ কেবল পরিবহনের একটি মাধ্যম নয় বরং একটি ল্যান্ডমার্কও যা কলকাতার পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
নিউ মার্কেট
আর কলকাতার কোনও ভ্রমণই ব্যস্ত নিউ মার্কেট পরিদর্শন ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই বাজারটি দোকানপ্রেমীদের জন্য একটি স্বর্গরাজ্য। পোশাক এবং আনুষাঙ্গিক থেকে শুরু করে হস্তশিল্প এবং মশলা, সবকিছুই এই বাজারেই পেয়ে যাবেন।
বিড়লা মন্দির
এছাড়াও বিড়লা মন্দির হল কলকাতায় অবস্থিত একটি আধুনিক হিন্দু মন্দির। এই মন্দির তার সুন্দর স্থাপত্যর জন্য পরিচিত এবং শহরের একটি অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ এটি।
ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম
অন্যদিকে, কলকাতার শিল্প ও ইতিহাস প্রেমীদের জন্য এক অমূল্য সম্পদ হল ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম৷ যা ভারতের প্রাচীনতম জাদুঘর। ১৮১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মিউজিয়াম ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালের শিল্পকর্মের বিশাল সংগ্রহ ধারণ করে।
সায়েন্স সিটি
সায়েন্স সিটি হল কলকাতায় অবস্থিত একটি শিক্ষা ও বিনোদন কেন্দ্র। এখানে একটি স্পেস থিয়েটার, একটি প্ল্যানেটারিয়াম এবং একটি বিজ্ঞান জাদুঘর রয়েছে। শিশুদের সাথে ঘুরে দেখার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত জায়গা।
কালীঘাট
এছাড়াও কালীঘাট মন্দির হল দেবী কালীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি বিখ্যাত কালি মন্দির । এটি কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এবং শহরের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি । মন্দিরটি তার সুন্দর স্থাপত্য এবং আধ্যাত্মিক পরিবেশের জন্য পরিচিত।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি
অন্যদিকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি কলকাতার জোড়াসাঁকোতে অবস্থিত ঠাকুর পরিবারের প্রাচীন বাড়ি। এই বাড়িটি বর্তমানে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গণ্য করা হয়৷ ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে নীলমণি ঠাকুর এই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নির্মাণ করেন। ১৮৬১ সালে এখানেই জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ তাই ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের দিক থেকে এর গুরুত্বও কম কিছু নয়।
বোটানিক্যাল গার্ডেন
আর সব শেষে কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে একটি সবুজ মরূদ্যান-বোটানিক্যাল গার্ডেন। .২৭০ একর জুড়ে বিস্তৃত এই বিশাল উদ্যানটি উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের বৈচিত্র্যময় সংগ্রহের আবাসস্থল। আর এখানেই রয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেনের সেই আইকনিক গ্রেট বটগাছ৷ যা বিশ্বের বৃহত্তম গাছগুলির মধ্যে একটি বলে মনে করা হয়।
তবে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ভারতেও বেশ কয়েকটি হেরিটেজ সাইট রয়েছে। ভারতের এই সাইটগুলি আমাদের সংস্কৃতি তুলে ধরে।
তাজমহল, উত্তরপ্রদেশ
বিশ্বের সপ্তাম আশ্চর্য হল ভারতের তাজমহল। এটি আদতে সমাধি মসজিদ। মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর তৃতীয় স্ত্রী বেগম মমতাজ সম্মানে তাঁর কবরের ওপর নির্মাণ করেছিলেন। বেগম মমতাজ মহলের মৃত্যুর পর সম্রাট এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৬৩১ সালে বেগম মমতাজ মহল মারা যান। তাজমহল নির্মিত হয়েছিল ১৬৩২ সালে। এটি ১৯৮৩ সালে ক্যাটাগরি I-এর অধীনে একটি সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
কোনার্ক সূর্য মন্দির, ওড়িশা
ওড়িশার কোনার্ক সূর্য মন্দির, যা ‘ব্ল্যাক প্যাগোডা’ নামেও পরিচিত। ওডিশার কোনার্কের এই সূর্য মন্দির ১৩শ শতাব্দীর। এটি বঙ্গোপসাগরের পূর্ব উপকূলে মহানদী ব-দ্বীপে ২৪টি চাকা বিশিষ্ট সূর্যের রথের আকারে তৈরি করা হয়েছে।
সাঁচির স্তূপ, মধ্যপ্রদেশ
ভারতের মধ্য প্রদেশ রাজ্যের রাইসেন জেলায় অবস্থিত। এটি মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপাল থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সাঁচির বৌদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভগুলি হল বৌদ্ধ কাঠামোর একটি সিরিজ যা খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। ইউনেস্কো এটির অনন্য সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের কারণে এটিকে ২৪ জানুয়ারি ১৯৮৯ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে মনোনীত করে।
অজন্তা গুহ, মহারাষ্ট্র
মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে অবস্থিত অজন্তা গুহাগুলি বৌদ্ধ ধর্মীয় শিল্পের মাস্টারপিস হিসাবে স্বীকৃত। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক থেকে প্রায় ৪৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৩০টি শিলা-কাটা বৌদ্ধ গুহা স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। ভারতে আসা বিভিন্ন মধ্যযুগীয় চীনা বৌদ্ধ পর্যটকদের স্মৃতিচারণে, সেই সঙ্গে ১৭ শতকের গোড়ার দিকে আকবর-যুগের মুঘলদের নিদর্শনও রয়েছে। অজন্তা গুহাগুলিও ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
মহাবোধি বিহার মন্দির, বিহার
মহাবোধি বিহার বা মহাবোধি মন্দির হল বোধগয়ায় অবস্থিত একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার। ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই মন্দিরটি বিহারের গয়াতে অবস্থিত। এটি একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে গৌতম বুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে জ্ঞান লাভ করেছিলেন। এটি বোধি গাছের বংশধর, যার অধীনে বুদ্ধ জ্ঞান লাভ করেছিলেন এবং এটি দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি হিন্দু ও বৌদ্ধ তীর্থস্থান।
তবে আজকের এই দিনটি পালনের ব্যপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস বা আইসিওএমওএস। তারা ইউনেস্কোর (ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন) সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে। একই সঙ্গে তার প্রচার ও প্রসারের কাজও তারা করে।