নিউজ ডেস্ক: চাকরি বাতিল নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তাল রাজ্য-রাজনীতি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাশে থাকার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের একাংশ পথে নেমেছিলেন, ডিআই অফিসে বিক্ষোভ করেছেন। ২১ এপ্রিল নবান্ন অভিযানের ডাকও দিয়েছিলেন তাঁরা। তবে আপাতত নবান্ন অভিযান স্থগিত রাখছেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। অন্যদিকে আজ সোমেই যোগ্য-অযোগ্যদেরা তালিকা প্রকাশ করার কথা এসএসসি’র। শোনা যাচ্ছে, পরীক্ষার্থীদের সংখ্যাটা যেহেতু ২২ লক্ষ, তাই দুই পর্যায়ে প্রকাশ হতে পারে। ওএমআর শিটও দেখানো হবে বলে এসএসসি সূত্রে খবর।
অন্যদিকে আজ সোমবার চাকরিহারা শিক্ষকদের এসএসসি ভবন অভিযান। সকাল থেকেই প্রস্তুতি শুরু। রাত থেকেই বিভিন্ন জেলার চাকরিহারারা শহরে আসতে শুরু করেছেন। ধর্মতলায় ওয়াই চ্যানেলে রয়েছেন একাংশ। অনেকে আবার সকালে ঢুকবেন কলকাতায়। এই অভিযান নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পারদ চড়ছে। যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ ২০১৬-র ফেসবুক পেজে নানা রকম পোস্ট দেখা গিয়েছে এই অভিযান ঘিরে।
চাকরিহারাদের একটা বড় অংশের দাবি, তাঁরা নতুন করে পরীক্ষায় বসবেন না। বরং, এসএসসি যোগ্য-অযোগ্যর তালিকা প্রকাশ করুক। তাঁদের বক্তব্য, এসএসসি-কেই ‘টেন্টেড’ (যোগ্য) আর ‘আনটেন্টেড’ (অযোগ্য) তালিকা প্রকাশ করতে হবে। ‘নট স্পেসিফিক্যালি টেন্টেড’ বললে চলবে না। এই সমস্ত দাবিকে সামনে রেখেই কমিশনের উপর চাপ বাড়াতে আজ চাকরিহারাদের এসএসসি অভিযান।
তবে এই দুর্নীতির শুরু ঠিক কোথা থেকে?
২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এসএসসি-তে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই বছরই ২৭ নভেম্বর ওএমআর শিটে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর দু’বছর পর ২০১৮ সালের ১২ মার্চ প্রকাশ করা হয় চূড়ান্ত প্যানেল। ২৮ অগস্ট প্রকাশিত হয় প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের মেধাতালিকা। ২০১৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষক হিসাবে চাকরি পান নির্বাচিতেরা। এরপর ২০১৬ সালের সেই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০২১ সালে। কলকাতা হাই কোর্টে দায়ের হয় একগুচ্ছ মামলা। অভিযোগ ওঠে, গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মী, নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগে যথেচ্ছ দুর্নীতি হয়েছে। তারপর থেকে জল গড়িয়েছে অনেকদূর।
২০২১ সালে ওই সংক্রান্ত একটি মামলায় প্রথম সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তার পরের দু’বছরে নিয়োগ দুর্নীতির প্রায় ১০টি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। সিবিআইয়ের তদন্তের পাশাপাশি ‘বেআইনি নিয়োগ’ বাতিল করারও নির্দেশ দেন প্রাক্তন বিচারপতি।
এরপর ২০২২ সাল থেকে এই সংক্রান্ত তদন্ত করছে সিবিআই। আদালতে তারা একাধিক চার্জশিট জমা দিয়েছে। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ অনেক ‘প্রভাবশালী’র নাম এসেছে সেই সমস্ত চার্জশিটে। চার্জশিটে এসএসসি-র তিন উচ্চপদস্থ কর্তা এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের এক কর্তার নাম বার বার উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তারা হলেন, শান্তিপ্রসাদ সিন্হা, সুবীরেশ ভট্টাচার্য, অশোক সাহা ও কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়। ওএমআর শিটের তথ্য নষ্ট থেকে শুরু করে অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ, নম্বরে কারচুপি— এসএসসি মামলায় শুরু থেকেই এই চার জনের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের অভিযোগ ভূরি ভূরি। আপাতত তাঁরা প্রত্যেকে জেলে। অনেকের মতে, চাকরি বাতিল এবং সেই সংক্রান্ত যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তার মূলে এই চার জন।
শেষমেশ ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর শীর্ষ আদালতের বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু এবং বিচারপতি বেলা এম ত্রিবেদীর বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি একটি বিশেষ বেঞ্চ গঠন করবেন। সেখানেই এসএসসির নিয়োগ দুর্নীতির যাবতীয় মামলার শুনানি হবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির বিশেষ বেঞ্চে এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলার শুনানি শুরু হয় কলকাতা হাই কোর্টে। জানুয়ারি থেকে মার্চ, এই তিন মাসে মোট ১৭টি শুনানি হয় বিশেষ বেঞ্চে।
