নিউজ ডেস্ক: সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ভারতের পক্ষ থেকে সিন্ধু জল চুক্তি এবং ‘তার জবাবে’ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সিমলা চুক্তি স্থগিত নিয়ে দুই দেশেই ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো দুই দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই দুই চুক্তির কতটা গুরুত্ব রয়েছে।
সিমলা চুক্তি কী?
সিমলা চুক্তি এমন একটা আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছিল যেটিকে দুই দেশের মধ্যে ‘শত্রুতা’ অবসানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের পর ১৯৭২ সালের জুলাইতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এই চুক্তি। তার মাস ছয়েক আগেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পাকিস্তানের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪৫ হাজার সৈন্য এবং আধাসামরিক বাহিনীসহ ৭৩ হাজার যুদ্ধবন্দি ভারতের কারাগারে ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় পাঁচ হাজার বর্গমাইল এলাকাও ভারতের দখলে ছিল।
এই পটভূমিতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের হিমাচল প্রদেশের সিমলায় বৈঠক করছিলেন। সেখানে যে সমঝোতা হয় তার নাম সিমলা চুক্তি। চুক্তির দলিল স্বাক্ষরের তারিখ রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৭২ সালের দোসরা জুলাই। তবে বাস্তবে তেসরা জুলাই সকালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এই চুক্তি। দুই দেশের মধ্যে ‘শত্রুতার’ অবসানের পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সিমলা চুক্তির বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল। সিমলা চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব সমস্যার সমাধান করবে।
সিমলা চুক্তির অধীনে দুই দেশের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) গঠিত হয়। সেই সময় ভারত-পাকিস্তান দুইপক্ষই এই নিয়ন্ত্রণ রেখাকে সম্মান জানাতে রাজি হয়। তারা এই বিষয়েও সম্মত হয়েছিল যে দুইপক্ষই কোনোরকম একতরফা সিদ্ধান্ত নেবে না। নিয়ন্ত্রণ রেখাকে স্কেল হিসেবে বিবেচনা করে একে অপরের ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান।
‘মৃত চুক্তি’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) সিনিয়র ফেলো সুশান্ত সারিন পাকিস্তান বিষয়ক পর্যবেক্ষক। তার মতে, সিমলা চুক্তি থেকে পাকিস্তানের বেরিয়ে যাওয়া মোটেও ভারতের জন্য কোনো ‘ধাক্কা’ নয়। তিনি বলেছেন, “কাশ্মীর ইস্যুতে বড় সিদ্ধান্ত নিতে বরং এটা ভারতকে সাহায্য করবে। মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তান অনেক আগেই সিমলা চুক্তি থেকে সরে এসেছে। পাকিস্তান কখনোই এই চুক্তিতে অটল থাকেনি।”
“পাকিস্তান যদি এই চুক্তি মেনে নিত, তাহলে তারা কার্গিলের যুদ্ধ করত না। প্রতিদিন আমরা সীমান্তের ওপার থেকে গুলি চালাই না এবং সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়ও দেই না। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান যদি মৃত চুক্তির সৎকার করতে চায়, তাহলে তা করুক।”
ভারতের ওপর প্রভাব পড়বে?
জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল কি সিমলা চুক্তির লঙ্ঘন?
এই প্রশ্নের উত্তরে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক মহেন্দ্র পি লামা বলেছেন, “৩৭০ ধারা বিলোপের বিষয়টি সিমলা চুক্তির লঙ্ঘন ছিল না। ৩৭০ ধারা ভারতীয় সংবিধানের বিষয় ছিল এবং সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতা সংসদের রয়েছে।” তার মতে, সিমলা চুক্তি স্থগিত হলে তার প্রভাব ভারতে পড়বে না।
অধ্যাপক মহেন্দ্র লামা বলেন, “পাকিস্তান সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে ভারতের ওপর তার কোনো প্রভাব পড়বে না। এমনিতেও পাকিস্তানকে মোকাবিলা করা যাবে এবং সেটা শুধু বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, সিমলা চুক্তির মাধ্যমে নয়।” “সিমলা চুক্তির এখন কোনো অর্থ নেই। পাকিস্তান প্রতিদিনই তা লঙ্ঘন করছে। সুতরাং এটা ভালো বিষয় যে তারা এখন চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসছে।”
সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের ‘জবাবে’ সিমলা চুক্তি স্থগিত, ভারতে কতটা প্রভাব?
এখন প্রশ্ন হলো সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসা কতটা উপযুক্ত জবাব? এই প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক মহেন্দ্র পি লামা বলছেন, “সিমলা চুক্তি ইতিমধ্যেই মৃত, অথচ সিন্ধু জল চুক্তির প্রতিটা লাইন এখনও জীবিত। একটা মৃত চুক্তির সঙ্গে একটা জীবন্ত এবং কার্যকর চুক্তির তুলনা হতে পারে না। পাকিস্তানের জনগণ সেই চুক্তি স্থগিত করার কথা বলছেন, যা তারা নিজেরা অনেক আগেই হত্যা করেছে।”
অধ্যাপক লামা বলছেন, “সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের ফলে পাকিস্তানের ওপর খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশেরও বেশি প্রভাবিত হবে কারণ সিন্ধু নদের ৭০ শতাংশ জল পাকিস্তানে যায়।” “পাকিস্তানের কৃষিপণ্যের ৮০ শতাংশেরও বেশি সিন্ধু জল চুক্তির জলের ওপর নির্ভর করে। এই জল বন্ধ করা গেলে পাকিস্তানের মানুষকে বেশ সমস্যায় পড়তে হবে।”