নিউজ ডেস্ক: নয়া ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের কিছু জায়গায় হিংসার ঘটনা হয়েছে। এই নিয়ে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন আইনজীবী বিষ্ণুশঙ্কর জৈন। সোমবার সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি গবইয়ের বেঞ্চে মামলাটি শুনানির জন্য ওঠে। তখনই বিচারপতি মন্তব্য করেন যে, এমনিতেই তাঁদের বিরুদ্ধে ‘প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ঢুকে পড়ার’ অভিযোগ উঠেছে। তাই পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি নিয়ে নির্দেশ দেবেন না।
সম্প্রতি ওয়াকফ সংশোধনী আইন প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয় মুর্শিবাদের জঙ্গিপুর, ধুলিয়ান, সামশেরগঞ্জ, সুতিতে। তবে সেই বিক্ষোভ ‘গুন্ডামি’তে পরিণত হয়। ভাঙচুর চালানো হয় পুলিশের গাড়ি, সরকারি সম্পত্তি, সাধারণ মানুষের বাড়িতে। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়। তার মাঝেই বাড়িতে টেনে গিয়ে বাবা-ছেলেকে খুনের ঘটনা ঘটে। ইতিমধ্যেই হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে সামশেরগঞ্জ থেকে ২২জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। নতুন করে উত্তেজনার খবর আসেনি বলেই জানিয়েছে তারা।
মুর্শিদাবাদ ছাড়াও রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, জঙ্গিপুর, হুগলির চাপদানি, লালগোলা সহ কলকাতার পার্ক সার্কাস, আমতলায় বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। পার্ক সার্কাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেছেন কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা।
মুর্শিদাবাদের এই হিংসার ঘটনায় সুকান্ত মজুমদার বলেন, “কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের পর মুর্শিদাবাদের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে, তবে এখনও এমন নয় যে হিন্দুরা মাথা উঁচু করে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারছেন। যারা মুর্শিদাবাদ ছেড়ে মালদহে উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছেন, তারা এখনও ফিরতে প্রস্তুত নন।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশের লাইট ভার্সনে পরিণত করতে সফল হয়েছেন। বাংলার হিন্দুরা বুঝে গিয়েছেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোষণ নীতি রাজ্যকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।”
কিন্তু বাংলায় এমন হিংসার ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও একাধিকবার রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় জ্বলে উঠেছে হিংসার আগুন।
উত্তপ্ত ভাঙড়ের শোনপুর বাজার
সম্প্রতি পুলিশ সঙ্গে আইএসএফ সমর্থকদের খণ্ডযুদ্ধে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভাঙড়ের শোনপুর বাজার। জানা গিয়েছে, মুর্শিদাবাদের পাশাপাশি কলকাতার রামলীলা ময়দানে ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদে আইএসএফ এর সভায় যোগদান করতে আসছিলেন ভাঙড় ও লাগোয়া এলাকার দলীয় কর্মীরা। পথে তাঁদের বাধা দেয় পুলিশ। এরপর আইএসএফ বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকি ভাঙড়ের শোনপুর বাজারে সভা হবে বলে জানান। নওসাদের নির্দেশে শোনপুর বাজারে জমায়েত করতে থাকেন আইএসএফ সমর্থকরা। বিধায়ক সেখানে পৌঁছনোর কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীরা। পুলিশের গাড়ি ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর শুরু করে তারা। পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যান ভাঙচুর চালিয়ে উলটে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় পুলিশের বেশ কয়েকটি গাড়ি। এমনকী পুলিশকর্মীদের ওপরও বেলাগাম হামলা হয়। পেরেক পোঁতা বাঁশ দিয়ে পুলিশকর্মীদের মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। পরে বিশাল পুলিশবাহিনী এলাকায় পৌঁছয়। ততক্ষণে এলাকা ছেড়েছে হামলাকারীরা।
