নিউজ ডেস্ক: জঙ্গল নয়, বৈসরণের মূল ফটক দিয়েই ঢুকেছিল জঙ্গিরা। পর্যটকরা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি পাশেই ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছিল মৃত্যু। কাশ্মীর হামলার পর জঙ্গিদের খোঁজে উপত্যকা তোলপাড় করে ফেলছে নিরাপত্তা বাহিনী। আর এরইমধ্যে এক জঙ্গির সম্পর্কে জানা গেল চাঞ্চল্যকর তথ্য। পহেলগাঁওয়ের হামলাকারীদের মধ্যে এক জঙ্গি আসিফ। এই আসিফ খচ্চরের সহিস সেজেছিল। এক পর্যটকের ফোনেই মিলল জঙ্গির ছবি। তিনিই জানালেন কীভাবে তাদের ধর্ম জানার চেষ্টা করা হচ্ছিল।
ফোনেই জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা?
পহেলগাঁওতে বেছে বেছে হিন্দু নিধন করা হয়েছে। গুলি চালানোর আগে জঙ্গিরা জেনেছে নাম পরিচয় ও ধর্ম। পরিচয় নিশ্চিত করতে পুরুষদের প্যান্ট খোলানো হয়। তারপরই মাথায় গুলি। একতা তিওয়ারি নামক এক পর্যটক মুখোমুখি হয়েছিলেন আসিফের। তাঁর সঙ্গে বচসাও হয়। তবে তখনও তারা জানতেন না কিছুক্ষণ পর এই আসিফই গুলি করে হত্যা করবে। একতা জানান, তাঁর কাছে যখন ধর্ম জানতে চাওয়া হয়েছিল, তখনই তিনি আসিফের ছবি তুলে রাখেন ফোনে। আসিফ নামের ওই জঙ্গি কাছে লুকানো ছিল মোবাইল। সেই ফোনেই জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলছিল বলেও জানান তিনি।
একতা আরও বলেন, “এই সময়ই জঙ্গি আসিফের কাছে ফোন আসে। পায়ে মোজায় লুকানো ছিল ওই মোবাইল। ফোনে কথা বলার সময় আসিফ বলে, ২০ জনের গ্রুপ আসছে। ব্রেক ফেল হয়নি, প্ল্যান বি। ৩৫টা বন্দুক আমি ঘাঁটিতে পাঠিয়ে দিয়েছি, আর পুরো বাক্স পাঠাচ্ছি।” আর এই খবর প্রকাশ্যে আসার কিছু সময়ের মধ্যেই এই জঙ্গির বাড়ি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়। সূত্রের খবর, প্রশাসনের তরফেই এই পদক্ষেপ করা হয়েছে।
জঙ্গি আসিফ ও আদিলের বাড়িই বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিল সেনা
উল্লেখ্য, ২২ এপ্রিলের জঙ্গি হানায় যে চারজন জঙ্গি যুক্ত ছিল, তার মধ্যে দুইজন কাশ্মীরেরই বাসিন্দা। একজনের নাম আদিল গুরে ও অন্যজনের নাম আসিফ শেখ। আদিল অনন্তনাগের বাসিন্দা। আসিফের বাড়ি জম্মু-কাশ্মীরের ত্রালে। বৃহস্পতিবার রাতে আসিফ শেখের বাড়িতে তল্লাশি চালায় সেনাবাহিনী। তল্লাশি চলাকালীনই তাদের নজরে আসে যে বাড়িতে বিস্ফোরক জাতীয় কিছু মজুত করা রয়েছে। সেনাবাহিনীকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা আশঙ্কা করেই তড়িঘড়ি সেনারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। বাড়ি থেকে বেরতেই বিস্ফোরণ হয়।
আসিফের পর আরেক লস্কর-ই-তৈবা জঙ্গি আদিল ঠোকারের বাড়িও বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়। দক্ষিণ কাশ্মীরের বিজবেরায় বাড়ি ছিল তাঁর। পহেলগাঁওয়ের বৈসরণে জঙ্গিহানায় তাঁর ভূমিকা সামনে আসতেই প্রশাসনের তরফে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
রাতভোর ভারতে লক্ষ্য করে গুলি, পাল্টা জবাব দিচ্ছে সেনাও
তবে এত কিছুর পরেও থামছেনা পড়শি দেশ। বেড়েই চলেছে বেয়াদপি। জম্মু-কাশ্মীরের জঙ্গি হানার পর ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ভারত। কিন্তু এরপরেও বৃহস্পতিবার রাতভর নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে পাকিস্তানি পোস্টগুলি থেকে ভারতে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। তবে চুপ করে থাকেনি ভারতীয় সেনাবাহিনীও। গুলির জবাব গুলি দিয়েই দিয়েছে তারা।
সেনা সূত্রে জানা গিয়েছে, গতকাল রাতভর পাকিস্তানের দিক থেকে গুলি উড়ে এসেছে। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর যে পাকিস্তানি পোস্ট বা ঘাঁটি রয়েছে, সেখান থেকেই গুলি চালানো হয়েছে। ভারতীয় সেনাও পাল্টা জবাব দিয়েছে পাকিস্তানকে। গুলির লড়াইয়ে ভারতের দিকে কোনও হতাহতের খবর মেলেনি। পাকিস্তানে কোনও প্রাণহানি হয়েছে কি না, তা এখনও জানা যায়নি। তবে সীমান্তে এই ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও বারবার সংঘর্ষ বিরতি লঙ্ঘন করেছে পাকিস্তান। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই জম্মু-কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলায় ভারতীয় পোস্ট লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল পাক সেনা। সেই সংঘর্ষেও কোনও প্রাণহানি হয়নি।
