নিউজ ডেস্ক: মুর্শিদাবাদে আক্রান্ত হিন্দুরা। ওয়াকফ বিরোধিতার নামে সেখানে আগুন জ্বালিয়েছে কিছু দুর্বৃত্ত। মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন অনেকে। বেশিরভাগ হিন্দুই বাঁচার তাগিদে নদী পেরিয়ে মালদায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরিস্থিতি দেখে সেখানে ছুটে গেছেন রাজ্যপাল। ছুটে গেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন থেকে জাতীয় মহিলা কমিশন। বিজেপি নেতাদের অভিযোগ, সেখান যা হয়েছে তা আসলে, দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের পার্ট টু। কিন্তু এই ক্যালকাটা কিলিংয়ের ঘটনাটা আসলে কী?
ক্যালকাটা কিলিং…
সময়টা স্বাধীনতার আগের। ১৯৪৬ সাল। বাংলায় তখন সুরাবর্দীর সরকার। দেশে ৪০ কোটি নাগরিকের মধ্যে ১০ কোটি মুসলিম। এর মধ্যে বেশিরভাগই বাংলা ও পাঞ্জাবে। অখন্ড বাংলায় মুসলিমদের সংখ্যা সামান্য বেশি ছিল। হিন্দুরা ছিল ৪৭ শতাংশ। মুসলিম প্রায় ৫২ শতাংশের ওপর। এই প্রেক্ষিতেই প্রাদেশিক সরকার তৈরি করে মুসলিম লিগ। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। চার্চিলের পর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ক্লেমেন্ট অ্যাটলি। সিদ্ধান্ত হয়েছে, ১৯৪৮ সালের মধ্যে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে। কিন্তু কীভাবে এই কাজটা হবে, কতটা মসৃণভাবে করা যাবে, তার জন্যই চলছে আলোচনার পর আলোচনা। নেহেরুর নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেখানে মুসলিম লিগ কখনও ঢুকছে, কখনও বেরোচ্ছে। বলা চলে, সরকার গঠন নিয়ে খেলা করছে। এই পরিস্থিতিতেই ১৯৪৬ সালের ৭ এপ্রিল দিল্লিতে ৩ দিনের কনভেনশনের ডাক দেন জিন্না। সেখানে ডাকা হয় লিগপন্থী সমস্ত কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রাদেশিক নেতাদের। বাংলা থেকে যোগ দিতে যাওয়ার জন্য একটা গোটা ট্রেনেরই ব্যবস্থা করে ফেলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দী।
ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে…
এই কনভেনশন থেকেই ১৬ আগস্ট দেশজুড়ে ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেন জিন্না। স্লোগান ওঠে, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। মানে, যে কোনও ভাবেই হোক আদায় করতে হবে পাকিস্তান। ডায়রেক্ট অ্যাকশন প্ল্যান ডাক দেওয়াই নয়, সেই মতো প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে এর উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ১৬ আগস্ট সরকারি ভাবে ছুটি ঘোষণা করেন তৎকালীন অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী। ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্র আজাদের সম্পাদকীয়তে লেখা হল, ১৬ আগস্ট থেকে পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধ শুরু হবে। মৌলানা আক্রম খান পবিত্র রমজান মাসে কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার দায়িত্ব স্মরণ করালেন। আর শুক্রবার নমাজের দিন ময়দানে জমায়েতের ডাক দিল মুসলিম লিগ।
উত্তপ্ত ধর্মতলা চত্বর…
১৫ আগস্ট থেকেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হল ধর্মতলা সহ কলকাতা জুড়ে। মুসলিম যুবকরা দল বেঁধে প্রচার করতে লাগলেন দোকান বন্ধের জন্য। শোনা গেল হুমকিও। এভাবে পরিস্থিতি যখন চরম উত্তেজনাকর, তখন ১৬ তারিখ দর্শকের ভূমিকা পালন করল পুলিশ। বলা ভালো, তাকে নিষ্ক্রিয় রেখে দিল সুরাবর্দীর মুসলিম লিগ সরকার। এর ফল হলো মারাত্মক। কলকাতা জুড়ে শুরু হল হিংসা।