সিএএ পরবর্তী হিংসা
ওয়াকফ বিক্ষোভভেআগে সিএএ আন্দোলনের সময়ও বাংলার মুর্শিদাবাদে হিংসা ছড়িয়েছিল। ২০২৪ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) নিয়মাবলীর একটি ধারা সংশোধন করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। আর এর ফলেই রাজ্য জুড়ে জ্বলে উঠেছিল হিংসার আগুন। কোথাও রাস্তা অবরোধ তো কোথাও প্রতিবাদ মিছিল। নিঃশর্ত নাগরিকত্বের দাবিতে উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা থানার সামনে শ্রীশ্রী শান্তিহরি-গুরুচাঁদ ফাউন্ডেশনের তরফে টায়ার জ্বালিয়ে যশোর রোড অবরোধ করা হয়। একইসঙ্গে বনগাঁ শহরে ১ নম্বর রেলগেট এলাকাতেও যশোর রোড অবরোধ করা হয়। অশান্ত হয়ে উঠেছিল নবাব নগরীও।
ভোট পরবর্তী হিংসা
এসব ছাড়াও প্রতি ভোটের পরই বাংলায় লেগেই থাকে ভোট পরবর্তী হিংসা। গতবছর উপনির্বাচন শেষ হতেই ভোট পরবর্তী হিংসার একাধিক অভিযোগ সামনে এসেছিল। অভিযোগ, উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ায় রাতের অন্ধকারে বিজেপি প্রার্থীর চাষের জমিতে দুষ্কৃতীরা হামলা চালায়। কেটে দেওয়া হয় পাঁচ বিঘা জমির কলমের আমগাছ। ট্রাক্টর এবং শ্যালো মেশিনেও ভাঙচুর চালানো হয় বলে অভিযোগ। পরাজিত বিজেপি প্রার্থী বিমল দাস হাড়োয়া থানায় ঘটনা নিয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অন্যদিকে, ২০২১ সালের ২ মে, বিধানসভা ভোটের ফলপ্রকাশের দিনই নিজের বাড়ির সামনে খুন হয়েছিলেন বিজেপি নেতা উত্তম ঘোষ। ভোট পরবর্তী হিংসার মামলায় ছ’জন তৃণমূল কর্মীকে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। তাঁর পরিবারের সদস্যদের মারধর করারও অভিযোগ আসে পরিবারের তরফে, রাজনৈতিক কারণে উত্তমকে খুন করেছেন শাসকদলের কর্মীরা এমনই দাবি করে পরিবার।
উল্লেখ্য, ২০২১ এর বিধানসভা ভোটের পর যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েকজন বিজেপি কর্মীদের মৃত্যুর ঘটনা সামনে এসেছিল, প্রায় সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হয়েছে ২০২৪-এর ভোটের পরেও। ভোটের পর কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থাকলেও, পরিস্থিতির অবনতি হওয়া আটকাতে সেই বাহিনীকে ঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না, এমনই অভিযোগ ছিল বিরোধীদের।
বোর্ড গঠন ঘিরে হিংসা
তবে শুধু ভোট পরবর্তী হিংসাই নয়, রাজ্যে বোর্ড গঠন ঘিরে হিংসার উদাহরণও কিছু কম নেই। পুরুলিয়া, মালদহ, বীরভূম, নদিয়া, উত্তর দিনাজপুরের পর উত্তর ২৪ পরগনা। পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনকে কেন্দ্র করে রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক হিংসা অব্যাহত। ২০১৮ সালে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার আমডাঙায় গুলি করে খুন করা হয় সিপিএম নেতা মোজাফফর পিয়াদাকে। হিংসায় আহত হয় আরও দশজন। পুরো ঘটনায় অভিযোগের তির তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে।
