নিউজ ডেস্ক: সন্ত্রাস হামলায় ফের উত্তপ্ত জম্মু ও কাশ্মীর। এবার সন্ত্রাসবাদীদের নাশকতার সম্মুখীন উপত্যকায় ঘুরতে যাওয়া বেশ কিছু পর্যটক। সূত্রের খবর, পহেলগাঁওয়ে ঘুরতে আসা পর্যটকের উপর হামলা চালায় এক জঙ্গি গোষ্ঠী। দুপুর আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা ২ থেকে ৩ জন সন্ত্রাসী বৈসরণ এলাকায় এসে ঘোড়ায় চড়ে আসা পর্যটকদের উপর গুলি চালায়। সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে আহত হয়েছেন দশ জন পর্যটক। যার মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছে সেনা ও কাশ্মীর পুলিশের একটি দল। কারা হামলা চালাল, সেই নিয়ে তদন্তে নেমেছে তারা। তবে সূত্রের খবর, কাশ্মীরে হামলার দায় স্বীকার করেছে লস্কর-ই-তইবার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি জঙ্গি গোষ্ঠী। এটি স্পষ্টতই একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সন্ত্রাসী হামলা, যার লক্ষ্য ছিল নিরীহ পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো।
ভাইরাল ভিডিও
হামলার পরে একটি ভাইরাল ভিডিওতে (Jammu Kashmir Attack Viral Video) দেখা যায়, এক মহিলা ভেঙে পড়েছেন কান্নায়। গলা বুজে আসছে তাঁর। কাতর স্বরে বারবার বলছেন, ‘আমার স্বামীকে বাঁচান প্লিজ।’ ভিডিওয় দেখা গেছে, তাঁর পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন দুই ব্যক্তি। দেখে বোঝা যাচ্ছে, তাঁদের অবস্থা সঙ্কটজনক। অন্য এক মহিলা জানান, তিনি ভেলপুরি খাচ্ছিলেন, সেই সময়েই এক বন্দুকধারী এসে তাঁর স্বামীকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তিনি বলেন, ‘ওরা আমার স্বামীকে বলছিল, তুমি মুসলিম নও, তারপরেই গুলি চালায়।’ আরও একজন আহত পর্যটককে সাহায্য করতে গিয়ে এক মহিলা বারবার বলতে থাকেন, ‘স্যার, প্লিজ প্লিজ সাহায্য করুন, কাউকে ডাকুন।’ ঘটনার পরেই চারপাশে আতঙ্ক, রক্তপাত ও হাহাকার যেন ছড়িয়ে পড়ে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রের খবর, একাধিক জঙ্গি হামলা চালিয়েছে। ওই এলাকায় পর্যটকদের ভিড়ে মিশে ছিল জঙ্গিরা। পর্যটকদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। গুলির আঘাতে বেশ কয়েকজন পর্যটক জখম হয়েছেন। তাঁদের চিকিৎসার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই গোটা এলাকায় কড়া সতর্কতা জারি করা হয়েছে। পিটিআই সূত্রের খবর, বাইসারানে একটি রিসর্ট থেকে গুলির আওয়াজ শোনা গিয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকায় রয়েছে ওই রিসর্ট। গাড়ি পৌঁছয় না রিসর্ট পর্যন্ত। পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া যায়।
ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে পর্যটকদের মধ্যে
যে এলাকায় এই ঘটনাটি ঘটেছে, সেই বাইসারান প্রথমসারির পর্যটন কেন্দ্র। কাশ্মীরে ঘোরার জায়গা হিসেবে প্রথমেই আসে পহেলগাঁওয়ের নাম। সেই পহেলগাঁওয়ে রয়েছে এই বাইসারান। প্রতি বছর সেখানে প্রচুর পর্যটক বেড়াতে আসেন। এমন ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে পর্যটকদের (Tourists) মধ্যে।
তবে দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগে বরাবরই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির প্রভাব রয়েছে। যদিও নিরাপত্তা বাহিনী লাগাতার নজরদারিতে উপদ্রব কিছুটা হলেও কমেছিল। কিন্তু অন্ততনাগে বছর খানেক ধরে ফের জঙ্গি কার্যকলাপ বেড়েছে। এর আগে একাধিকবার কাশ্মীরের বহিরাগতদের উপর জঙ্গি হামলা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারাও হামলার শিকার হয়েছেন, মৃত্যুও ঘটেছে।
প্রশ্নের মুখে পুলিশ-প্রশাসন
তবে এ ঘটনায় ফের একবার প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। সাধারণভাবেই, গত কয়েক মাস ধরে উপত্যকার নানা প্রান্তে চিরুনি তল্লাশি করে জঙ্গিদের খতম করে মেরেছে সেনা ও পুলিশের যৌথ বাহিনী। এবার সেই আবহেই কি তবে সেনার বিরুদ্ধে পাল্টা ‘যুদ্ধের ঘোষণা’ করল সন্ত্রাসবাদীরা? ওয়াকিবহাল মহলের মতে, দিন কয়েকের মধ্য়ে উপত্যকা থেকে শুরু হয়ে যাবে অমরনাথ ধাম যাত্রা। এই পরিস্থিতি কাশ্মীরজুড়ে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে বাড়তি সচেতনতা অবলম্বন করেছে পুলিশ-প্রশাসন। তবে এই হামলার মাধ্যমে আসলে সেই সচেতনতায় যে একটা ফাঁক রয়ে গিয়েছে, এই বিষয়টা তুলে ধরে কাশ্মীর প্রশাসনের দিকে নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল সন্ত্রাসবাদীরা।
এই হামলা কি নতুন ষড়যন্ত্রের হুঁশিয়ারি?
