নিউজ ডেস্ক: কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ২২ এপ্রিলের জঙ্গি হামলার অভিশপ্ত দুপুরের দগদগে ক্ষত গোটা দেশের বুকে। নিরস্ত্রের ওপর সেই নারকীয় জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ বা TRF (The Resistance Front)। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘লস্কর-ই-তইবা’র (Lashkar-e-Taiba) ছত্রছায়ায় থাকা সংগঠন TRF হামলা চালানোর আগে এই এলাকায় প্রায় সাতদিন ধরে রেইকি করে। এপ্রিলে পর্যটনের ভরা মরশুমে যখন ডাল লেক, গুলমার্গ, সোনমার্গ, পহেলগাঁওয়ে পর্যটকের ঢল নেমেছে, তখনই এই ‘রিসর্ট জেহাদ’-এর ছক কষা হয়।
কিন্তু, এটাই প্রথমবার নয়, এর আগেও একাধিক বার রক্তাক্ত হয়েছে ভূস্বর্গ। একের পর এক হামলায় কার্যত হত্যাপুরীতে পরিণত হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর। ২০০০ সাল থেকে ঠিক কতবার জঙ্গিহানায় কেঁপে উঠেছিল নৈসর্গিক এই রাজ্য? আসুন জেনে নেওয়া যাক আজকের এই প্রতিবেদনে-
২০০০ সালের ২১ মার্চ
অনন্তনাগের ছত্তিসিংপোড়া গ্রামে ঢুকে পড়ে জঙ্গিরা। হামলা চালানো হয় সংখ্যালঘু শিখদের উপর। মারা যান ৩৬ জন মানুষ।
ওই বছরের অগাস্টে নুনওয়ান বেসক্যাম্পের কাছেও হামলা হয়। ঘটনায় ২৪ জন অমরনাথ তীর্থযাত্রী সহ মোট ৩২ জন মারা যান।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর
আত্মঘাতী জঙ্গির গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ কেঁপে ওঠে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা চত্বর। এই ঘটনায় মারা যান মোট ৩৬ জন।
২০০৩ সালের ২৩ মার্চ
পুলওয়ামা জেলার নন্দীমার্গে জঙ্গিদের হাতে নিহত হন ২৪ জন কাশ্মীরি পণ্ডিত। যাদের মধ্যে ১১ জন নারী ও ২ জন শিশু ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের উপত্যকা ছাড়ার প্রক্রিয়াকে আরও গতি দেয়।
২০০৫ সালের ১৩ জুন
ঘটনাস্থল সেই পুলওয়ামা। সরকারি এক স্কুলের সামনে বিস্ফোরক বোঝাই ভর্তি গাড়িতে বিস্ফোরণ হয়। ১৩ জন সাধারণ মানুষ, ২ স্কুল পড়ুয়া এবং তিনজন নিরাপত্তারক্ষী মারা যান। আহত হন ১০০।
২০০৬ সালের ২৬ মে
শ্রীনগরের উপকণ্ঠে জাকুরার বাটাপোরা এলাকায় সন্ত্রাসীবাদীরা একটি পর্যটক বোঝাই বাসে গ্রেনেড ছুড়লে চার জন পর্যটক নিহত এবং ছ’জন আহত হয়েছিলেন। নিহতেরা ছিলেন গুজরাটের বাসিন্দা। ঘটনাচক্রে, সে সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সে বছরেরই ১১ জুলাই শ্রীনগরেরই লালচকে পর্যটক বোঝাই বাসে ফের গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। ওই ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন এক জন। সে দিন শ্রীনগরের বিভিন্ন প্রান্তে পাঁচটি হামলায় মোট আট জনের মৃত্যু হয়েছিল।
২০১৭ সালের ১১ জুলাই
সাত জন অমরনাথ তীর্থযাত্রীকে হত্যা করা হয়। পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গুলিযুদ্ধও ঘটে। দক্ষিণ কাশ্মীরের বোয়েতাং অঞ্চলে ঘটে এই ঘটনা।
তবে বছর গড়ালেও হুমকি কাটেনি। বারবার রক্তাক্ত হয়েছে ভূস্বর্গ (Jammu Kashmir)। ভিনরাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকেরা খুন হয়েছেন হামেশাই। অমরনাথ, বৈষ্ণোদেবী বা অন্যান্য ধর্মস্থানে আগত পুণ্যার্থীরাও বার বার হামলার শিকার হয়েছেন। প্রায় দু’দশকের ব্যবধানে কাশ্মীর উপত্যকার ফের মঙ্গলবার এত বড় হামলার (Pahalgam Terror Attack) শিকার হলেন পর্যটকেরা। এই ধারাবাহিক হামলাগুলোর দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়, সন্ত্রাসবাদের কোনও মানবিকতা নেই, নেই কোনও ধর্মীয় বোধ। ধর্মের নামে যারা হত্যা চালায়, তারা মানবতা থেকেই বিচ্যুত। তারা কাশ্মীরের ভালো চায় না। কাশ্মীরীদের রুজি-রুটি পর্যটন সেখানেই ধাক্কা দিল জঙ্গিরা। আসলে সন্ত্রাসের লক্ষ্যই হল জন্নত-এ-কাশ্মীরকে জাহান্নামে পরিণত করা।
২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল
কাশ্মীরের পহেলগাঁও-য়ের বৈসরনে পর্যটকদের উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালায় জঙ্গিরা। এখনও পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২৫।
দুই জঙ্গিকে নিকেশ করল ভারতীয় সেনা
আর গতকালের এই জঙ্গি হামলার পর দিনই জম্মু-কাশ্মীরের বারামুলা জেলার উরিতে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করা দুই জঙ্গিকে নিকেশ করল ভারতীয় সেনা। আসলে গতকালের ওই ঘটনার পর জঙ্গিদের খোঁজে এলাকায় চিরুনি তল্লাশি শুরু হয়েছে। কাশ্মীরে পৌঁছে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা। সৌদি সফর কাটছাঁট করে দেশে ফিরে ইতিমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে রাশিয়া, আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশ।
এরই মধ্যে বুধবার সেনার তরফে বিবৃতি দিয়ে সেনার তরফে জানানো হয়েছে, দুই জঙ্গির কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে আগ্নেয়াস্ত্র এবং কার্তুজ মিলেছে। সেনা জানিয়েছে, বুধবার অন্তত ২-৩ জন জঙ্গি বারামুলার উরিতে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিল। তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। খবর পাওয়া মাত্রই সেখানে পৌঁছে যায় ভারতীয় সেনা। গুলির লড়াই হয় জঙ্গিদের সঙ্গে। সেই সময়েই দুই জঙ্গির মৃত্যু হয়।
বারবার সন্ত্রাসবাদের শিকার হিন্দু তথা অমুসলিমরা
কাশ্মীর (Jammu Kashmir) উপত্যকায় বারবার সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়েছেন হিন্দু তথা অমুসলিমরা। সাধারণ মানুষ, তীর্থযাত্রী, নিরাপত্তা কর্মী, শ্রমিক—সবাইকে একত্রে ক্ষতবিক্ষত করেছে ইসলামিক জঙ্গিরা। গত দুই দশকের নৃশংস হামলাগুলো প্রমাণ করে, এই সহিংসতার প্রকৃতি নিছক নিষ্ঠুরতা, ভয় দেখানো, আতঙ্ক সৃষ্টি।