নিউজ ডেস্ক: জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় মঙ্গলবারের জঙ্গিহানার ঘটনায় অন্তত ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রধারী হামলাকারীরা সংখ্যায় ছিল পাঁচ-ছ’জন। ঘটনাচক্রে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সের ভারত সফর এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সৌদি আরব সফরের সময়টিকেই হামলার জন্য বেছে নিয়েছে সন্ত্রাসবাদীরা। পাক জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-ই-ত্যায়বার ছায়া সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) মঙ্গলবার রাতে ঘটনার দায় স্বীকার করেছে।
দেশে ফিরলেন মোদী
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবারই সৌদি সফরে গিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi)। ওইদিন দুপুরেই কাশ্মীরে পহেলগামে পর্যটকদের উপর জঙ্গি হামলা হয় (Pahalgam)। ঘটনার খবর পাওয়া মাত্রই সৌদি আরব সফর কাটছাঁট করেই দেশে ফিরলেন মোদী। তবে জেদাহ থেকে ফেরার পথে আকাশপথে পাক সীমা এড়িয়ে গেল প্রধানমন্ত্রীর বিমান। বুধবার সকালেই দিল্লি ফিরে আসেন প্রধানমন্ত্রী। বিমানবন্দরে নেমেই কাশ্মীরের জরুরী পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেন। কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, জাতীয় নিরাপত্তা আধিকারিক অজিত ডোভাল সহ অন্যান্য আধিকারিকরাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি
পহেলগাঁওয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর কয়েক হাজার পর্যটক কাশ্মীর ছেড়ে যেতে শুরু করেছেন৷ পর্যটকদের নিজেদের রাজ্যে নিরাপদে ফিরিয়ে দিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে প্রশাসনের তরফে। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ জানিয়েছেন, পর্যটকদের এভাবে ফিরে যাওয়ার ঘটনা হৃদয়বিদারক। মুখ্যমন্ত্রী এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, “পহেলগাঁওয়ে মর্মান্তিক জঙ্গি হামলার পর উপত্যকা থেকে আমাদের অতিথিদের চলে যাওয়া দেখে মন ভেঙে গিয়েছে৷ কিন্তু আমরা এও বুঝতে পারছি কেন মানুষ চলে যেতে চাইছেন। ডিজিসিএ এবং অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক অতিরিক্ত পরিমাণে বিমান যাতে চলে সেই ব্যবস্থা করছে ৷ ”
তিনি আরও লিখেছেন, “আমি প্রশাসনকে শ্রীনগর ও জম্মুর মধ্যে যান চলাচল স্বাভাবিক করার নির্দেশ দিয়েছি যাতে পর্যটকদের গাড়ি সহজেই যেতে পারে। এটি নিয়ন্ত্রিত এবং সংগঠিত উপায়ে করতে হবে কারণ রাস্তাটির এখনও কিছু জায়গায় অস্থিরতা আছে৷ আমরা আটকে থাকা সমস্ত যানবাহন সরিয়ে নেওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছি। এই মুহূর্তে যানবাহনের সম্পূর্ণ অবাধ চলাচলের অনুমতি দিতে পারব না৷ আশা করি, সকলেই আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন৷”
অনন্তনাগ জেলার পহেলগাঁওয়ের জঙ্গি হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার একদিন পর, বেশিরভাগ পর্যটক ভয়ে উপত্যকা ছেড়ে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে শ্রীনগরের ট্রাভেল অপারেটর আইজাজ আলি বলেন, “পর্যটকরা কাশ্মীরে মোটামুটি নিরাপদেই আছেন৷ কিন্তু এখানে এমন ঘটনা ঘটছে যে তাঁদের থেকে যেতে বলা যায় না৷ তাছাড়া অন্য পর্যটকরা এখনই কাশ্মীরে ফিরে আসবেন এমন আশাও করা যায় না। প্রায় ৮০ শতাংশ বুকিং বাতিল হয়ে গিয়েছে৷ আগামী এক মাসের জন্য প্যাকেজ বাতিল করা হয়েছে। ”