সংবাদ সংস্থা এএনআই সূত্রে খবর, বান্দিপোরা জেলার অজাজ এলাকায় কুলনার বাজিপোরা জঙ্গলে ভারতীয় সেনার তল্লাশি অভিযানের সময় গুলির শব্দ শোনা গেছে। এক থেকে দু’জন জঙ্গি ওই জঙ্গলে লুকিয়ে রয়েছে। এই খবর পেয়েই জঙ্গল ঘিরে ফেলে অভিযান চালায় ভারতীয় সেনা। গুলির লড়াইয়ের পর ওই দুই জঙ্গিকে জওয়ানরা ধরে ফেলেছে বলেও অনুমান করা হচ্ছে। বৈসরনে হামলাকারী জঙ্গিদের খোঁজ দিতে পারলে ২০ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। জঙ্গলে জঙ্গলে চলছে চিরুনি তল্লাশি।
কাশ্মীর যাচ্ছেন সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী
পহেলগাঁওয়ে এই নারকীয় সন্ত্রাসবাদী হামলার পর পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আজ কাশ্মীর যাচ্ছেন সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। জানা গিয়েছে, প্রথমে শ্রীনগরে যাবেন দেশের সেনাপ্রধান। সেখানে পদস্থ সামরিক কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করবেন তিনি। পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় যেখানে নির্বিচারে হত্যালীলা চালানো হয়েছে, সেই ঘটনাস্থল পরিদর্শনেও যেতে পারেন সেনাপ্রধান। সংবাদ সংস্থা এএনআই সূত্রে খবর, ঘটনার পর থেকে জঙ্গি হামলা দমনে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এলওসি (LOC) বরাবর সুরক্ষা ব্যবস্থা কতটা জোরদার করা হয়েছে, আজ সেনাপ্রধানকে সে বিষয়ে ব্রিফ করবেন স্থানীয় সামরিক কর্তারা। জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীর সফরে উপস্থিত থাকবেন ফিফটিন কর্পস ও রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের কমান্ডাররা।
বৈসরনের মতো পর্যটকে ঠাসা একটা জায়গায়, দিনেদুপুরে জঙ্গিরা ঢুকল, বেছে বেছে হিনদুদের আলাদা করল, গুলি চালিয়ে হত্যা করল, তারপর পালিয়ে গেল। তা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। পাকিস্তান থেকে ভারতে ঢুকে জঙ্গিরা এতবড় ছক কষল, আর নিরাপত্তাবাহিনী কিছুই টের পেল না কেন? গোয়েন্দা এজেন্সির তরফে হামলার আশঙ্কা থাকলেও তা ঠেকানো গেল না কেন? ২৬ জনের মৃত্যুর দায় কে নেবে? উঠছে এ প্রশ্নও।
পহেলগামের এই হামলার ষড়যন্ত্রের মূল মাথা কে?
মুখ বন্ধ রাখলেও পহেলগাওঁয়ের বৈসরণে নৃশংস জঙ্গি হামলার দায় অস্বীকার করতে পারবে না পাকিস্তান। জম্মু-কাশ্মীরে পর্যটকদের উপরে প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে পাক মদতপ্রাপ্ত লস্কর-ই-তৈবার শাখা সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট। বেছে বেছে হিন্দু নিধন করা হয়েছে। এই হামলার যোগ্য জবাব দিতে ইতিমধ্যেই সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করেছে ভারত সরকার। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে- কার নির্দেশে এই হামলা চালানো হয়েছিল? পাকিস্তানের একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজরই বোমা ফাটালেন এই নিয়ে। আঙুল তুললেন সোজা পাক সেনা প্রধানের দিকেই।
পাকিস্তান সেনার প্রাক্তন মেজর আদিল রাজা, যিনি এক সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রেও লড়েছেন, তিনিই নিজের দেশের সেনা প্রধানের বিরুদ্ধে বোমা ফাটিয়েছেন। তাঁর দাবি, পাকিস্তানের সেনা প্রধান জেনারেল আসিম মুনির হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-কে। পহেলগামের এই হামলার ষড়যন্ত্র করেছেন তিনিই। গোয়েন্দা সূত্রেই খবর পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন পাক প্রাক্তন মেজর।
তবে এই একই দাবি করেছেন ভারতীয় সেনা আধিকারিকরাও। এক সাক্ষাৎকারে প্রাক্তন সেনা কর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল দেবেন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডে সরাসরি জেনারেল আসিম মুনিরের দিকেই আঙুল তোলেন। তিনি বলেন,”আমি পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করি যে আসিম মুনির এর (পহেলগাঁও জঙ্গি হামলা) পিছনে রয়েছে। পাকিস্তানি সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনীই সন্ত্রাসবাদের পরিচালক। সন্ত্রাসবাদের তিনটে স্তর রয়েছে। একটি স্তরে জঙ্গি ক্যাম্প ও পরিকাঠামো রয়েছে। তবে এর পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আসিম মুনির ও আইসিস।” তাহলে সত্যিই কি পাক সেনা প্রধান আসিম মুনিরই নির্দেশ দিয়েছিলেন পহেলগাঁওয়ে বেছে বেছে হিন্দু নিধনের? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।