নিউজ ডেস্ক: বঙ্গোপসাগরের তীরে আরও এক জগন্নাথ ধাম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাত্র আর কয়েকটা দিন। তারপরেই মহা ধুমধামে উদ্বোধন হবে বঙ্গোপসাগরের তীরে দিঘায় গড়ে ওঠা জগন্নাথ ধামের। তবে কাশ্মীরের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে দিঘায় জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধনে কোনও নিরাপত্তায় কোনও খামতি রাখতে চাইছে না প্রশাসন। একদিকে যেমন নতুন মোড়কে সেজে উঠছে দিঘা, তেমনই ২৮,২৯ ৩০ – এপ্রিল শেষের এই তিনদিনকে টার্গেট করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশি টহল পুরোদমে চলছে এখন থেকেই।
দিঘায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা
২৮ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের মহাযজ্ঞ ও উদ্বোধন উপলক্ষে প্রচুর মানুষের সমাগম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেকারনেই জগন্নাথ মন্দির-সহ গোটা দিঘার নিরাপত্তায় ২ হাজারের বেশি পুলিশ থাকছে। একইসঙ্গে জোর দেওয়া হচ্ছে নাকা চেকিংয়ে। বিশেষত, যে পয়েন্টগুলি থেকে দিঘায় ঢোকা ও বের হওয়া যায় সেই জায়গাগুলিতে চেকিংয়ে আলাদা করে নজর রাখা হচ্ছে। প্রায় গোটা সৈকত নগরীই সিসিটিভি-তে মুড়ে ফেলা হচ্ছে। অন্যদিকে শুধু মন্দিরের নিরাপত্তায় ‘স্পেশ্যাল ট্রেনড’ সশস্ত্র পুলিশ খাকছে। জেলা পুলিশ সুপার সৌম্যদীপ ভট্টাচার্য বলছেন, জগন্নাথ মন্দির-সহ সামগ্রিকভাবে দিঘার নিরাপত্তায় ২ হাজারের বেশি ফোর্স থাকছে। তারমধ্যে হাইওয়েতে নাকা চেকিং থেকে ওয়াচ টাওয়ারে থাকছে পুলিশ।
এছাড়াও মোট ১০০জন দমকল কর্মীকে ওইদিন দিঘায় রাখা হচ্ছে। ডিজি এখানে থাকবেন। তার সঙ্গে মোট ১৫ জন উচ্চপদস্থ অফিসার এবং ১৫ জন ইন্সপেক্টর দিঘায় থাকবেন। পাঁচটি অস্থায়ী হেলিপ্যাড ও পাঁচটি পার্কিং জোন থাকছে। এখানে এখন ৬ হাজার চেয়ার পাতার কাজ চলছে। ৩০০টি কুলার থাকছে। আলোয় সেজে উঠেছে গোটা এলাকা। একইসঙ্গে নিয়োগ করা হবে ১০০ জন সিভিক ভলান্টিয়ারও।
কী চলছে এই মুহূর্তে দিঘায়?
ইতিমধ্যেই মন্দির নির্মাণের কাজ শেষ, এখন উদ্বোধনের প্রস্তুতি ঘিরে ব্যস্ততা তুঙ্গে প্রশাসনিক মহলে। প্রতিদিন বিভিন্ন আধিকারিকেরা দিঘা জগন্নাথ মন্দির পরিদর্শন করছেন। আর উদ্বোধনের আগে মন্দিরের সামনে রাস্তায় ধুলো সরাতে বিশেষ ব্যবস্থা প্রশাসনের। দিঘার জগন্নাথ মন্দির দিঘার চেনা পর্যটনকেই বদলে দেবে। সৈকত নগরীর বুকে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে দিঘা জগন্নাথ ধাম ও সংস্কৃতি কেন্দ্র। আসন্ন উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে ঘিরে পুরোদস্তুর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। দিঘা জুড়ে এখন উৎসবের মেজাজ।
মন্দির উদ্বোধনের দিনে আয়োজন হয়েছে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। আসবেন শিল্পপতি থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই। প্রশাসনের অনুমান, প্রায় সাড়ে ছয় হাজার লোক আসতে পারেন সেখানে। এছাড়াও, শিল্পপতিদের জন্যও তৈরি করা হয়েছে একটি কনভেনশন সেন্টার। জরুরীকালীন পরিস্থিতির জন্য থাকবে জলের ব্যবস্থা, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং অ্যাম্বুল্যান্স। জানা গিয়েছে, উদ্বোধনের ঠিক একদিন আগে অর্থাৎ ২৯ তারিখ দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে প্রভুর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে। তারপর দিন ৩০ তারিখ দুপুর আড়াইটের সময় উদ্বোধন হবে মন্দিরের। ৩.১০ মিনিট নাগাদ হবে দ্বারোদ্ঘাটন। ঘোটা প্রক্রিয়ায় থাকবেন পুরীর রাজেশ দৈত্যাপতি।