২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ রায় দেয়, ২০১৬ সালের ওই নিয়োগপ্রক্রিয়া সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ এবং ১৬-র লঙ্ঘনকারী। তাই পুরো নিয়োগপ্রক্রিয়াই বাতিল করা হবে। অর্থাৎ, চাকরি যাবে ২৫,৭৫৩ জনের। পাশাপাশি, জনসাধারণের দেখার জন্য সমস্ত ওএমআর শিট স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের যুগান্তকারী রায়
এরপর ২০২৪ সালের ২৪ এপ্রিল, হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চের রায় ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য। ২৯ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চে মামলাটি শুনানির জন্য ওঠে। পৃথক ভাবে শীর্ষ আদালতে মামলা করে রাজ্যের শিক্ষা দফতর, এসএসসি এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। দফায় দফায় মামলা করেন চাকরিহারারাও। তবে শেষমেশ ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানি শেষ হয় প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চে। সম্প্রতি ওই মামলাতেই রায় ঘোষণা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার জনের নিয়োগ।
আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, যোগ্য ও অযোগ্যদের বাছাই করা যায়নি। সেই কারণেই প্রায় সম্পূর্ণ প্যানেল বাতিল করে দেওয়া হল। এরপর থেকেই কার্যত রাস্তায় রাস্তায় দিন কাটছে চাকরিহারাদের। নিজেদের হকের চাকরি পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে ফেরত পাওয়ার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন ‘যোগ্য’ চাকরিহারারা। একের পর এক কর্মসূচি পালন করে চলেছেন তাঁরা।
আর চাকরি বাতিলের এই নির্দেশের পরেই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তাল রয়েছে রাজ্য-রাজনীতি। তবে এসএসসির ২০১৬ সালের নিয়োগ প্যানেল অনুসারে ‘দাগি’ নন এমন শিক্ষকেরা আপাতত স্কুলে যেতে পারছেন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। যদিও শিক্ষাকর্মীদের জন্য পূর্বের রায়ই বহাল রয়েছে। এই অবস্থায় সোমবার এসএসসি ‘যোগ্য-অযোগ্য’দের তালিকা প্রকাশ করার কথা। প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর থেকেই চাকরিহারারা দাবি তুলছিলেন, যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করা হোক। এই দাবিতে গত ১১ এপ্রিল বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের প্রতিনিধিরা। এসএসসি চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থও ছিলেন বৈঠকে। ওই দিন বৈঠক থেকে বেরিয়ে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছিলেন, ২১ এপ্রিলের মধ্যে ‘যোগ্য’ এবং ‘অযোগ্য’দের তালিকা প্রকাশের বিষয়ে তাঁরা আশ্বাস পেয়েছেন। তাঁরা আরও জানান, বিকাশ ভবনের বৈঠকের পরে জানানো হয়েছিল, ওএমআরের প্রকৃত মিরর ইমেজ নেই। যদি সেটি থাকত, তবে সিবিআই তা খুঁজে পেত। তাই সিবিআইয়ের কাছে যে প্রতিলিপি আছে, সেটিই প্রকাশ্যে আনা হবে।
দুর্নীতির ফলে ভুক্তভুগি চাকরিহারাদের পরিবার ও স্কুলগুলি
তবে এই গোটা দুর্নীতির ফলে ভুক্তভুগি হচ্ছে চাকরিহারাদের পরিবার ও স্কুলগুলি। বিশেষত উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলি। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে এমন অনেক নতুন বিষয় পড়ানো হয়, যেগুলি মাধ্যমিকে পড়ানো হয় না। সেই সব বিষয়ের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে এক জন করে শিক্ষকই সাধারণত নিযুক্ত থাকেন। অনেক স্কুলেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নির্দিষ্ট বিষয়ের এক জন মাত্র শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। সে সব স্কুলে পড়ুয়াদের ওই বিষয়গুলি কী ভাবে পড়ানো হবে, এখন সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যের স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পড়াতেন এমন শিক্ষকদের চাকরি শীর্ষ আদালতের রায়ে বাতিল হওয়ার প্রভাব পড়তে পারে প্রায় ৩,১২৫টি স্কুলে। নবম-দশম স্তরে পড়াতেন এমন শিক্ষকদের চাকরি বাতিলের প্রভাব পড়তে পারে ৫,৪২৬টি স্কুলে। গ্রুপ সি কর্মীদের চাকরি বাতিলের জের পড়তে পারে ২,২১৫টি স্কুলে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে গ্রুপ ডি কর্মীদের চাকরি বাতিলের প্রভাব ৩,৮৮৫টি স্কুলে পড়তে পারে বলে স্কুলশিক্ষা দফতর সূত্রে খবর।