দুপুর ২টোর দিকে সমাবেশ শুরু হয়, যদিও দুপুরের নামাজের পর থেকেই কলকাতার সব জায়গা থেকে মুসলমানদের মিছিল জড়ো হতে শুরু করেছিল। অংশগ্রহণকারীদের একটি বিশাল অংশ লোহার রড ও লাঠি হাতে ছিল বলে জানা যায়। একজন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তার প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ৩০,০০০ জন এবং কলকাতা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শকের তথ্য অনুযায়ী ৫০০০০ জন সমাবেশে উপস্থিত ছিল বলে অনুমান করা হয়েছিল। পরবর্তী পরিসংখ্যানটি অসম্ভব বেশি ছিল এবং স্টার অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদক এই সংখ্যাকে প্রায় ১,০০,০০০ বলে উল্লেখ করেছিল। সঠিক সংখ্যা যাই হোক, সংখ্যাটা ছিল গোলমাল পাকানোর জন্য যথেষ্ট। প্রধান বক্তা হিসাবে খাজা নাজিমউদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোরাবর্দী ছিলেন। তাঁরা সেই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মুসলিম জনতাকে যথেষ্ট উত্তেজিত করলেন, গর্জন উঠতে থাকল সভা থেকে।
কলকাতা পুলিশের বিশেষ শাখা সভায় একজন মাত্র শর্টহ্যান্ড সাংবাদিককে প্রেরণ করেছিল, ফলস্বরূপ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের কোনও প্রতিলিপি পাওয়া যায়নি। তবে সামরিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিযুক্ত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও প্রতিবেদক ফ্রেডেরিক বারোজ জানিয়েছিলেন, সোরাবর্দীর প্রাথমিক প্রচেষ্টা ছিল – যাতে কোনো পুলিশ এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে। তিনি সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে আটকাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডের রিপোর্ট…
সেই সময়ের হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড কাগজের প্রথম পাতায় খবরে দেখা যাচ্ছে, তিন দিনের হিংসায় ২ হাজার জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৮ হাজার জন। সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে কয়েক কোটি টাকার। হাসপাতালে যেসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছিলেন এবং রেড ক্রস সূত্রে এই খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হল, অনেকেই সেদিন হাসপাতালে যেতে পারেননি। রাস্তায় পড়ে মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের।
১৬ আগস্ট সকাল দশটা পর্যন্ত সব কিছু শান্তই ছিল। ৩০ আগস্টের পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে জানা যাচ্ছে, আড়াইশ-তিনশ জন মুসলিম আচমকা হামলা শুরু করে চোরবাগান এলাকায়। লাঠি, ছুরি, কুকরি নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই এলাকায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ১৮ বছরের ছেলেকে কুপিয়ে মারে। এরপর এগিয়ে যায় মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের দিকে। সেখান থেকে ফিরে এসে একটি ধরমশালায় ঢুকে ৬ জনকে কুপিয়ে মারে। চলে নির্বিচারে লুঠপাট।
হ্যারিসন রোড ও ধর্মতলা স্ট্রিটে কয়েক হাজার দোকান ও বাড়িতে লুঠপাট করা হয়। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় সেখানে। সোনার দোকান থেকে সবকিছু লুঠ করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। খবরের কাগজ থেকে জানা যাচ্ছে, সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার দোকান ও বাড়িতে আগুন লাগানো হয়। ক্ষতি হয় প্রায় ৫ কোটি টাকা।
১৬ আগস্ট নরসংহারের সবচেয়ে বড় ছবি পাওয়া যায় মেটিয়াবুরুজে। সেখানে ৬০০ জন হিন্দু খুন হন। তাদের বেশিরভাগই ওড়িয়া। তারা থাকতেন কেশোরাম কটন মিলের পিছনে। লিচুবাগানে। সকলেই শ্রমিক।
যা জানা যায়, ১৬ আগস্ট বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দী পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে ছিলেন। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায় পুলিশের। থানাতেও আক্রমণ শুরু হয়। পুলিশের সঙ্গে হিংস্র জনতার খণ্ডযুদ্ধ বাধে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার , এই জ্বলন্ত পরিস্থিতিতেও সেনা নামানো হয়নি।