বিপদের মুহূর্তেও ব্যবসা
অন্যদিকে পহেলগাঁওতে নৃশংস হত্যালীলার পর হাজার হাজার পর্যটক আটকে রয়েছেন সেখানে। বাঙালি পর্যটকের সংখ্যাই প্রায় ৪৫০। বহু পর্যটকই তড়িঘড়ি কাশ্মীর থেকে ফিরে আসতে চাইছেন। কিন্তু একাধিক বেসরকারি বিমান সংস্থা এই সঙ্কটের পরিস্থিতিতে প্রায় তিনগুণ ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। বিমানের টিকিট কাটতে গিয়ে আঁতকে উঠছেন সকলে। প্রায় ৩০-৪০ হাজার টাকা বিমানের ভাড়া দেখাচ্ছে। তাও আবার এক-একজনের। জরুরি পরিস্থিতিতে কীভাবে পর্যটকরা পরিবার নিয়ে ফিরবেন? উঠছে এ প্রশ্নও।
এই অবস্থায় বিমানের ভাড়া, বাতিল চার্জ এবং আনুষঙ্গিক খরচ কমানোর জন্য সবকটি বেসরকারি বিমান সংস্থাকে চিঠি দিয়েছেন অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রকের ডিরেক্টর জেনারেল। চিঠিতে বলা হয়েছে, এয়ারলাইন্সগুলি যেন অতিরিক্ত বিমান চলাচলের ব্যবস্থা করে। শ্রীনগর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিমানের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে, যাতে পর্যটকদের আটকে পড়তে বা অন্য কোনও সমস্যায় না পড়তে হয়। পাশাপাশি চিঠিতে আনুষঙ্গিক খরচ কমানোর জন্যও বলা হয়েছে।
জঙ্গি হামলার বড়সড় প্রভাব পড়তে চলেছে পর্যটনশিল্পে
পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপর জঙ্গি হামলার ঘটনার বড়সড় প্রভাব পড়তে চলেছে পর্যটনশিল্পে। সেই আশঙ্কাই করছেন কলকাতার পর্যটন ব্যবসায়ীরা। ইতিমধ্যে ভ্রমণ সংস্থাগুলির কাছে ফোন আসতে শুরু করেছে। কেউ কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতির খোঁজ নিচ্ছেন। কেউ সরাসরি ভ্রমণের পরিকল্পনাই বাতিল করে দিতে চাইছেন। অনেকে আবার কাশ্মীর বাতিল করে হিমাচল প্রদেশে বুকিং পরিবর্তনের অনুরোধ করছেন। ফলে ভ্রমণসংস্থাগুলির আশঙ্কা, সারা বছর ধরে কাশ্মীর থেকে তাঁদের যে পরিমাণ ব্যবসা হত, তাতে এ বার মন্দা আসবে। ক্ষতির মুখোমুখি হতে চলেছে কাশ্মীরের পর্যটন, যা নিয়ে চিন্তায় কলকাতার সংস্থাগুলিও।
৩৫ বছরে প্রথম, জঙ্গিহানার প্রতিবাদে কাশ্মীর জুড়ে পালিত হচ্ছে বন্ধ
মঙ্গলে পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় প্রাণ গিয়েছে কমপক্ষে ২৬ জন পর্যটকের৷ সেই ঘটনার পর থেকেই কার্যত বদলে গিয়েছে কাশ্মীর ৷ সাধারণ মানুষের দেখা নেই৷ বন্ধ দোকানপাট৷ জনশূন্য রাস্তাঘাট, থমথমে পরিবেশ৷ রাস্তায় কেবল বন্দুকহাতে দাঁড়িয়ে জওয়ানরা৷ ছবিতে ধরা পড়ল অপরিচিত পহেলগাঁও৷ অন্যদিকে, জঙ্গি হামলায় এই ঘটনায় উপত্যকায় বুধবার বন্ধ পালিত হচ্ছে। গত ৩৫ বছরে যা প্রথম। জঙ্গিহানায় নিরীহ মানুষের প্রাণ চলে যাওয়ায় বন্ধের ডাকা হয়েছে। জঙ্গিহানায় মৃত্যুর ঘটনায় এভাবে বন্ধ ৩৫ বছরে উপত্যকায় হয়নি। পহেলগাঁওয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এই বন্ধকে সমস্ত সংগঠনগুলি সমর্থন জানিয়েছে।
