নিউজ ডেস্ক: চিন-পাকিস্তানের ঘুম উড়িয়ে ‘হাইপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্রের (India’s Laser Weapon) সফল পরীক্ষা করল ভারত। যাকে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাইলফলক বলে চিহ্নিত করছেন সমর বিশেষজ্ঞেরা। শুধু তাই নয়, এবার থেকে যুদ্ধের সময়ে এই হাতিয়ার ভারতের জন্য ‘গেম চেঞ্জার’ হতে চলেছে বলেও স্পষ্ট করেছেন তাঁরা। সম্প্রতি লেজার অস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে দেশের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা। এর সাহায্যে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ আকাশেই পুড়িয়ে ছাই করতে পারবে ফৌজ। সৌজন্যে ‘ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন’ বা ডিআরডিও (DRDO – Defence Research and Development Organisation)।
প্রকাশ্যে ভিডিও
ডিআরডিও এই অস্ত্রের নাম দিয়েছে এমকে ২ (weapon MK 2)। সম্প্রতি ডিআরডিও এই পরীক্ষার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। যাতে মহাকাশে একটি ড্রোন উড়তে দেখা যায়, কিন্তু লেজার অস্ত্র দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমন করার পরই তা ধ্বংস হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। অর্থাৎ ‘হাইপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা সম্পন্ন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্নুলের (Kurnool, Andhra Pradesh) ন্যাশনাল ওপেন এয়ার রেঞ্জে এই লেজার হাতিয়ারের পরীক্ষা করা হয়। ইতিমধ্যে সেই ভিডিয়োই সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
তথ্য গৃহীত- https://x.com/BBCHindi/status/1914514794649895382?t=jEXjxqdj2FpLjUZDcz4D3A&s=19
ডিআরডিও (DRDO – Defence Research and Development Organisation) জানাচ্ছে,’ফিক্সড উইং ইউএভি ও সোয়ার্ম ড্রোনে সফলভাবে পরিকাঠামোগত আঘাত হেনেছে এই অস্ত্র। তাদের নজরদারির সেন্সরগুলিও গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ডিআরডিও বলছে, ‘এই সফল পরীক্ষামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে দেশটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লেজার DEW সিস্টেমের অধিকারী বিশ্বব্যাপী শক্তিধর দেশগুলির একচেটিয়া ক্লাবে যোগদান করেছে।’ ডিআরডিওর চেয়ারম্যান সমীর ভি কামাত বলছেন,’আমি যতটা জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চিন এই ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। ইসরায়েলও একই রকম ক্ষমতা নিয়ে কাজ করছে, আমি বলব যে আমরা বিশ্বের চতুর্থ বা পঞ্চম দেশ যারা এই ব্যবস্থা প্রদর্শন করেছে।’ তিনি বলছেন,’ আমরা বেশ কিছু প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছি যা আমাদের স্টার ওয়ার্সের সক্ষমতা দেবে। আজ যা দেখা গেল তা স্টার ওয়ার্স প্রযুক্তির একটি উপাদান।’
এ প্রসঙ্গে ডিআরডিও (DRDO) প্রধান সমীর ভি কামাত বলেছেন যে, ”রবিবারের পরীক্ষাটি কেবল এই প্রযুক্তির একটি প্রদর্শনী ছিল। ডিআরডিও এখন অন্যান্য সংস্থার সাথে আরও শক্তিশালী এবং কার্যকর লেজার অস্ত্র তৈরির জন্য কাজ করবে। আমরা যুদ্ধবিমান এবং নৌবাহিনীর জাহাজে স্থাপনের জন্য এই অস্ত্রটিকে আরও ছোট আকারে তৈরি করার জন্য কাজ করছি।” ধারণা করা হচ্ছে যে ব্যবহারের সহজতা এবং সস্তাতার কারণে, ‘ডাইরেক্টেড এনার্জি ওয়েপন সিস্টেম’ ধীরে ধীরে পুরানো অস্ত্র এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করবে।
কিন্তু কী এই ‘হাইপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র? (India’s Laser Weapon)
এক কথায় বললে শব্দের থেকেও বেশি গতিবেগে ছোটে এই ধরনের মিসাইল। । সাধারণত বলা হয়ে থাকে হাইপারসনিক স্পিডে এই মিসাইল ছোটে বলেই এর নাম হাইপারসনিক মিসাইল। শব্দের গতিবেগের ৫ গুণ থেকে ২৫ গুণ গতিতে এই মিসাইল দৌড়য়। প্রতি সেকেন্ডে ১ থেকে ৫ মাইল পর্যন্ত গতিবেগ থাকে এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের। ব্যালিস্টিক মিসাইল থেকে এর বিশেষত্ব অনেকটাই আলাদা। আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হাইপারসনিক মিসাইলকে ইন্টারসেপ্ট করতে প্রায় পারেই না। এর ফলেই এই মিসাইলের কার্যক্ষমতা অনেকটাই বেশি। এছাড়া, হাইপারসনিক মিসাইল কোনও চলমান যান বা নৌযানকে নিখুঁত নিশানায় আঘাত করতে সক্ষম। হাইপারসনিক মিসাইল উড়ানের মাঝপথে লক্ষ্য বদলে নিতে পারে। এই কারণেই চলন্ত কোনও কিছুকে আঘাত হানতে এর জুড়ি মেলা ভার। ব্যালিস্টিক মিসাইলের ক্ষেত্রে ট্র্যাজেক্টরি পূর্ব নির্ধারিত থাকে। কিন্তু হাইপারসনিক মিসাইল তাদের গতিপথ বদলে নিতে পারে প্রয়োজনমতো।
হাইপারসনিক অস্ত্র শব্দের গতির চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি গতিতে, অর্থাৎ ম্যাক ৫-এ চলতে সক্ষম। ম্যাক হলো শব্দের গতির পরিমাপক মানদণ্ড। ১ ম্যাক সমান ঘণ্টায় ১ হাজার ২৩৫ কিলোমিটার। অত্যাধুনিক এই মিসাইল ব্যালিস্টিক মিসাইলের তুলনায় বায়ুমণ্ডলের অনেক নিচ দিয়ে উড়ে। একে শনাক্ত করা কঠিন। এগুলো দ্রুত লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানো ছাড়াও বায়ুমণ্ডলে থাকা অবস্থাতেই দিক পরিবর্তন করতে পারে।
মূলত ২ ধরনের হাইপারসনিক মিসাইল রয়েছে-
১. হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিক্যাল: এই ধরনের মিসাইল রকেটে লঞ্চ করা হয় এবং এয়ারোডায়নামিক পদ্ধতি ব্যবহার করে লক্ষ্যতে আঘাত করে।
২. হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইল: স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় এই ধরনের মিসাইলে। গোটা উড়ানে এরা হাইপারসনিক স্পিড বজায় রাখতে পারে।
হাইপারসনিক মিসাইল (Hypersonic missiles) কেন এত ভয়ঙ্কর?
