নিউজ ডেস্ক: গ্রীষ্মের শুরুতে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে কাশ্মীরে ভিড় জমিয়েছিলেন পর্যটকরা। কেউ হানিমুনে, কেউ আবার সপরিবারে ছুটি কাটাতে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউই আর ফিরলেন না বাড়ি। জঙ্গিদের চালানো এলোপাতাড়ি গুলিতে কয়েক মিনিটের মধ্যে রক্তাক্ত শ্মশানপুরীতে পরিণত হল পহেলগাঁও (Pahalgam Terror Attack)।
ইতিমধ্যেই ভূস্বর্গে এই জঙ্গি কার্যকলাপের কড়া নিন্দা করে সৌদি আরব থেকে এক্স হ্যান্ডেলে বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi)। তিনি লিখেছেন, “জম্মু-কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। যাঁরা তাঁদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। এই কাপুরুষোচিত হামলায় যাঁরা জড়িত, তাঁদের কোনওভাবেই রেহাই দেওয়া হবে না। সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের লড়াই আরও জোরদার হবে।”
মোদী জমানায় কাশ্মীরের উন্নয়ন
তবে ভূস্বর্গে এই জঙ্গি হামলা একেবারেই কাম্য নয়, কারন মোদী জমানায় বেশ অনেকটাই রূপ বদলেছিল কাশ্মীর। কারন ক্ষমতায় আসার পর জম্মু ও কাশ্মীরের উন্নয়নের জন্য মোদী সরকার বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছে, যার ফলে কাশ্মীরের সার্বিক উন্নয়ন ঘটেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সন্ত্রাসী হামলার হারও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
সূত্রের মতে, অতীতেও জম্মু-কাশ্মীরে প্রচুর টাকা কেন্দ্র থেকে পাঠানো হত। কিন্তু নীচু স্তর পর্যন্ত সেটি পৌঁছত না। তবে মোদী সরকারের মূল লক্ষ্যই হল, মানুষের উন্নয়নের অর্থ সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। যাতে রোজগার বাড়ে। দক্ষতা উন্নয়ন মন্ত্রক ইতিমধ্যেই সাতটি জেলাকে চিহ্নিত করেছে, যেখানে উন্নয়নের জন্য অনেক বেশি কাজ করতে হবে। শিল্প ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া থেকে নতুন প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া, শিক্ষার মান বাড়ানো সবই রয়েছে এই তালিকায়। শিক্ষা নীতির আমূল বদল শুধু শ্রীনগরই নয়, প্রত্যন্ত এলাকার পড়ুয়াদেরও মূলস্রোতে সামিল করতে সহায়তা করবে।
এর পাশাপাশি জোর দেওয়া হয় পর্যটন শিল্পেও। জম্মু-কাশ্মীরে কম পরিচিত পর্যটনস্থলকেও ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করে কেন্দ্র সরকার। অন্যদিকে ভূস্বর্গের সঙ্গে রেলপথে দেশের বাকি অংশের যোগাযোগ ব্যবস্থার পথও সুগম করেছে মোদী সরকার। সম্প্রতি বারামুলা যাওয়ার প্রথম বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। জানা গিয়েছে উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুলা রেল লিঙ্ক (ইউএসবিআরএল) প্রকল্প যদি প্রাথমিক ভাবে কাটরা থেকে বারামুলা পর্যন্ত সফল ভাবে চালানো সম্ভব হয়, তা হলে ক্রমে তা জম্মু এবং পরে শ্রীনগর পর্যন্ত চালানো হবে।
বর্তমানে জম্মু-কাশ্মীরে যে রেল পরিষেবা চালু রয়েছে, তা উত্তর কাশ্মীরের রামবানের বারামুলা ও সাঙ্গালদানের ১৮৩ কিলোমিটার পথ জুড়ে চলে। দেশের বাকি জায়গা থেকে আসা ট্রেনগুলি বৈষ্ণব দেবী মন্দিরের বেস ক্যাম্প যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত কাটরা রেল স্টেশন পর্যন্তই যায়। কাটরা থেকে বারামুলা যেতে হলে ট্রেন বদল করতে হয়। ইউএসআরবিএল প্রকল্প চালু হলে কাটরা থেকে বারামুলা একই ট্রেনে সফর করা সম্ভব হবে। তবে এখনও পর্যন্ত দিল্লি বা অন্য বড় শহর থেকে কাশ্মীর যাওয়ার সরাসরি কোনও ট্রেন নেই। বস্তুত, এখনও পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ভাবে বেশ কয়েক বার ট্রেন চালানো হয়েছে এই পথে। প্রতি বারই তা সফলও হয়েছে।
এছাড়াও জম্মু ও কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের শিল্প উন্নয়নের জন্য ২০২১ সালে একটি নতুন কেন্দ্রীয় প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছিল, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮,৪০০ কোটি টাকা। জম্মু ও কাশ্মীর ৫৪,০০০ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগের আবেদন পেয়েছে, যার মধ্যে ৩৬,০০০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের প্রকল্পের জন্য শিল্প জমি বরাদ্দ করা হয়েছে।
একইসঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরে সরকার ২০১৯ সাল থেকে সরকারি খাতে মোট ২৯,৮০৬ জন নিয়োগ করেছে। এছাড়াও, আগস্ট ২০১৯ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত স্ব-কর্মসংস্থান প্রকল্পের মাধ্যমে ৫.২ লক্ষ ব্যক্তির কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
এছাড়াও কাশ্মীরের উন্নয়নের স্বার্থে তিনটি প্রধান সেচ প্রকল্প, যথা: মূল রবি খাল (৬২ কোটি টাকা), ত্রাল উত্তোলন সেচ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায় (৪৫ কোটি টাকা) এবং ঝিলাম নদী ও তার উপনদীগুলির সর্বাত্মক বন্যা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার (প্রথম পর্যায়) জন্য ৩৯৯.২৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছে মোদী সরকার।
