নিউজ ডেস্ক: নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ এমনিতেই উত্তাল রাজ্য। তবে এটা এ রাজ্যে কোনও নতুন ঘটনা নয়। পশ্চিমবঙ্গ নামের সঙ্গে দুর্নীতি (Political Corruption of WB) শব্দটা এখন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। শুধু নিয়োগ দুর্নীতিই নয়, নারদা কান্ড, সারদা কাণ্ড থেকে শুরু করে গরু পাচার দুর্নীতি, কয়লা পাচার, বালি পাচার কিংবা রেশন দুর্নীতি। বিভিন্ন সময়ে এ রাজ্য সাক্ষী থেকেছে নানা দুর্নীতির। বিশেষত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির (Mamata Banerjee) আমলে গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গ দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছে। সামনে এসেছে একাধিক ঘটনা। এমনকি শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রচুর নগদ টাকাও। আজকের এই প্রতিবেদনে আরও একবার ফিরে দেখা সেইসব দুর্নীতির ঘটনা।
নারদা কাণ্ড (Narada scam case)
২০১৪ সালে ম্যাথু স্যামুয়েল (Mathew Samuel) এবং তাঁর সহকর্মী অ্যাঞ্জেল আব্রাহাম প্রায় বাহান্ন ঘণ্টা ধরে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত একটি স্টিং অপারেশন করেন। যা ২০১৬ সালে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রকাশ্যে আসে। গোপন ক্যামেরায় রেকর্ড করা ওই ভিডিওতে একাধিক নেতা-মন্ত্রীকে আর্থিক লেনদেন করতে দেখা গিয়েছিল। ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মদন মিত্র, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুলতান আহমেদ, অপরূপা পোদ্দার, শঙ্কুদেব পণ্ডা, আইপিএস অফিসার এস এম এইচ মির্জাকে টাকা নিতে দেখা যায়। বিপুল পরিমাণ ওই অর্থের বিনিময়ে কাজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেও শোনা যায়। আর এই স্টিং অপারেশন সামনে আসার পরই রীতিমতো তোলপাড় হয় সর্বত্র। যদিও তৃণমূলের তরফে ভিডিওর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তবে বিরোধীরা তা মানতে নারাজ। বারবারই এই ইস্যুতে শাসকদল তৃণমূলকে খোঁচা দিতে থাকে বিরোধীরা।
সারদা কেলেঙ্কারি (Saradha scam case)
২০০০ এর গোড়ার দিকে ব্যবসায়ী সুদীপ্ত সেন সারদা গ্রুপ তৈরি করেন। সারদা গোষ্ঠী ছিল অনেকগুলি কোম্পানিকে নিয়ে তৈরি করা এক কনসোর্টিয়াম, যারা ছোট ছোট বিনিয়োগকারীদের বেশি বেশি রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দিতে শুরু করে। একেবারেই ক্লাসিকাল পঞ্জি (ponzi) স্কিমের ধাঁচে কাজ চলতে থাকে, এজেন্টদের বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা শুরু হয়। এজেন্টদের কমিশন ছিল ২৫ শতাংশের বেশি। কয়েক বছরের মধ্যেই ২৫০০ কোটি টাকার বেশি বাজার থেকে তুলে ফেলে সারদা। ফিল্মস্টারদের এনডোর্স করে, জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাবে বিনিয়োগ করে, বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের মালিকানার মাধ্যমে, দুর্গাপুজো সহ বেশ কিছু অনুষ্ঠানের স্পনসরশিপের মাধ্যমে নিজেদের ব্র্যান্ড বানিয়ে ফেলে। সারদার ব্যাপ্তি পশ্চিমবঙ্গ অতিক্রম করে পৌঁছে যায় ওড়িশা, আসাম এবং ত্রিপুরাতেও। বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা ১৭ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।
২০০৯ সালে সারদার জালিয়াতি নিয়ে অভিযোগ তুলতে শুরু করেন রাজনীতিবিদরা। ২০১২ সালে সারদাকে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা তুলতে নিষেধ করে সেবি। ২০১৩ সালে প্রথমবার, সারদায় নগদ আয়ের থেকে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখনই বিপদঘণ্টি বেজে ওঠে।