প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থার তরফে বলা হয়েছে, ”ভারত এ বার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লেজার অস্ত্র (India’s Laser Weapon) ব্যবস্থার অধিকারী দেশগুলির ক্লাবে ঢুকে পড়ল।” হাতিয়ারটি একসঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ ড্রোন হামলাকে রুখে দিতে পারবে বলে বলে দাবি করেছে ডিআরডিও। প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা সূত্রে খবর, শত্রুর নজরদারি সেন্সর, অ্যান্টেনা বা রাডার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারবে ‘এমকে-টু(এ)’। চোখের পলক ফেলার আগে নিখুঁত নিশানায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা চালাতে পারবে এই সমরাস্ত্র।
হাইপারসনিক মিসাইল কেন ভারতের জন্য বড় সাফল্য?
ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি এই দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দেড় হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে একাধিক ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। ফলে এই নয়া মিসাইল (Hypersonic missiles) সিস্টেম দূরপাল্লায় নিখুঁতভাবে শত্রুকে নিশানা করে ধ্বংস করতে ১০০ শতাংশ কার্যকরী। আর পাঁচটা মিসাইলকে অ্যান্টি-ফ্লেয়ার স্মোকার দিয়ে সহজে বোকা বানানো গেলেও একে যায় না। সেই সঙ্গে রয়েছে এস-৪০০ এর মতো মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। একদিকে হামলা চালানোর মতো অত্যাধুনিক মিসাইল, অন্যদিকে হামলায় আক্রান্ত হলে পাল্টা আক্রমণ করার দক্ষতা– এই দুই-ই ভারতকে আধুনিক যুদ্ধের ময়দানে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলির সঙ্গে একই আসনে বসাচ্ছে। উল্লেখ্য, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কো এই হাতিয়ার প্রয়োগ করেছে ইউক্রেনের উপর।
ডিআরডিওর তরফে অত্যাধুনিক অস্ত্রটিকে ‘ড্রোন ঘাতক’-এর তকমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থাটির কর্তা-ব্যক্তিদের দাবি, ‘এমকে-টু(এ)’র সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, এর নামমাত্র খরচ। এক-দু’লিটার পেট্রলের দামে কয়েক সেকেন্ডের জন্য লেজার রশ্মি ছুড়তে পাবে এই হাতিয়ার (India’s Laser Weapon)।
লেজার হাতিয়ারের গবেষণায় হারদরাবাদের (Hydrabad) একাধিক ল্যাবরেটরি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাহায্য পেয়েছে ডিআরডিও। পরে নকশা অনুযায়ী অস্ত্রটিকে তৈরি করে একটি দেশীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা। ট্রাক আকৃতির গাড়ির উপর ‘এমকে-টু(এ) লেজার’কে বসানো হয়েছে। ফলে যুদ্ধের সময়ে একে একাধিক রণাঙ্গনে মোতায়েন করতে পারবে ফৌজ।
এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং স্যোশাল মিডিয়া এক্সে লেখেন, “ভারত (India) একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জন করেছে। আমরা সফলভাবে হাইপারসনিক মিসাইলের (Hypersonic missiles) ফ্লাইট পরীক্ষা শেষ করেছি। এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। গুরুত্বপূর্ণ এই সাফল্য আমাদের দেশকে সেই বিশেষ দেশের তালিকায় যুক্ত করেছে, যারা উন্নত ও অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি অর্জন করতে সক্ষম।”
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে সিরিয়ায় সামরিক অভিযানের সময় প্রথমবারের মতো হাইপারসনিক মিসাইল (Hypersonic missiles) ব্যবহার করে রাশিয়া। গতি ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অতিক্রম করার সক্ষমতার কারণে কিনজাল মিসাইলকে একটি আদর্শ অস্ত্র আখ্যা দেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। এরপর ইউক্রেন অভিযানের সময়ও একাধিকবার কিনজাল ব্যবহার করেছে রাশিয়া। এরপর ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইরান ও ইসরায়েলের মতো অন্যান্য দেশও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা উন্নয়নে কাজ করছে। আর এবার পালা ভারতের। সব মিলিয়ে এই অস্ত্রের হাত ধরে চিন, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নাম জুড়ে গেল ভারতেরও।