নিউজ ডেস্ক: মুর্শিদাবাদে গোয়েন্দা ব্যর্থতা না ছক কষে হামলা? এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে জেলা তথা রাজ্য জুড়ে। ধুলিয়ান, সামসেরগঞ্জে যেভাবে হামলা হয়েছে, তা রাতারাতি ঘটতে পারে না বলে মত প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিকদের। এই সব অঞ্চলে ভোট অঙ্কের নিরিখে অনেকটাই পিছিয়ে শাসক দল। এলাকাগুলি মুর্শিদাবাদ জেলায় হলেও মালদহ লোকসভার অন্তর্গত। যা মূলত কংগ্রেসের দখলে। তাই প্রশ্ন উঠছে, হিংসা বিধ্বস্ত অঞ্চলের কাছাকাছি শাসক দলের অন্য সাংসদ, বিধায়করা থাকলেও, দুদিন ধরে তাঁরা কিছু জানতে পারলেন না!পরপর দুদিন হামলা হল, তাও কেন আসরে নামল না পুলিশ! থানায় ফোন করলেও কেউ কেন ফোন তুলল না? আক্রান্তরা যখন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে এসব প্রশ্ন করছেন, তখন প্রশাসনের নানা খামতির দিকগুলি সামনে উঠে আসছে।
গোয়েন্দা ব্যর্থতায় হিংসা?
বিভিন্ন মিডিয়ায় এই নিয়ে জোর চর্চা চলছে। হিংসার তদন্তে গঠিত হয়েছে সিট। সেই সিটের বৈঠকে গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিষয়টি উঠে এসেছে বলে জানা যাচ্ছে। সিটের সদস্যদের একাংশের মনে প্রশ্ন, সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায় শুরু হওয়া প্রতিবাদ এমন হিংসাত্মক হয়ে উঠল কীভাবে? কেন তা আগে থেকে আঁচ করা গেল না? রাজ্য পুলিশ তখন কী করছিল?
পুলিশ সূত্রে খবর, ১৬ এপ্রিল বুধবার রাতে সামসেরগঞ্জ থানায় সিট-এর প্রথম বৈঠক হয়। বৈঠকে হাজির ছিলেন তদন্তকারী দলের প্রধান সুপ্রতিম সরকার। প্রায় আড়াই ঘণ্টার উপর বৈঠক চলে। সিট-এর কুড়ি জনের মধ্যে ৯ জন প্রতিনিধিও ওই বৈঠকে হাজির ছিলেন। সূত্রের দাবি, মুর্শিদাবাদের এই সাম্প্রতিক হিংসায় যে ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’ ছিল, বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন অফিসার নাকি তেমনই অভিমত দিয়েছেন। তাঁরা ২টি বিষয় বলছেন। এক – আগে থেকে গোটা ঘটনার গুরুত্বই বুঝতে পারেনি, দুই – হিংসা দ্রুত ছড়িয়েছে, তা আটকাতে অক্ষমতা। গোটা ঘটনার নেপথ্যে পূর্ব পরিকল্পনার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হয়নি।
পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র?
মুর্শিদাবাদে হিন্দুদের উপর হামলা কি পূর্ব পরিকল্পিত? ঘটনার পরম্পরা দেখে এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না পুলিশ অফিসাররাও। তবে কারা এই চক্রান্তের পিছনে সেটাই ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের। যে কারণে তারা জেরা করতে চাইছে ধৃত নাবালকদের। এই সব নাবালকরা পাথর ছোঁড়ার কাজ করছিল। কাদের কথায় এরা পাথর ছুঁড়েছে, তার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা চলছে। কিশোরদের জেরা করে মূল চক্রীদের কাছে পৌঁছনো যাবে বলে মনে করছে রাজ্য পুলিশ।
রহস্য তৃণমূল প্রতিনিধিদের আচরণে
যেখানে এই তাণ্ডব চলেছে, তার আশেপাশেই বাস করেন তৃণমূল সাংসদরা। থাকেন বিধায়করাও। কিন্তু তাঁরা ঘটনার আগাম কোনও আঁচ পাননি বলে দাবি করেছেন। বিরোধীদের প্রশ্ন, এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? জমিতে পাঁচিল দিতে গেলে যেখানে খবর পৌঁছে যায় প্রতিনিধিদের কাছে, সেখানে এত বড় হিংসার কোনও আগাম আঁচ পেলেন না তাঁরা?