এ ঘটনায় সিপিএমের অভিযোগ, যেনতেন উপায়ে পঞ্চায়েতের বোর্ড দখল করতে তৎপর তৃণমূল কংগ্রেস। সেই উদ্দেশ্যে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা এলাকায় ব্যাপক বোমাবাজি করেছিল বলে অভিযোগ। সন্ধ্যা হতেই বহিরাগত দুষ্কৃতীদের সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব হামলা চালায় মোজাফফরের বাড়িতে। গুলি করে খুন করা হয় এই সিপিএম নেতাকে। তবে হামলা চালিয়ে পালানোর সময় গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়ে আগ্নেয়াস্ত্র সহ দুই বহিরাগত দুষ্কৃতী। তাদের গণপিটুনি দেয় গ্রামের মহিলারা।
রাজনৈতিক রক্তপাতের সূচনা
১৯৯৭ সাল। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে কার্যত স্বীকার করে নেওয়া হয় রাজনৈতিক খুনের কথা। জানা যায়, শুধুমাত্র বিধানসভা নির্বাচন ঘিরেই ১৯৭৭ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ২৮,০০০ রাজনৈতিক খুন হয়েছে। অর্থাৎ বছরে প্রায় ১,৪০০টি খুন। দিনে প্রায় চারটি। বাম জমানা গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এসেছে। কিন্তু তবুও রাজনৈতিক হিংসা আর খুনোখুনি যেন বিরাম পায়নি। ক্রমেই বেড়েছে এই সংস্কৃতি। খেলা হবে স্লোগান, দেখে নেওয়ার হুমকি বা বিরোধী শিবিরগুলির নানা নজর কাড়া পাঞ্চলাইন- বঙ্গ রাজনীতির প্রতিটি অধ্যায় যেন রক্তে রাঙা। তাই এই হিংসাত্মক অধ্যায়ের একটা শেষ দরকার।
সামনেই বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে এই বিষয়টি কোথাও যেন নাড়া দেয়। তবে বাংলার রাজনীতি আর এই খুনোখুনির ঘটনা কিন্তু ষাট-সত্তরের দশক থেকে আজও বর্তমান। তা সে প্রকাশ্যে যাদবপুরের উপাচার্য খুন হোক বা নৃশংস সাঁইবাড়ির হত্যাকাণ্ড। এখানেই শেষ নয়। মারিচঝাপি হামলা, কালিম্পং হামলা, নানুর হামলা- তালিকাটা অনেকটাই দীর্ঘ। বিজন সেতুর জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ভোলেনি কেউ। কিন্তু কোনওটিতেই তেমন কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। ২০১৮ সালের শেষের দিকে রাজনৈতিক খুনের ক্ষেত্রে শিরোনামে উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গ। পরের দিকে ২০১৯ বা ২০২০ সালে এ নিয়ে আবার তথ্য চেপে যায় রাজ্য প্রশাসন। সূত্রে খবর, এনসিআরবি-কে রিপোর্ট দিতে চায়নি রাজ্য। আর সত্যি কথা বলতে গেলে এখন যেন গোটা রাজ্যে বোমার রাজনীতি চলছে। রেহাই পাচ্ছে না সাধারণ মানুষও।
কেন পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসা এত বেশি?
পরিসংখ্যান বলে, গোটা ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক হিংসায় পশ্চিমবঙ্গই এক নম্বরে। সাড়ে তিন দশকের বামপন্থী শাসনেও যেমন এই ছবিটা আগাগোড়া প্রায় একই রকম ছিল – তৃণমূল আমলেও তা বদলায়নি, বরং বেড়েছে। বিশেষত গ্রামবাংলায় প্রতিটি দলের মধ্যে নিয়মিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটেছে – অনেক ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে গাদা বন্দুক বা দেশি বোমা বানানোর কারখানা। প্রবল রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা থেকে তৈরি হয়েছে সংঘাত, বেড়েছে প্রাণহানি। কিন্তু কেন পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসা এত বেশি?
পশ্চিমবঙ্গে নিয়মিত শিরোনাম হয় নানা রাজনৈতিক হানাহানির খবর – বিভিন্ন দলের মধ্যে, এমনই একই দলের নানা গোষ্ঠীর মধ্যে বোমাবাজি, খুনখারাপি এরাজ্যে প্রায় রোজকার ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সহিংসতায় নতুন প্রবণতা হল একই দলের ভেতর মারামারি বা খুন। এখন একটা দলের ভেতরই তিন-চারটে গ্রুপ। কোনও কাজের ঠিকাদারি নিয়ে হয়তো বচসা – এ ভাবছে আমাকে পেতেই হবে, পরে হয়তো সুযোগ পাব না। অন্যরা ভাবছে আমাদের এই ঠিকা নিতেই হবে, এভাবেই একই দলে থেকেও অন্তরকলহ বেড়ে চলেছে।