নিউজ ডেস্ক: সম্প্রতি ইউনেস্কোর (Unesco) মেমরি অফ ওয়র্ল্ড রেজিস্টারে (Memory of World Register) ঐতিহ্যে জায়গা পেল ভগবদ গীতা (Bhagavad Gita) ও ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রের (Natyashastra) পাণ্ডুলিপি। বৃহস্পতিবার ইউনেস্কো ৭৪টি নতুন ডকুমেন্টারি হেরিটেজ সংগ্রহকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আর তাতেই রয়েছে ভারতের এই অমূল্য সম্পদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কালজয়ী এই রচনাগুলি সাহিত্যের চেয়েও বেশি কিছু। এগুলি দার্শনিক ও নান্দনিক ভিত্তি যা বিশ্বের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের চিন্তাধারা ও জীবনযাপনকে তুলে ধরেছে। এই নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের রেজিস্টারে আমাদের দেশের ১৪টি প্রাচীন পুস্তক ঠাঁই পেল।
উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর ‘মেমরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’ গোটা বিশ্বের প্রাচীন ঐতিহাসিক লেখ্য, পাণ্ডুলিপিকে স্বীকৃতি দেয়। যে সব পুস্তক প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সমাজকে প্রভাবিত করছে, সেই সব লেখ্যই ঠাঁই পায় রাষ্ট্রসংঘের এই রেজিস্টারে। এবার সেই তালিকায় জায়গা পেল মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুনকে দেওয়া শ্রীকৃষ্ণের বাণী, যা গীতা নামে পরিচিত। এবং বৈদিক যুগে লেখা ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্র। যা নৃত্যকলা, অভিনয়, গীত-সুরের সংমিশ্রণে তৈরি এক অন্যন্য পুঁথি।
ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রের ইতিহাস
নাট্যশাস্ত্র হল বিশ্বের প্রাচীনতম শিল্পকর্মের উপর লিখিত গ্রন্থ, যা নৃত্যকলা, অভিনয়, গীত-সুরের সংমিশ্রণে তৈরি। যা প্রায় ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভরত মুনি লিখেছিলেন। ভরত মুনির শিল্পকর্মের উপর এই বিশ্বকোষীয় রচনাটি ৩৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত এবং এতে ৬,০০০-এরও বেশি শ্লোক রয়েছে। নাট্যশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায়ে এই রচনার সৃষ্টির একটি আধা-ঐতিহাসিক এবং পুরাণিক বিবরণ রয়েছে।
নাট্যশাস্ত্র হল নাট্য এবং শাস্ত্র – এর সংমিশ্রণ। নাট্য বলতে নৃত্য ও নাটকের কৌশল বোঝায় এবং শাস্ত্র বলতে বিজ্ঞান বোঝায়। এটিই সেই মহান রচনা যা বর্ণনা করে – পরিচালক এবং দর্শকদের মধ্যে সম্পর্ক, নাটকের গঠন, অভিনয়ের কৌশল, পোশাক এবং মেকআপ, ব্যবহৃত সঙ্গীত এবং বাদ্যযন্ত্র, মঞ্চের মাত্রা এবং আলোর সাথে এর সাজসজ্জা, এবং হলের আকার এবং দর্শকদের বসার স্থান। নাটকের পরিচালক এবং প্রযোজকরা উল্লেখ করেছেন যে এই যুগেও এর প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি।
জনশ্রুতি আছে যে, একবার দেবতারা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে সকল মানুষের বিনোদনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কাজের অতিরিক্ত চাপের কারণে, ব্রহ্মা সম্ভবত এই ধরণের বিনোদনের ব্যাকরণ লেখার জন্য ঋষি ভরতকে বেছে নিয়েছিলেন। এরপর তিনি ভরতকে তাঁর নাট্যবেদের একটি কপি উপহার দিয়েছিলেন, যার মধ্যে ঋগ্বেদ (পাঠ), যজুর্বেদ (অভিনয়), সামবেদ (সঙ্গীত) এবং অথর্ববেদ (অনুভূতি) থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ ছিল। এরপর ব্রহ্মা তাঁকে থিয়েটারের সাথে সম্পর্কিত সবকিছুর জন্য নিয়ম তৈরি করার নির্দেশ দেন। ব্রহ্মার কথা মেনে, ভরত তাঁর কাজ শুরু করেন। নাট্য শাস্ত্র আসলে থিয়েটারের উপর একটি বিশেষ গ্রন্থ এবং অবশ্যই মঞ্চের অভিনেতাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা।
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় নাটক ভরতের নাট্যশাস্ত্র দ্বারা রূপায়িত হয়েছিল। মন্দির ও প্রাসাদে মঞ্চস্থ হওয়া বিখ্যাত ধ্রুপদী নাট্যকাররা কেবল এর নিয়মগুলি কঠোরভাবে অনুসরণ করেননি, বরং সাধারণ মানুষের নাট্যমঞ্চেও এর মূলনীতি মেনে চলেন। ভরত মুনি আসলে অন্যান্য মুনিদের নাট্য বিষয়ক কৌতূহল গুলিকে যথাসম্ভব নিবারণ করার চেষ্টা করেছেন এই নাট্য শাস্ত্রের মাধ্যমে। ৩৬ টি অধ্যায়ের এই সংকলনে মুনিরা পাঁচটি প্রধান ও পরে আরও কিছু আনুষাঙ্গিক প্রশ্ন করেছেন। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভরত নাট্যের উৎপত্তি ও এই পৃথিবীতে তার প্রয়োগ কৌশল সহ নাট্যশালার নির্মাণ, বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান, প্রাথমিক প্রস্তুতি, নাট্যের কোরিওগ্রাফি, বিভিন্ন অভিনয়ে রস সহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এমনকি অভিনেতা তথা নটের প্রশিক্ষণ সম্বন্ধেও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ভরত মুনি।
ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রই কি আমাদের নাট্য সংস্কৃতির প্রধান উৎস?
তবে ব্রিটিশদের আগমনের সাথে সাথে আমাদের ভারতীয় থিয়েটারগুলিতে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। ইউরোপীয় থিয়েটারের প্রভাবে, আমাদের ভারতীয় থিয়েটারগুলিও পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে অনেকেই হয়তো মনে করেন গ্রীক নাটক এবং শেক্সপিয়ার আমাদের নাট্য সংস্কৃতির উৎস, তবে নাট্যশাস্ত্রের ইতিহাস ঘাঁটলে এ কথা স্পষ্ট ভাবেই বোঝা যাবে যে, গ্রীক নাটক এবং শেক্সপিয়ার দেশে আসার অনেক আগে থেকেই ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্র ভারতীয় নাট্য, সঙ্গীত এবং শিল্পের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ফলে এ কথা স্পষ্ট যে, প্রাচীন গ্রীক নাটক এবং উইলিয়াম শেক্সপিয়রের কাজগুলি আমাদের নাট্য সংস্কৃতির উৎস নয়, তবে তারা এ দেশের নাট্য সংস্কৃতির ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।