জঙ্গিপুরের সাংসদ খলিলুর রহমান, সাগরদিঘির বিধায়ক বায়রন বিশ্বাস, ফরাক্কার বিধায়ক মনিরুল ইসলাম তিনজনেরই বাড়ি রতনপুরে। সামশেরগঞ্জের বিধায়ক আমিরুল ইসলামের বাড়ি পুঁটিমারি। ওয়াকফ আন্দোলনের নামে যে তাণ্ডবলীলা চলেছিল, তা কিন্তু এই এলাকার আশপাশেই। তাহলে কেন খোঁজ ছিল না? প্রশ্ন উঠছে তৃণমূলের এই জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা নিয়েও। শুধুমাত্র বহিরাগত বলে গোটা পরিস্থিতিকে ‘লঘু করার চেষ্টা’ হলেও আদতে জনসংযোগের ব্যর্থতা যে রয়েছে তা কিন্তু ঘনিষ্ঠতম মহলে মেনে নিচ্ছেন নিজেরাই। বায়রন বলছেন, “আমরা আগে থেকে আঁচ করতে পারিনি। আগে থেকে খবর পেলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না। কিন্তু বিন্দুমাত্র খবর পাইনি। বড় শিক্ষা হল এটা থেকে। আর যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখব।”
এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিন দলীয় কর্মীদের সতর্ক থাকার বার্তা দিচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা। তবে চিন্তা যে রয়ে যাচ্ছে, এটা অস্বীকার করছেন না তাঁরাই। ত্রুটির জায়গাটা ঠিক কোনখানে, সেটাই গত ৮-১০ দিনেও বুঝে উঠতে পারলেন না জনপ্রতিনিধিরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে দলীয় নেতৃত্বের প্রশ্নের মুখে গোটা পর্বই যে যথেষ্ট অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে সেটাই ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন জনপ্রতিনিধিরা। খলিলুর রহমান যেমন বলছেন, “আমাদেরও সন্দেহ চক্রান্ত হয়েছে। আমরা প্রশাসনকে জানিয়েছি কারা এটা করেছে তাঁদের খুঁজে বের করা হোক। আমরা এটা কখনও দেখিনি। আমাদের আগামী প্রজন্ম যাতে সুনাগরিক হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে সর্বতভাবে এটা আটকাতে হবে।”
নীচের স্তরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে তৃণমূল?
ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতা মানছেন অনেকে। অনেকে বলছেন পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কথা। তবে এখানেই উঠে আসছে শাসক দলের ভূমিকা। তাদের জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, ঘূণাক্ষরেও জানতে পারেননি এমন ঘটনা ঘটতে চলেছে। তাহলে কি নীচের তলায় নিয়ন্ত্রণ একেবারেই হারিয়েছে তৃণমূল? নাকি জেনেশুনেই এমন কাণ্ড ঘটাতে ইন্ধন দিয়েছে তারা? কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর মতে, ওই অঞ্চলে লোকসভা ভোটে ইশা খান চৌধুরী জেতায় সমীকরণ বদালতে চাইছে শাসক। তাই এই হিংসা ছড়ানোর চক্রান্ত। শাসক দল অবশ্য তাঁর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। দু দলের চাপানউতোরের মধ্যে একটা সত্য সামনে আসছে। গত লোকসভা নির্বাচনে দক্ষিণ মালদহ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সামশেরগঞ্জ বিধানসভায় প্রায় ১৫ হাজার ভোটে বাম কংগ্রেস জোট প্রার্থী থেকে পিছিয়ে ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। এমনকি, লোকসভা নির্বাচনের ফলের ভিত্তিতে ধুলিয়ান পুরসভা এলাকায় তৃণমূল ছিল তৃতীয় স্থানে। শাসক দলের সেই খারাপ ফল আর এবারের হিংসা, সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে এলাকাবাসীর মনে।
দুর্গত এলাকায় রাজ্যপাল
পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে হিংসা কবলিত এলাকায় যান রাজ্যপাল। নয়া ওয়াকফ আইন নিয়ে অশান্তির জেরে মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জ, সুতি এবং ধুলিয়ানের অনেক বাসিন্দা গঙ্গা পেরিয়ে ও পারে মালদহে আশ্রয় নিয়েছেন। শুক্রবার তাঁদের সেই শিবিরে গিয়েছিলেন রাজ্যপাল। শনিবার তিনি যান মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জের উপদ্রুত এলাকায়। সেখানে তিনি দুই নিহতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। নিহত বৃদ্ধের স্ত্রী রাজ্যপালকে জানান, তাঁরা খুবই আতঙ্কে রয়েছেন। অশান্তির সময় তাঁদের বাড়িতে লুটপাট চলেছে। তাঁদের দাবি, নিরাপত্তার স্বার্থে এলাকায় বিএসএফের স্থায়ী ক্যাম্প বসানো হোক। স্থানীয়দের সঙ্গেও কথা বলেছেন রাজ্যপাল। সকলের অভিযোগ শোনার পর তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে কিছু অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা যাতে সরাসরি ফোন করতে পারেন, সেই নম্বর দেওয়া হয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠাই প্রধান লক্ষ্য। রাজ্য সরকারকে বলব, উপযুক্ত পদক্ষেপ করুন।’’
আসরে জাতীয় মহিলা কমিশন
রাজ্যপালের পাশাপাশি আক্রান্ত এলাকা ঘুরে দেখেন জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিরাও। তাঁদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন আক্রান্ত হিন্দুরা। একেবারে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সামসেরগঞ্জের মহিলারা বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে বাস করছি মনে হচ্ছে।আতঙ্কে আছি। এভাবে ওরা মারবে! হামলার বিবরণ দিতে গিয়ে শিউড়ে উঠছিলেন তাঁরা। তাঁরা বলেন, পুলিশের ওপর আস্থা নেই। এলাকায় ক্যাম্প তৈরি করে থাকুক বিএসএফ। এর জন্য নিজেদের জমি ছেড়ে দিতেও রাজি তারা।
ধুলিয়ানের বাসিন্দারা জাতীয় মহিলা কমিশনকে জানান, আতঙ্কে ঘুমতে পারছি না। অবিলম্বে এলাকায় বিএসএফ ক্যাম্প তৈরি করা হোক। শুধু তাই নয়, পুরো ঘটনায় এনআইএ তদন্তের দাবি জানান গ্রামের মানুষজন। মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, পুরো বিষয়টি তাঁরা দেখছেন। সেই মতো রিপোর্ট দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং গোটা দেশের মানুষ আক্রান্তের পাশে আছে বলেও এদিন জানান কমিশনের প্রতিনিধিরা। একই সঙ্গে অমিত শাহ গোটা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে বলেও মন্তব্য করেন।
হিন্দু হওয়াটাই অপরাধ? শান্তি প্রার্থনা
আশ্বাস মিলছে রাজ্যপালের। আশ্বাস মিলছে কেন্দ্রীয় দলের প্রতিনিধিদের কাছে। কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদের জাফরাবাদের মহিলারা স্বস্তিতে থাকতে পারছেন না। একটা আতঙ্ক ক্রমশ তাড়া করে ফিরছে তাদের। গত কয়েকদিনে যেভাবে বর্বর হামলার মুখোমুখি হয়েছেন তাঁরা, তা যেন গ্রাস করে আছে তাঁদের। আর তাই বলছেন, হিন্দু হওয়াটাই কি অপরাধ? রাজ্যপালের পা ধরে প্রার্থনা করছেন বিচারের। সব মিলিয়ে জাস্টিস চাই স্লোগানে কাঁদছে মুর্শিদাবাদের আকাশ বাতাস। পশ্চিমবাংলার মধ্যে কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হল, তা নিয়ে ভেবে পাচ্ছেন না কেউই। সকলেই আকুল অপেক্ষা করছেন এক টুকরো শান্তির।