নিউজ ডেস্ক: শুধু সময়ের অপেক্ষা। খুব শীঘ্রই শুরু হতে চলেছে শিয়ালদহ থেকে এসপ্লেনেড পর্যন্ত মেট্রো পরিষেবা। রবিবার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ওই অংশে ২.৪ কিলোমিটার মেট্রো রুট পরিদর্শন করল কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি। এই লাইন যাচাই পর্বে অংশগ্রহণ করেছিলেন কলকাতা মেট্রোর শীর্ষ আধিকারিকরাও। এদিন ভূ-গর্ভের নিরাপত্তা, বউবাজারের তলায় বারবার করে বিপর্যয় ঘটে যাওয়া অংশে কী অবস্থা হয়ে রয়েছে, কম্পনরোধী যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেগুলি পর্যাপ্ত কিনা, এই প্রতিটি বিষয়ই খতিয়ে দেখেন আধিকারিকরা।
প্রসঙ্গত, কয়েক মাস আগেই বউবাজারের যে অংশে বিপর্যয় হয়েছিল, সেখান দিয়ে চলে মেট্রো রেক। ২০১৯ সালে এই অংশে ভূগর্ভস্থ লাইন নির্মাণ করতে গিয়ে প্রায় চারবার বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছিল। যার জেরে আদৌ হাওড়া-সেক্টর ৫ মেট্রো প্রকল্পের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে কিনা সেই নিয়েও উঠে গিয়েছিল প্রশ্ন। কিন্তু অবশেষে কেটেছে ‘অভিশাপ’। ফুটেছে নতুন আলো।
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এসপ্লেনেড হয়ে জুড়ে যাবে এই নতুন রুট
বউবাজারের তলায় বারবার করে বিপর্যয় ঘটেছে। এদিন ওই অংশে মেট্রো লাইন, সুড়ঙ্গ, সুড়ঙ্গে হাওয়াবাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, ট্রেন, আপৎকালীন ব্যবস্থা সমস্ত কিছু দেখে অন্তিম ছাড়পত্র দেন কলকাতা মেট্রোর শীর্ষ আধিকারিক। মেট্রো কর্তৃপক্ষের সূত্রের খবর, এসপ্ল্যানেড থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত মেট্রো সংযোগের অংশে কোনও রকম ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া যায়নি।পরিদর্শনের পর জানিয়েছেন কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি সুমিত সিঙ্ঘল। সেই ভিত্তিতে মেট্রো আধিকারিকদের অনুমান, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এসপ্লেনেড হয়ে জুড়ে যাবে এই নতুন রুট। যা জুড়বে হাওড়া ময়দানে। তার ফলে স্বপ্নপূরণ হবে হাওড়া প্রান্ত থেকে আসা অফিস যাত্রীদের। এই রুট চালু হলে হাওড়া এলাকার যাত্রীরা পৌঁছে যেতে পারে সেক্টর ৫-এ। ইতিমধ্যেই হাওড়া ময়দান থেকে এসপ্লেনেড পর্যন্ত মোট ৪.৮ কিলোমিটার রুটে যাত্রী পরিষেবা সচল রয়েছে।
আপাতত ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো করিডরের দুটি পৃথক অংশে পরিষেবা চালু আছে। একদিকে হাওড়া ময়দান থেকে এসপ্ল্যানেড মেট্রো চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে মেট্রো চলছে শিয়ালদা থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত। কিন্ত বউবাজারের বিপর্যয়ের কারণে এই রুটে আটকে ছিল। বৌবাজারে ধসের কারণে শিয়ালদা থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত অংশে পরিষেবা চালু করা যায়নি। তবে এবার দীর্ঘ বাঁধা পেরিয়ে এই রুটের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। রবিবার এসপ্ল্যানেড-শিয়ালদা অংশ পরিদর্শনে আসেন সিআরএস। মেট্রো সূত্রে খবর, প্রাথমিকভাবে ওই অংশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সিআরএস। পরিদর্শনের পরে আপাতত সিআরএসের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে মেট্রো কর্তৃপক্ষ। সিআরএসের অনুমোদন পেলেই নির্ধারণ করা হবে যে কবে থেকে বাণিজ্যিকভাবে শিয়ালদা এবং এসপ্ল্যানেডের মধ্যে মেট্রোর পরিষেবা শুরু করা যাবে।
বউবাজার বিপর্যয়
২০১৯-এর ৩১ অগাস্ট, ২০২২-এর ১১ মে… তারপর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের কাজের জন্য, এইভাবে বারবার বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বউবাজার। ২০১৯-এর ৩১ অগস্ট ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সুড়ঙ্গ খোঁড়ার সময়ে বউবাজারে হওয়া বিপর্যয়ের জেরেই পাড়া ছাড়তে বাধ্য হন প্রায় ৭০০ বাসিন্দা। ২০১৯ সালের জুলাইয়ের শেষের সেই ভোর, আতঙ্ক তৈরি করে দিয়েছিল বউবাজারকে ঘিরে। দূর্গা পিতুরী লেন, স্যাকরা পাড়া লেন, একের পর এক বাড়ি ভেঙে পড়ছে। ধ্বসে যাচ্ছে বাড়ির একাংশ। ফাটল চওড়া হচ্ছে নানা বাড়ির ৷ এই ছবি ধরা পড়েছিল বউবাজার জুড়ে ৷
