নিউজ ডেস্ক: পহেলগাঁওয়ে নৃশংস হামলার জেরে পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে ভারত-পাক সম্পর্ক। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে একাধিক চুক্তি রয়েছে। তালিকায় প্রথমেই রয়েছে সিন্ধু জলচুক্তি। কিন্তু পহেলগাঁও হামলার জেরে সেই সব চুক্তি বাতিল করে পাকিস্তানের সঙ্গে অসহযোগিতার পথে হাঁটতে পারে নয়াদিল্লি। ভারত এমন সিদ্ধান্ত নিলে বড়সড় সমস্যায় পড়বে প্রতিবেশী পাকিস্তান। সবমিলিয়ে পাকিস্তানকে ভাতে মারার ছক করছে নয়াদিল্লি, এমনটাই মত বিশ্লেষকদের।
পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত-সংযুক্ত সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্র
সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওে (Kashmir Terror Attack) ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। এই হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে একজন বিদেশি নাগরিকও রয়েছেন। তদন্তে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত-সংযুক্ত সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্র প্রকাশ পাওয়ায় দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা, ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (সিসিএস), পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে।
জম্মু এবং কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিদের হত্যালীলার পর গোটা দেশে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। প্রত্যাঘাতের দাবি উঠছে দেশের সর্বত্র। বুধবার সকাল থেকে দফায় দফায় বৈঠক চলেছে নয়াদিল্লিতে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কাশ্মীর উপত্যকার বাস্তব চিত্র দেখে এসেছেন। শেষে সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে বৈঠকের পর ‘প্রত্যাঘাত’ করল ভারত। পাকিস্তানিদের ‘সার্ক’ ভিসা বাতিল, সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করা-সহ ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ পদক্ষেপ করেছে নয়াদিল্লি। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়া বন্ধ না করা পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। তবে হামলায় জড়িত জঙ্গিদের এখনও সন্ধান মেলেনি। তাঁদের খোঁজে গোটা কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে অভিযান চালাচ্ছে বাহিনী।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন পদক্ষেপ
১। সিন্ধু জলচুক্তি বাতিল
বুধবার বিদেশ সচিব বিক্রম মিসরি জানান, এই মুহূর্ত থেকে সিন্ধু জলচুক্তি বাতিল করা হল। যতদিন না পর্যন্ত পাকিস্তান সীমান্ত সন্ত্রাস থামাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এই চুক্তি কার্যকর থাকবে না।
২। বন্ধ করা হবে ওয়াঘা-আটারি সীমান্ত
এছাড়াও অবিলম্বে বন্ধ করা হবে ওয়াঘা-আটারি সীমান্ত। বৈধ কারণে যাঁরা ওই পথ দিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের ১মে’র মধ্যে ভারতে ফিরতে হবে।
৩। পাকিস্তানিদের ভিসা বাতিল
আগামী দিনে পাকিস্তানিদের ভিসা বাতিল করল ভারত। বর্তমানে যেসব পাকিস্তানিরা ভারতে রয়েছেন তাঁদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছাড়তে হবে।
৪। দুই দেশের হাই কমিশন থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে সামরিক পরামর্শদাতাদের
এছাড়াও ভারত এবং পাকিস্তান-দুই দেশের হাই কমিশন থেকেই সরিয়ে নেওয়া হবে সামরিক পরামর্শদাতাদের। পাক হাইকমিশনের এই পদগুলি ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ বলে ঘোষণা করল নয়াদিল্লি।
৫। হাইকমিশনের সামগ্রিক লোকবল কমানোর সিদ্ধান্ত
হাইকমিশনের সামগ্রিক লোকবল ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ জনে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যা ১ মে এর মধ্যে কার্যকর হবে।
পর্যটকদের উপর হামলার পরেই বৈঠকে বসে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ক্যাবিনেট কমিটি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে এই বৈঠক চলে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ছিলেন এই বৈঠকে। দীর্ঘ বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বিদেশ সচিব। সেখানেই তিনি জানান, পহেলগাম হামলার তীব্র প্রতিবাদ করে ভারত এই সিদ্ধান্তগুলি নিয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।
সিন্ধু জলচুক্তি
পহেলগাঁও হামলার জেরে যে সব চুক্তি বাতিল করেছে ভারত, সেই তালিকায় প্রথমেই রয়েছে সিন্ধু জলচুক্তি। ৯ বছরের আলোচনার পরে ১৯৬০ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় সিন্ধু জলচুক্তি সই করে ভারত ও পাকিস্তান। চুক্তি অনুযায়ী, বিতস্তা ও চন্দ্রভাগার জলের উপরে পাকিস্তানের অধিকার ৮০ শতাংশ, ভারতের ২০ শতাংশ। তবে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ভারত ওই জল ব্যবহার করলেও তা আটকাতে পারবে না পাকিস্তান। সেই চুক্তি থেকে ভারত যদি সরে আসে, তাহলে গোটা পাকিস্তানের জল সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।
দীর্ঘদিন ধরেই নয়াদিল্লির দাবি ছিল, সিন্দু জলচুক্তিতে সংশোধন করতে হবে। কারণ ভারতের নদীবাঁধ দেওয়া ইসলামাবাদের প্রবল আপত্তি। এই নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নালিশ জানানো পাকিস্তানের কূটনৈতিক কৌশল হয়ে ওঠে। গতবছর সেপ্টেম্বর মাসে এই চুক্তিতে সংশোধন চেয়ে ইসলামাদকে কড়া নোটিসও পাঠায় ভারত। তবে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা যেভাবে পহেলগাঁওয়ে হামলা চালিয়েছে, তারপরে বিশ্লেষক মহল মনে করেছিল, এবার সিন্ধু জলচুক্তি নিয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভারত। সেই অনুযায়ী বিদেশ সচিব বিক্রম মিসরি জানান, পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু চুক্তি বাতিল করা হল। যতদিন না পর্যন্ত পাকিস্তান সীমান্ত সন্ত্রাস থামাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এই চুক্তি কার্যকর থাকবে না।
সিন্ধু জলচুক্তি বাতিলের ফলে কী প্রভাব পড়বে পাকিস্তানের ওপর?