বন্ধের জেরে বুধবার সকাল থেকেই শ্রীনগরে দোকান, পেট্রল পাম্প সহ অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তবে জরুরি পরিষেবাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বন্ধের প্রভাব গণ পরিবহনেও পড়েছে। রাস্তায় বাস বেশ কম। তবে ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। শহরের বেসরকারি স্কুল রয়েছে বন্ধ। তবে সরকারি স্কুল খোলা রয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন। বন্ধের প্রভাব শ্রীনগর ছাড়াও অন্যান্য অংশেও পড়েছে। উপত্যকার বেশ কয়েকটি জায়গায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল কনফারেন্সও এই বন্ধকে সমর্থন জানিয়েছে। কাশ্মীরের পর্যটন সংস্থাও এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ও বন্ধকে সমর্থন জানিয়েছে। বুধবার কাশ্মীরপ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এই জঙ্গিহানায় রাগে ফুঁসছে গোটা দেশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন প্রায় সকলেই। প্রতিটা ক্ষেত্রের মানুষ একত্রে কড়া শাস্তির দাবি রাখছে। তালিকা থেকে বাদ থাকলেন না বলিউড তারকারাও। অজয় দেবগণ, সঞ্জয় দত্ত, করণ জোহর, ভিকি কৌশলসহ মুখ খুলেছেন অনেকেই। চুপ থাকলেন না শাহরুখ খান, সলমন খানও।
সোশ্যাল মিডিয়ায় শাহরুখ খান লিখলেন– “পহেলগাঁওয়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কষ্ট ও রাগ প্রকাশ্যের শব্দ নেই। এমন সময়ে, কেবলমাত্র ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য প্রার্থনা করতে পারি। আমি গভীর সমবেদনা জানাই। এক দেশ হিসেবে আমরা যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে, সাহসিকতার সঙ্গে রুখে দাঁড়াতে পরি। এই জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে যেন আমরা ন্যায়বিচার পেতে পারি।” সলমন খানের কথায়, “কাশ্মীর, ভূস্বর্গ নরক হয়ে উঠল। অসহায় মানুষদের টার্গেট করা হল। তাঁদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। একজন নিরীহ মানুষের হত্যা মানে গোটা জগতকে মেরে ফেলার সমান।”
একইসঙ্গে পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপর জঙ্গি হামলার তীব্র নিন্দা করলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করেন। সন্ত্রাসবাদ দমনে ভারতের পাশে থাকার বার্তা দেন ট্রাম্প। এক্স হ্যান্ডলে বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল একথা জানিয়েছেন।
জম্মু ও কাশ্মীর থেকে অশান্তি, জঙ্গি হামলা এবং সীমান্তে বিক্ষিপ্ত গোলমালের খবর প্রায়ই আসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কাশ্মীর বরাবরই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে। প্রতি বছর বহু মানুষ দেশের নানা প্রান্ত থেকে, এমনকি বিদেশ থেকেও ভূস্বর্গ ভ্রমণে যান। তবে মঙ্গলবারের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে। মঙ্গলবারের ঘটনার পর পহেলগাঁও তথা কাশ্মীর নিয়ে পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। যাঁদের আগামী কয়েক দিনের মধ্যে উপত্যকায় ভ্রমণের পরিকল্পনা রয়েছে, তাঁরা চিন্তায় পড়েছেন। এই মুহূর্তে সেখানে যাওয়া কতটা নিরাপদ, ভবিষ্যতেই বা পর্যটকদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কতটা, প্রশ্ন উঠেছে। ভ্রমণসংস্থাগুলিকে ফোন করে করে আপাতত সেই সম্বন্ধে খোঁজখবর নিচ্ছেন পর্যটকেরা।