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে গোটা স্কিম ভেঙে পড়ে। বিনিয়োগকারী এবং এজেন্টদের পক্ষ থেকে বিধাননগর পুলিশের কাছে শয়ে শয়ে অভিযোগ জমা পড়ে। সুদীপ্ত সেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে যান। তার আগে ১৮ পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে যান তিনি, যে চিঠিতে বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের নামে অভিযোগ করেন তিনি। তাঁর বক্তব্য ছিল, তাঁর হাত মুচড়ে রাজনীতিবিদদের ক্রমাগত টাকা নিয়ে নেওয়ার ফলেই এই স্কিম মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল সোনমার্গে গ্রেফতার হন সুদীপ্ত সেন।সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহযোগী দেবযানী মুখার্জি।
জানা গিয়েছে ব্র্যান্ড তৈরির জন্য রাজনৈতিক সম্পর্ক পোক্ত করে তুলেছিলেন সুদীপ্ত সেন। বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যমের দখল নিয়েছিলেন তিনি এবং বাংলা চলচ্চিত্র জগতেও বিনিয়োগ করেছিলেন। টিএমসি সাংসদ তথা চলচ্চিত্রাভিনেত্রী শতাব্দী রায় এবং রাজ্যসভার সদস্য মিঠুন চক্রবর্তী ছিলেন সারদার ব্র্যান্ড অ্যম্বাসাডর। ২০১৩ সালের মধ্যে সারদা পাঁচটি ভাষায় ৮টি সংবাদপত্র চালাতে থাকে। ১৫০০ সাংবাদিক কাজ করত তাদের অধীনে। গোটা সংবাদগোষ্ঠীর সিইও ছিলেন টিএমসি সাংসদ কুণাল ঘোষ। তাঁর বেতন ছিল মাসে ১৬ লক্ষ টাকা। এমনকি কলকাতা পুলিশকে মোটর সাইকেল উপহার দিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী। রাজ্যের নকশাল অধ্যুষিত এলাকায় অ্যাম্বুল্যান্স এবং মোটর সাইকেল প্রদান করে সরকার, যা স্পনসর করেছিল সারদা গোষ্ঠী।
কয়লা পাচার দুর্নীতি (coal smuggling case)
২০২০ সাল থেকে এ রাজ্যে কয়লা কেলেঙ্কারির ‘আত্মপ্রকাশ’। ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর অনুপ মাজি ওরফে লালা নামে এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কয়লা চোরাচালানের অভিযোগ দায়ের করে সিবিআই। মামলা হয় ইসিএলের কয়েকজন আধিকারিকের নামেও। তদন্ত যত এগোয়, কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসে একের পর এক। সিবিআইয়ের খাতায়, লালা এই কয়লাকাণ্ডের মূল মাথা। ২০২০’র শেষের দিকে কয়লাকাণ্ডে উঠে আসে বিনয় মিশ্র নামে আরও একটি নাম। দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা বিনয় তৃণমূলের যুব নেতা ছিলেন। সিবিআইয়ের কেস ডায়েরিতে বিনয়ের পরিচয়, রাজ্যের একজন প্রথম সারির নেতা এবং অনুপ মাজি ওরফে লালার ‘প্রটেক্টর’ হিসাবে।
গরু পাচার মামলা (cow smuggling)
মমতা ব্যানার্জির আমলে সামনে এসেছে গরু পাচারের মত ঘটনাও। কয়লা পাচার মামলার সঙ্গে এক অদ্ভূত বিনি সুতোর মালায় জড়িয়ে গিয়েছে গরু পাচার মামলাও। মাঝে মধ্যে অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন, কার বিরুদ্ধে কয়লা পাচার মামলায় অভিযোগ রয়েছে আর কার বিরুদ্ধে গরু পাচার মামলায় অভিযোগ। গরু পাচার মামলায় এক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে, এমনই বিস্ফোরক দাবি করেছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি। গরু পাচার কাণ্ডে গ্রেফতার হয় তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের কন্যা সুকন্যা মণ্ডল। এই মামলার শুনানি চলাকালীনই গরুপাচার কাণ্ডে এই পরিমাণ টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে দাবি করেছিল ইডির আইনজীবী। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের আইনজীবী আদালতে দাবি করেন, গরু পাচার কাণ্ডে সুকন্যার যোগ রয়েছে। তাঁর নামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ও একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিশ পাওয়া গিয়েছে। ফলে তিনি এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তখনই ইডির আইনজীবী আদালতে দাবি করেন, গুরু পাচার কাণ্ডে ১ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, এই গরু পাচার কাণ্ডে নাম জড়িয়েছিল তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। সেসময় তার অ্যাসিস্ট্যান্ট বা আপ্ত সহায়ক সুমিত রায়কে জেরা করেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। সূত্রের খবর মূলত গরু পাচার কাণ্ডের সঙ্গে আর কারা জড়িত রয়েছে তা জানার চেষ্টা করছে সিবিআই। পাশাপাশি এই বিপুল টাকার অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে কারা জড়িত তারও হদিশ পাওয়ার চেষ্টা করছে সিবিআই।
বালি পাচার (sand smuggling)
সূত্রের খবর, গরু, কয়লা পাচার মামলার পাশাপাশি ইডির নজরে রয়েছে বালি পাচারের কারবারও। গ্রামের ভিতর দিয়েও অবৈধ বালি বোঝাই গাড়ির দৌরাত্ম্য দেখা যায়- বালি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও ওঠে, বেআইনি বাঁধ তৈরি করে তারা নদীর গতিপথ বদলে ফেলে। বেআইনি বালি ও পাথর পাচার নিয়েও নড়েচড়ে বসছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। বীরভূমে গরু পাচার মামলার তদন্তে গিয়ে বালি পাচার সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্যও ইডির হাতে উঠে এসেছে বলে খবর। দুর্নীতির চড়কি পাকে কয়লা-গরু-বালি-পাথর সবই মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে বলে মনে করছে তদন্তকারী সংস্থাগুলি।
রেশন দুর্নীতি (Ration scam west bengal)
রাজ্যের এই দুর্নীতির ঘেরাটোপ থেকে বাদ পড়েনি রেশন বিভাগও। কেন্দ্রীয় সংস্থা জানিয়েছে, রেশন দুর্নীতি মামলায় হাজার কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। এই মামলায় গ্রেফতার হন জ্যোতিপ্রিয় এবং তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ ব্যবসায়ী বাকিবুর। সেই সূত্র ধরেই উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার একাধিক চালকলে হানা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তালিকায় ছিল দেগঙ্গায় আলিফের বাড়ি এবং চালকল। তার পর তাঁর ভাই আনিসুর এবং আলিফকে সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরা দিতে বলা হয়েছিল। প্রায় ন’ঘণ্টা জেরার পর গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁদের। আদালতে ইডি আগেই দাবি করেছিল, রহমান ভাইদের থেকে দফায় দফায় দেড় কোটির বেশি টাকা নিয়েছিলেন প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী। তদন্তকারীরা আরও দাবি করেছিলেন, রেশন দুর্নীতি মামলার অন্যতম অভিযুক্ত বাকিবুরের সঙ্গেও আর্থিক লেনদেন ছিল আনিসুর এবং আলিফের।
এ তো গেল রাজ্যের ভেতরকার দুর্নীতির (Political Corruption of WB) কথা। কিন্তু এ রাজ্যের বিরুদ্ধে আরও বড় যে অভিযোগ রয়েছে তা হল বাংলার উন্নতির জন্য কেন্দ্রের পাঠানো টাকায় দুর্নীতি হয় এ রাজ্যে। এ প্রসঙ্গে গত বছর বঙ্গ সফরে এসে সুর চড়িয়েছিলেন অমিত শাহ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘বাংলার উন্নয়নে বদ্ধপরিকর মোদী। বাংলার জন্য টাকা পাঠান মোদী, কিন্তু সেই টাকায় দুর্নীতি হয়। ইউপিএ আমলের থেকে এনডিএ আমলে বাংলাকে বেশি টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সেই টাকা মানুষের কাছে পৌঁছয় না, তৃণমূল নেতাদের পকেটে যায়’।