সিন্ধু জলচুক্তি বাতিল হয়ে গেলে অকূল পাথারে পড়বে পাকিস্তান। সেদেশের ৮০ শতাংশ কৃষিজমিতে জল সরবরাহ হয় এই চুক্তির মাধ্যমে। সেচের জন্য প্রয়োজনীয় জলের ৯০ শতাংশেরও বেশি আসে সিন্ধু নদ থেকে। করাচি, মুলতান, লাহোরের মতো বড় শহরগুলিতেও সিন্ধু নদের জলই ব্যবহৃত হয়। তারবেলা এবং মাংলার জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চলে সিন্ধুর জল থেকেই। গম, চাল, আখ, তুলো চাষ এবং পাকিস্তানের জিডিপির ২৫ শতাংশ নির্ভর করে এই সিন্ধুর জলের উপরেই। তাই এই চুক্তি মোতাবেক জল না পেলে পাকিস্তানের কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, জনজীবন-সবই থমকে যাবে। যেহেতু পাকিস্তানে প্রবল জল সংকট, তাই সিন্ধু নদের জল না পেলে কার্যত শুকিয়ে যাবে দেশের বিরাট অংশ। অন্যদিকে, সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করে দেওয়ার মানে তার প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষিতে। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও বাড়বে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা করে ভারত আদতে পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করে দিল। কারণ, এর আগে ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯ সালের যুদ্ধ দেখেছে এই জলচুক্তি। কিন্তু সেই সময়ও তা বাতিল বা স্থগিত করা হয়নি। এবারে সত্যি সত্যি চুক্তি বাতিল হলে পাকিস্তানের কৃষিকাজ কার্যত শেষ হয়ে যেতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে উরি হামলার পরে মোদী বলেছিলেন, “রক্ত ও জল একসঙ্গে বইতে পারে না।’’ এবার কার্যত সেই নীতিরই পুনরাবৃত্তি হল। বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত ভারতের কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করবে, বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষিতে।
ভারতের এই প্রত্যাঘাত সামলাতে বৈঠক ডাকলেন শরিফ
পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ জানিয়েছেন, দিল্লির পদক্ষেপের জবাব দিতে আজ, বৃহস্পতিবার বৈঠক করবেন সে দেশের সামরিক বাহিনী ও সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব। পাকিস্তানের তরফে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ‘ভারত যদি অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে চরম পদক্ষেপ নেয়, তা হলে পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া জানাতে পুরোপুরি সক্ষম।’ পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার তাঁর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের ঘোষণাগুলিকে ‘অনুপযুক্ত’ এবং ‘গুরুত্বহীন’ বলে বর্ণনা করেছেন। যদিও, ভারতের পাঁচটি সিদ্ধান্তে যে পাকিস্তানকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে, তেমনটাই মনে করছেন কূটনৈতিক মহলের একাংশ।
অনেকে মনে করছেন, আগামী দিনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতো বড় মাপের পদক্ষেপ করতে চলেছে ভারত। যার ইঙ্গিত দিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেন, “আমি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, সরকার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ করবে। আমরা শুধুমাত্র এই হামলার অপরাধীদেরই নয়, পর্দার আড়ালে থেকে যারা ষড়যন্ত্র করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ করব। তারা শীঘ্রই এর জোরালো এবং স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া দেখতে পাবে।’’ সূত্রের মতে, এ ক্ষেত্রেও পাল্টা হামলা হিসাবে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু একটি বিষয় নয়াদিল্লিকে মাথায় রাখতে হচ্ছে যে, ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওই ওষুধ দু’বার প্রয়োগ করা হয়েছে। ফলে পাকিস্তানও যে এ ঘটনার পরে সতর্ক, তা বলাই বাহুল্য।
অন্যদিকে, পহেলগাঁও হামলার আবহে প্রত্যেক বাহিনীকে চূড়ান্ত সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিদেশ সচিব জানান, হামলাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। তাহাউর রানার প্রত্যর্পণের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যারা সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তাদের দমনে নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ভারত। বৃহস্পতিবার এই ইস্যুতে সর্বদল বৈঠক ডেকেছে কেন্দ্র। সেখানে সভাপতিত্ব করবেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।