অন্যদিকে, দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সম্প্রচার যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিল রাজ্য সরকার। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, প্রতিটি ব্লক এবং পুরসভা এলাকায় সেই বন্দোবস্তের জন্য ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসনগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে নবান্নের সর্বোচ্চ মহল। এ জন্য পৃথক খরচও দেওয়া হবে জেলা প্রশাসনগুলিকে। ২০২৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে এই জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধন ঘিরে প্রশাসনের তৎপরতাকে অর্থবহ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
জেলাজুড়ে এলইডি স্ক্রিনের ব্যবস্থা
তবে অনেকেই এই উদ্বোধনের অনুষ্ঠান দেখতে পাবেন না। কারণ সবার পক্ষে দিঘায় আসা সম্ভব নয়। আবার যাঁরা পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় থাকেন সেইসব বাসিন্দারাও দিঘায় উপস্থিত থাকতে পারবেন না। কারণ অতিরিক্ত মানুষজন সেখানে তখন ঢুকতে দেওয়া হবে না। তাই তাঁদের কথা ভেবে বড় সিদ্ধান্ত নিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন।
জানা গিয়েছে, জায়ান্ট স্ক্রিন লাগানো হচ্ছে জেলাজুড়ে। যাঁরা আসতে পারবেন না অথবা ভিড় ঠেলতে চাইবেন না গরমে তাঁরা যাতে বাড়িতে বসে গোটা উদ্বোধনের অনুষ্ঠান চাক্ষুষ করতে পারেন। পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষজন সরাসরি জায়াট স্ক্রিনের মাধ্যমে সমস্ত মানুষজনকে দেখানো হবে। পথচলতি মানুষ থেকে এলাকার মানুষজন বিনা ভিড় ঠেলে তা দেখতে পাবেন। তাই প্রত্যেকটি ব্লকের বিডিওকে এই ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজী। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ২৫টি ব্লক এবং পাঁচটি পুরসভায় এখন সেই প্রস্তুতিই চলছে। নানা হলঘরে গিয়ে যাতে মানুষ নিশ্চিন্তে বসে জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনের অনুষ্ঠান দেখতে পায় সেই ব্যবস্থা চলছে। এই বিষয়ে জেলাশাসক বলেন, ‘জেলাজুড়ে এলইডি স্ক্রিন বসানো হচ্ছে। যার সাহায্যে জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সরাসরি দেখানো হবে।’
প্রসঙ্গত, ২৮ তারিখ দিঘায় যেতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী। ২৯ মহাযজ্ঞ, ৩০ তারিখ মন্দিরের উদ্বোধন। তাই এই তিনদিনে বিশেষ নজর থাকছে পুলিশের। এমনিতে গরমের এই সময়ে দিঘায় পর্যটকদের ভিড় তো থাকেই কিন্তু এবার মন্দির উদ্বোধনের জন্য ভিড়টা আরও বেড়েছে। তাই ভিড় সামাল দিতে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, ভিড়ের মাঝে যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে যায় সেদিকে সদা নজর প্রশাসনের। রাতেও চলছে পুলিশি টহল। নজরদারি চলছে সিসিটিভিতেও।