আক্রান্ত হয়ে পাল্টা মার…
অবশেষে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে হিন্দুরাও আত্মরক্ষার জন্য জায়গায় জায়গায় সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করে। এই সময় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন গোপাল মুখোপাধ্যায়। যিনি এলাকায় পরিচিত গোপাল পাঁঠা নামে। বউবাজার এলাকায় তাঁদের পারিবারিক মাংসের দোকান ছিল। তাই ওই নামেই সবাই তাঁকে চিনত। তাঁর কাকা ছিলেন বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির অনুগামী অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ছোটবেলা থেকেই নেতাজি সুভাষ, অরবিন্দ ঘোষের গুণমুগ্ধ ছিলেন গোপাল। শরীর গঠনের জন্য তাঁদের একটি দলও ছিল। নাম ভারত জাতীয় বাহিনী। তিনি যখন দেখেন, মুসলিম লিগের পোশা গুণ্ডা মীনা পেশোয়ারি, বোম্বাইয়ার মতো দাঙ্গাবাজরা এলাকায় হিন্দুদের কচুকাটা করছে, তখন দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন গোপাল। একজন হিন্দু মারা গেলে ১০ জন মুসলিমকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাঁকে নিরস্ত হওয়ার ডাক দেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু গোপাল বলেন, আগে দাঙ্গা বন্ধ হোক, তারপর তিনি চুপ করবেন। তাঁর একরোখা মানসিকতার কাছেই হার মানে দাঙ্গাবাজরা। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে সেনা নামানোর জন্য আর্জি জানান স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দী। তবে তার আগেই হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। কলকাতা ছাড়েন অসংখ্য লোক। এই দাঙ্গাকেই গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং বলে অভিহিত করা হয়। মুলত তাঁদের এই রুখে দাঁড়ানোতেই থমকে যায় মুসলিম লিগ। থমকে যায় ইংরেজ সরকারও।
আসরে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়…
মুসলিম লিগ প্ল্যান করেছিল, কলকাতা সহ গোটা বাংলাকেই পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার। কিন্তু সেসময় রুখে দাঁড়িয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। হিন্দুদের জন্য আলাদা হোমল্যান্ডের দাবি করেছিলেন তিনি। এই উদ্যোগে সামিল হন অনেকেই। শেষে হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ তৈরি হয়। তবে চিরকালের জন্য বাংলার বুকে ঘা রেখে যায় ১৬ আগস্টের দাঙ্গা। যেদিন মুসলিমদের জন্য পৃথক দেশের দাবি তুলে নিধন যজ্ঞে সামিল হয় এক শ্রেণির গুণ্ডা। আর তাতে সরাসরি প্ররোচনা দেয় শাসক পক্ষ। নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে মানুষ খুন করতেও যারা পিছপা হয় না।
আজকের মুর্শিদাবাদ…
সেদিনের খুনোখুনির পর আজকের মুর্শিদাবাদ। স্বাধীনতার আগে একটা ছুতো খুঁজে যেভাবে হিন্দুদের ওপর আচমকা হামলা হয়েছিল, এবার মুর্শিদাবাদের সুতি, শামসেরগঞ্জ, ধুলিয়ানেও যেন সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। একের পর এক দোকানে যেভাবে হামলা করা হয়েছে, যেভাবে খুন করা হয়েছে ২ জনকে, যেভাবে হিন্দুদেরকে শাসানো হয়েছে, তার পিছনে পরিকল্পিত চক্রান্তের ইন্ধন দেখছেন গোয়েন্দারা। বিজেপির মতে, দেশভাগের দাবি তুলে স্বাধীনতার আগে যেভাবে অশান্ত করা হয়েছিল কলকাতাকে, সেভাবেই সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরোধিতার নামে পশ্চিমবঙ্গকে ফের ভাগ করার চক্রান্ত হয়েছে। আর এই হামলার সময় চুপ করে বসে থেকে তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে খোদ পুলিশ। এ যেন সেই সোরাবর্দী সরকারেরই প্রতিচ্ছবি। বিজেপির এই দাবি সম্পর্কে আপনাদের কী মনে হয়, লিখে জানান আমাদের।