সপ্তাহ কয়েক আগেই জম্মু-কাশ্মীরে নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে নিহত হয়েছে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের জইশ-ই-মহম্মদ গোষ্ঠীর তিন কমান্ডার। জানা যায়, গত ১২ই এপ্রিল উধমপুর ও কিস্তওয়ারে একটি অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদমনে নামে তারা। এই সংঘর্ষে খতম হওয়া সন্ত্রাসবাদীদের তিন জনেরই মাথার দর ছিল পাঁচ লক্ষ টাকা করে। সেই ঘটনা সপ্তাহ পেরতেই এই হামলা কি নতুন ষড়যন্ত্রের হুঁশিয়ারি? প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রসঙ্গত, কয়েকদিন আগেই কাশ্মীর নিয়ে মুখ খুলেছিলেন পাকিস্তানের সেনা প্রধান আসিম মুনির। কাশ্মীরকে মানবশরীরের জুগুলার ভেইনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কাশ্মীরের পাশে পাক-সেনা থাকবে বলেও মন্তব্য করেছিলেন। ওই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছিল ভারত। তার কয়েকদিন পরেই এই হামলা।
এই জঙ্গি হামলার তীব্র নিন্দা করেছে জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি। কমিটির সভাপতি তারিক হামিদ বলেছেন,”নিরীহ পর্যটকদের উপর নির্বোধ ও কাপুরুষোচিত জঙ্গি হামলার কথা জানতে পেরে অত্যন্ত মর্মাহত। এই ধরনের ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং সভ্য সমাজে এর কোনও স্থান নেই।”
ঘটনায় শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার
এই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা বলেন, ”এই ঘটনায় আমি শোকাহত। পর্যটকদের উপর এই আক্রমণ জঘন্য কাজ। এই হামলার অপরাধীরা পশু, অমানবিক এবং অবমাননার যোগ্য। নিন্দার কোনও শব্দই যথেষ্ট নয়। আমি নিহতদের পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা জানাই। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা তদারকি করতে হাসপাতালে গিয়েছেন আধিকারিকরা। আমিও অবিলম্বে শ্রীনগরে ফিরে যাচ্ছি।”
উল্লেখ্য, গত কয়েক বছরে উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদের থাবা ক্রমেই আলগা হচ্ছে বলে মোদী সরকার দাবি করে। কিন্তু সম্প্রতি কাশ্মীরের উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহাকে দাবি করতে দেখা গিয়েছে, উপত্যকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দিনদিন বাড়ছে। যা খুবই উদ্বেগের বিষয়। যদিও গত ৯ এপ্রিল মুম্বইয়ের এক সম্মেলন থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছিলেন, “বহু প্রজন্ম ধরে জম্মু ও কাশ্মীরের যুবসমাজ বোমা, পাথর ছুড়ে, বন্দুক চালিয়ে ভবিষ্যত নষ্ট করেছে। এর আগে কয়েক দশক ধরে দেশের শাসকরা এই আগুন নেভাতে পারেনি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি চিরতরে বদলে গিয়েছে। আমাদের সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি এবং সংবেদনশীলতার কারণে আজ দিন বদলছে জম্মু ও কাশ্মীরে। সেখানকার যুবসমাজ আজ উন্নয়নের পথে হাঁটছে।” কিন্তু তাঁর সেই দাবি অগ্রাহ্য করে রবিবারই মনোজ বলেন, “বিশেষ করে জম্মুতে জঙ্গিদের কার্যকলাপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়।” এর মধ্যেই এবার ফের জম্মু ও কাশ্মীরে চাঞ্চল্য ছড়াল জঙ্গি হামলা।
অমিত শাহকে পহেলগাঁওয়ে যেতে নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
কাশ্মীরের এই জঙ্গি হামলার খবর পেতেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন নরেন্দ্র মোদী। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সকল উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকী প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের নির্দেশও দিয়েছেন। উল্লেখ্য, দু’দিনের সফরে মঙ্গলবার সৌদি আরবে রয়েছেন মোদী। সৌদির যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমনের আমন্ত্রণে এই নিয়ে তৃতীয়বার সৌদি গিয়েছেন তিনি। সেখান থেকেই তিনি এই নির্দেশ দেন ফোনে, এমনটাই সরকারি সূত্রে খবর।
ইতিমধ্যেই অমিত শাহ জানিয়েছেন, ”ভিডিও কনফারেসিংয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ও অফিসাররা এজেন্সিদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে শ্রীনগর যাচ্ছি।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের রুটিরুজি বিপন্ন
বছরের এই সময়ে পহেলগাম উপচে পড়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকে। তবে তাঁদের আর কোনও আস্থা বা নিরাপত্তা কিছুই বাকি রইল না এই হামলায়। জম্মু-কাশ্মীর যেখানে পর্যটনের উপর অনেকটা নির্ভরশীল, সেখানে পর্যটকদের উপর এমন হামলা শুধু যে নিরীহ মানুষদের প্রাণহানি ঘটাল তাই নয়, সেইসঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের রুটিরুজিও বিপন্ন করল।