এরপর আবারও একই ঘটনা ঘটে ২০২২ সালের ১১ মে, কলকাতা শহরের বউবাজারে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের নির্মাণ কাজের সময় ধস নামে। এই ধসে বেশ কিছু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বাসিন্দারা ঘরছাড়া হয়ে যান। আসলে মেট্রো প্রকল্পের কাজের জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে দুর্বল মাটির কারণে এই ধস নেমেছিল। ধসের ফলে সেসময়ে বউবাজারের বহু বাড়ির দেওয়াল এবং কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সুড়ঙ্গে লিকেজের কারণে ফের মধ্যরাতে ৫২ জন বাসিন্দাকে সরিয়ে দেওয়া হয় অন্যত্র। এরপর KMRCL -এর আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে গেলে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের ঘিরে চলে বিক্ষোভ। এর পর স্থানীয় কাউন্সিলরের নেতৃত্বে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট অবরোধ করেন এলাকার বাসিন্দারা। মিছিল করে বউবাজারের বাসিন্দারা জমায়েত করেন সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনে। ভিতরে ঢুকে বসে পড়েন তাঁরা। ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রবল উত্তেজনা ছড়ায় মেট্রো স্টেশনে। আটকে পড়েন যাত্রীরা।
কংক্রিটের সুড়ঙ্গের মধ্যেই বসানো হয় লোহার পাত
বারবার বিপর্যয়ের পর প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় মেট্রো প্রকল্পের একাংশের ভবিষ্যৎ। আর এই প্রেক্ষাপটেই আগামীদিনে কোনওরকম বিপদ এড়াতে বউবাজার এলাকায়, কংক্রিটের সুড়ঙ্গের মধ্যেই বসানো হয় লোহার পাত। আসলে ২০১৯-এর ৩১ অগাস্ট এই সুড়ঙ্গেই জল ও কাদা ঢুকে যাওয়ার বিপর্যয় ঘটেছিল। বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছিল বহু বাড়িতে। ধসে পড়েছিল অনেক বাড়ি। এরপর গত সেপ্টেম্বর মাসেও, নির্মীয়মাণ টানেলের একাংশের দেওয়াল ফেটে জল ঢুকতে শুরু করায়, ফের ব্যাহত হয় কাজ। আতঙ্ক দেখা দেয় এলাকাবাসীর মধ্যে। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতেই, কংক্রিটের সুড়ঙ্গে বসানো হয় লোহার পাত।
তবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানা বাধা আসলেও কাজ থামায়নি মেট্রো৷ সমাধান খুঁজে বার করতে বউবাজারেই দূর্গা পিতুরী লেনে তৈরি করা হয় বিশালাকার চৌবাচ্চা বা শ্যাফট। যেখান দিয়েই শুরু হয় বউবাজারে কাজ শেষ করার চ্যালেঞ্জ৷ সেই কাজ করতে গিয়েও বারবার বাধা এসেছে৷ কখনও সুড়ঙ্গর মধ্যে জল ঢুকে গিয়েছে৷ কখনও আবার মাটির ওপরে নানা বাড়িতে নতুন করে ফাটল ধরেছে। অবশেষে সব জটিলতা কাটিয়ে শেষ হল বউবাজারে মাটির নীচে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সব কাজ৷
মেট্রো সূত্রে খবর, বউবাজারে ঘিরে বারংবার পরিস্থিতি জটিল হলেও, আজকের পরিদর্শনে এসপ্ল্যানেড থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত মেট্রো সংযোগের অংশে কোনও রকম ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া যায়নি। সেই ভিত্তিতে মেট্রো আধিকারিকদের অনুমান, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এসপ্লেনেড হয়ে জুড়ে যাবে এই নতুন রুট। যা আবার গিয়ে জুড়বে হাওড়া ময়দানে। অন্যদিকে, শিয়ালদহ থেকে আবার সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত মেট্রো অব্যাহত। জটিলতা তৈরি হয়েছিল মাঝের অংশে। ‘কাঁটা’ বউবাজারের জেরে কিছুতেই শুরু করা যাচ্ছিল না এসপ্লেনেড-শিয়ালদহ রুট। এবার সেই স্বপ্নই হতে চলেছে সফল।
কবে চালু হবে এই নয়া রুট?
তবে কবে চালু হবে এই নয়া রুট, সেটা নিয়ে এখনও কোনও দিনক্ষণ ঠিক হয়নি মেট্রোর তরফ। মেট্রো সূত্রে খবর, এদিন শিয়ালদহ থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার মেট্রোর একটি রেক চলাচল করে। বউবাজারের নিচে দিয়ে যাওয়ার সময় অত্যন্ত ধীর গতিতে মেট্রোর রেকটি চলেছে। মেট্রোর আধিকারিকরা জানিয়েছেন, এটা চূড়ান্ত ট্রায়াল রান না হলেও, অন্তত মেট্রো চলাচলের জন্য ভূগর্ভ তৈরি, সেটা এদিন নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।
বউবাজার এলাকার অংশ জুড়ে গেলে অর্থাৎ পুরো পরিষেবা চালু হলে হাওড়া ময়দান থেকে শিয়ালদহ যেতে সময় লাগবে ১০ মিনিটেরও কম। আর হাওড়া ময়দান থেকে সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত সময় লগবে মাত্র ২৫ মিনিট। বউবাজার সুড়ঙ্গের কাজ শেষ হয়েছে বলে কলকাতা মেট্রো সূত্রের খবর। তবে বেশ কিছু পরীক্ষা বাকি রয়েছে। সেক্ষেত্র গুলিতে ছাড়পত্র পাওয়ার পরই জুড়ে যাবে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো করিডরের মধ্যে এই গ্রিন লাইনের দু’টি ভাগ রয়েছে। গ্রিন লাইন-১ ও ২। প্রথমটি সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে শিয়ালদহ অবধি, দ্বিতীয়টি এসপ্ল্যানেড থেকে হাওড়া ময়দান অবধি। তবে শিয়ালদহ থেকে এসপ্ল্যানেড অবধি মেট্রো চালু হয়ে গেলে, তখন একটাই গ্রিন লাইন হবে।