দিঘায় এবার পর্যটনের সঙ্গে মিশে যাবে আধ্যাত্মিকতা
পুরীর মন্দিরের উচ্চতায় কলিঙ্গ স্থাপত্ব ও নাগর শৈলীতে তৈরি হয়েছে দিঘার জগন্নাথ মন্দির। যার কারণে পুরীর মন্দিরের সঙ্গে অনেকটাই মিল রয়েছে দিঘার মন্দিরের। পুরীর আদলে নির্মিত দিঘা জগন্নাথ মন্দিরের উচ্চতা ৬৫ মিটার বা ২১৩ ফুট। পুরীর মন্দিরের মতো দিঘার মন্দিরের প্রথমে রয়েছে ভোগ মণ্ডপ। ভোগ মণ্ডপের ৪টি দরজা। ভোগ মণ্ডপের পর রয়েছে নাট মন্দির। ১৬টি স্তম্ভের উপর এই নাট মন্দির তৈরি করা হয়েছে। এই নাট মন্দিরে রয়েছে দুটি বড় ও দুটি ছোট দরজা। নাট মন্দিরের পর রয়েছে জগমোহন। এই জগমোহন ৪টি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। জগমোহনের পর রয়েছে গর্ভগৃহ বা মূল মন্দির। যেখানে সিংহাসনের উপর জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার মূর্তি পুজো হবে। ভোগ মণ্ডপ ও নাট মন্দিরের মাঝে রয়েছে গড়ুর স্তম্ভ। নাট মন্দিরের দেওয়ালে রয়েছে কালো পাথরে তৈরি ছোট ছোট দশাবতার মূর্তি। শুধু তাই নয় মন্দিরের পাথরের দেওয়ালে জুড়ে রয়েছে পাথরের কারুকার্য। পুরীর মন্দিরের মতো দিঘার মন্দিরে ও থাকছে লক্ষী মন্দির, জগন্নাথের ভোগ রান্নার জন্যে আলাদা ভোগশালা। তবে পুরীতে ভোগশালাতে রান্না পাহাড়ের ঝর্ণার জল বা গঙ্গা জলে করা হলেও দিঘাতে বা দিঘার আশপাশে পাহাড় না থাকায় রান্নার জন্যে বিকল্প জলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পুরীতে যে ভাবে ভোগ রান্না হয় এখানেও সেই ভাবে ভোগ রান্না করা হবে। শুধু তাই নয় প্রতিদিন মন্দিরের চূড়ায় ধ্বজা পরিবর্তনও করা হবে নিয়ম মেনে।
আর সমুদ্র থেকে প্রায় ৩৭০ মিটার উত্তরে এই মন্দিরের ভৌগলিক অবস্থান আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে দিঘার উপকূলীয় সৌন্দর্যকে। এই মন্দির ঘিরে আরও বিকশিত হচ্ছে সমুদ্র শহরের পর্যটন শিল্পও। আর সেই পর্যটনের সঙ্গে মিশে যাবে আধ্যাত্মিকতা।
দীঘার সমুদ্রে ভেসে এল কাঠের প্রভু জগন্নাথ
উল্লেখ্য, মন্দির উদ্বোধনের আগেই সম্প্রতি দীঘার সমুদ্রে ভেসে এল কাঠের প্রভু জগন্নাথ। দিঘার মাইতি ঘাটের কাছে উদ্ধার হয়েছে জগন্নাথ দেবের একটি কাঠের মূর্তি। যা ঘিরে ইতিমধ্যেই দিঘা জুড়ে যথেষ্ট ধর্মীয় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। জানা গিয়েছে, মাইতি ঘাটের পাশেই আরও একটি ঘাট নির্মাণের কাজ করছিলেন শ্রমিকরা। তখনই সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তটে এসে পড়ে জগন্নাথ দেবের কাঠের মূর্তিটি। যা দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে যান কর্মরত শ্রমিকরা।
জগন্নাথ ধামের উদ্বোধনের আগে এমনভাবে সমুদ্র থেকে জগন্নাথ দেবের কাঠের মূর্তি ভেসে আসাকে অনেকেই এক অলৌকিক ইঙ্গিত বা দৈব সংকেত বলে মনে করছেন। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এমন ঘটনা ঈশ্বরের উপস্থিতির বার্তা। যে সময়ে মন্দিরের উদ্বোধনের প্রস্তুতি চলছে, আর যে ঘাটে কাজ হচ্ছে সেই ঘাটেই এমনভাবে মূর্তি ভেসে ওঠা সত্যিই অনেক প্রশ্ন এবং ভাবনার জন্ম দিয়েছে। স্থানীয়দের আবেগ, দর্শনার্থীদের আগ্রহ- সব মিলিয়ে দীঘা এখন যেন এক পবিত্র স্থানের রূপ নিয়েছে বলে মনে করছেন ধর্ম প্রাণ হিন্দুরা।