অন্যদিকে, জল জীবন মিশনের আওতায়, গৃহস্থালির নলের জল সংযোগ ৫.৭৫ লক্ষ (৩১%) থেকে বেড়ে ১০.৫৫ লক্ষ (৫৭%) হয়েছে। দুটি জেলা (শ্রীনগর এবং গান্দেরবাল) কে ‘হর ঘর জল জেলা’ (Har Ghar Jal districts) করা হয়েছে। সমস্ত গ্রামীণ স্কুল, অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলিতে জল সংযোগ প্রদান করা হয়েছে।
এছাড়াও রেলের আরও সম্প্রসারণও করা হবে। যা পর্যটনের বিস্তারে আরও সাহায্য করবে। আপাতত মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রককে কাজে লাগানো হচ্ছে। গত কয়েক বছরে রাজ্যে মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী চালু হয়েছে। তাদের সাহায্যে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে সরকারি সূত্রের দাবি। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকও দূরদর্শনে কাশ্মীরের পরিস্থিতির উপর বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। ‘কাশ্মীর কা সচ’ নামে একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে, যাতে ‘অপপ্রচার’-এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
জাতীয় নিরাপত্তায় মোদী সরকারের সাফল্য
সম্প্রতি রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধ দমনে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, যার ফলে সন্ত্রাসী হামলার হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাতেই সন্ত্রাসবাদ পিছু হটছে বলে জানিয়েছেন অমিত শাহ। জাতীয় নিরাপত্তায় মোদী সরকারের সাফল্য নিয়ে সম্প্রতি অমিত শাহ বলেন, “গত দশ বছরে মোদী সরকার দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে ঐতিহাসিক পরিবর্তন এনেছে। জম্মু ও কাশ্মীর, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বামপন্থী উগ্রবাদী এলাকাগুলিতে সন্ত্রাসবাদ কমেছে”। এমনকি মোদী সরকারের আমলে ভূ-স্বর্গে সন্ত্রাসবাদে মৃত্যু ৭০ শতাংশ কমেছে বলেও দাবি করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘সুশাসনে’র জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্টে রীতিমতো পরিসংখ্যান তুলে ধরে দেখানো হয়েছে, ২০২২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত কাশ্মীরে অন্তত ২৫ লক্ষ পর্যটক বেড়াতে এসেছেন। জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপ এবং রাজ্যটিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার পর সেখানে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা যে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, তা-ও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে এই রিপোর্টে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ২০১৮ সালে কাশ্মীরে ৪১৭টি সন্ত্রাসবাদী হামলা হলেও ২০২১ সালে তা কমে এসেছে মাত্র ২২৯টিতে। এই ধরনের হামলায় ২০১৮ সালে ৯১ জন মারা গিয়েছিলেন। ২০২১ সালে মারা যান ৪২ জন।
জানা গিয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে ৮০ শতাংশ হিংসার ঘটনা কমে গিয়েছে। হামলায় সাধারণ মানুষের মৃত্যুর হার কমে হয়েছে ৮৯ শতাংশ। ৬০০০ জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেছে। একইসঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরে জঙ্গি কার্যকলাপ প্রায় ১৬৮ শতাংশ কমে গিয়েছে। যারা সন্ত্রাসবাদকে মদত দিচ্ছে তাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশের সাজা হয়েছে। ফলে এ কথা স্পষ্ট যে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদকে ‘নিয়ন্ত্রণে’ আনতে সক্ষম হয়েছে সামরিক বাহিনী।
মোদী জমানার উন্নয়নই কী পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে জঙ্গিদের?
এসব মিলিয়েই বিগত কয়েক বছরে বদলে গিয়েছে জম্মু-কাশ্মীরের চেহারা। চলছে ব্যাপক উন্নয়ন। আর সেটাই কি গলার কাটা হয়ে বিঁধছে জঙ্গিদের? গতকালের জঙ্গি হামলার মত গত বছরও জম্মু-কাশ্মীরের সোনমার্গ-গান্ডেরবাল টানেল প্রকল্পের কাছে হামলা চালায় জঙ্গিরা। গুলিতে মৃত্যু হয় এক চিকিৎসক ও ছয়জন পরিযায়ী শ্রমিকের। জানা গিয়েছে, এরা সকলেই ওই সুড়ঙ্গ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সুড়ঙ্গের কাজ সেরে ক্যাম্পে ফেরেন তারা। হঠাৎই কমপক্ষে দুইজন জঙ্গি চড়াও হয় এবং এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। নিহতদের মধ্যে তিন শ্রমিকের বাড়ি বিহারে, একজন মধ্য প্রদেশের বাসিন্দা বলেই জানা গিয়েছে। এই ঘটনা ও গতকালের হামলার শিকার সাধারণ মানুষ। এবার প্রশ্ন উঠছে, কেন জঙ্গিদের নিশানায় সাধারণ মানুষ? সূত্রের খবর, জম্মু-কাশ্মীরের উন্নয়ন-যজ্ঞকেই ভাল চোখে দেখছে না জঙ্গিরা। দীর্ঘ সময় ধরে বন্দুকের নলে যেভাবে কাশ্মীরকে শাসন করেছে জঙ্গিরা, তা মোদী জমানায় অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। লাগাতার জঙ্গি দমন অভিযানও চলছে। অর্থাৎ এ কথা স্পষ্ট যে, মোদী জমানার উন্নয়নই পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে জঙ্গিদের।