নিউজ ডেস্ক: অক্ষয় তৃতীয়ার দিন অর্থাৎ বুধবার দিঘায় নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরের (Digha Jagannath Temple) উদ্বোধন রয়েছে। বিগ্রহের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। তার আগে আজ মঙ্গলবার সেখানে বিশেষ হোম-যজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে। যা নিয়ে মহা ধুমধাম প্রচার। এর আগে দিঘার প্রশাসনিক বৈঠক থেকে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, পুরীর আদলে দিঘায় জগন্নাথ মন্দির গড়ে তোলা হবে। সেই কথা মত ২০১৯ সালে ১১৬বি জাতীয় সড়ক সংলগ্ন ভগীব্রহ্মপুর মৌজায় ২০ একর জমি মন্দিরের জন্য চিহ্নিত করে দিঘা–শংকরপুর উন্নয়ন পর্ষদ। ওই কুড়ি একর জায়গার উপর প্রায় আড়াইশো কোটি টাকা খরচ করে গড়ে উঠেছে এই জগন্নাথধাম।
এ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী জানান, মন্দিরের নির্মাণে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে। এখানে রয়েছে চারটি প্রধান দুয়ার — সিংহদুয়ার, ব্যাঘ্রদুয়ার, হস্তিদুয়ার ও অশ্বদুয়ার। মূল ফটক দিয়ে প্রবেশের পর প্রথমেই দর্শনার্থীরা দেখবেন অরুণ স্তম্ভ। মন্দিরের গঠনেও রয়েছে পুরীর ছাপ— গর্ভগৃহ, জগমোহন, নাটমণ্ডপ ও ভোগমণ্ডপের মতো চারটি প্রধান অংশ। গর্ভগৃহের বেদিতে প্রতিষ্ঠিত থাকবে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ। আগামী দু’দিন ধরে চলছে শেষ মুহূর্তের যজ্ঞ, আচার এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তদের ঢল নামার অপেক্ষায় দিঘা।
তবে পুরীতে জগন্নাথ মন্দির থাকা স্বত্বেও আবার কেন বিপুল খরচ করে দিঘায় এই মন্দির গড়ে তুললো রাজ্য সরকার?
আসলে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে দিঘার জগন্নাথ ধাম তৈরি হলেও পুরীর মন্দিরের থেকে বেশ কিছু নিয়ম এখানে আলাদা। পুরীর মন্দিরে হিন্দু ব্যতীত অন্য ধর্মের লোকজনের ঢোকা নিয়ে বার বার জটিলতা তৈরি হয়েছে। তবে যাঁরা হিন্দু নন, তাঁদের জগন্নাথ দর্শনের ব্যবস্থা করতে সেখানে মন্দিরের বাইরে রয়েছে পতিতপাবন মূর্তি। কিন্তু রাজ্য সরকারের সহায়তায় এবার আরও এক ধাপ এগিয়ে দিঘায় পতিতপাবন মূর্তির পাশাপাশি, অহিন্দুদের জগন্নাথ দর্শনের জন্য আলাদা ঘরও তৈরি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বর্তমানে দিঘাতেই থাকা পুরীর প্রধান রাজেশ দয়িতাপতির কথায়, “জগন্নাথ সকলের প্রভু। তবে রীতি অনুসারে তাঁর কাছে হিন্দু ছাড়া কেউ যেতে পারেন না। তবু কেউ যদি তাঁর দর্শন পেতে চান, তা হলে প্রভু বাধাও দিতে পারেন না। তাই দিঘায় পতিতপাবন কক্ষ করিয়েছি।” দিঘার জগন্নাথ ধাম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ইসকনের সহ-সভাপতি রাধারমণ দাসও বলেন, “পতিতপাবন কক্ষ আর মূর্তি করা হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রভুর দর্শন পাবেন অহিন্দুরাও।”
তবে অন্যদিকে, কাঁথির প্রভাত কুমার কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অমলেন্দুবিকাশ জানা মনে করান, “অযোধ্যায় রামমন্দির বা জামা মসজিদ কিন্তু তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্ট ধর্মের লোকজনের আর্থিক সহযোগিতায়। আর দিঘায় পুরোপুরি সরকারি অর্থে জগন্নাথ ধাম। সেখানে পতিতপাবনের মতো আয়োজন বাঞ্ছনীয় নয়। সংবিধানগত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতে আইনতও তা যেমন করা যায় না, নীতিগত ভাবেও ঠিক নয়।” একই সুরে কাঁথির বিজেপি সাংসদ সৌমেন্দু অধিকারীর কটাক্ষ, “সরকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়তে পারে না। তাই সরকারি ভাবে জগন্নাথ ধাম সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র বলা হচ্ছে। সেখানে ধর্মের ভিত্তিতে দেব-দর্শনে ভাগাভাগি, অত্যন্ত নিন্দনীয়।”
শুভেন্দুর হুঁশিয়ারি ঘিরে বিতর্ক
এ প্রসঙ্গেই কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর সাফ কথা, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলেই দিঘায় ওই মন্দির তৈরি করেছে রাজ্য সরকার। তাই পুরীর মন্দিরে প্রবেশের বিধিনিষেধ দিঘাতেও লাগু করতে হবে।
বুধবার দিঘার জগন্নাথ ধামের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। কিন্তু তার আগেই রবিবার নন্দীগ্রামে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ বিষয়ে সুর চড়ান শুভেন্দু। তাঁর দাবি, ‘পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে হিন্দু ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ নিষিদ্ধ। বুধবার দিঘার জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধনের দিন যদি কোনও অহিন্দু মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করেন তাঁর ছবি মার্ক করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করব। অহিন্দু যাঁরা আমন্ত্রণ পেয়েছেন, তাঁরা কিন্তু সাবধান!’
তবে শুধু হুঁশিয়ারি–ই নয়, রাজ্য সরকার নির্মিত জগন্নাথ ধাম নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নও এ দিন তুলছেন শুভেন্দু। জগন্নাথ ধামের উদ্বোধনী অনু্ষ্ঠানে হাজির থাকার জন্য তাঁকে সরকারি আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই আমন্ত্রণপত্রের ছবি পোস্ট করে শুভেন্দু জানিয়েছেন, তাঁর কিছু প্রশ্ন আছে। সেই প্রশ্নগুলির সদুত্তর পেলে তিনি সরকারি আমন্ত্রণে সাড়া দেবেন কি না, ভেবে দেখবেন।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতার প্রথম প্রশ্ন, ‘টেন্ডার নথি অনুযায়ী দিঘায় জগন্নাথ ধাম সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। অথচ আমন্ত্রণপত্রে বলা হয়েছে, প্রাণ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানের কথা। দিঘায় কি কোনও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্বোধন হচ্ছে, নাকি জগন্নাথ মন্দিরের?’
শুভেন্দুর পরের প্রশ্ন, ‘যেহেতু হিডকোর পক্ষ থেকে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে তাই এই প্রতিষ্ঠানটি–ই কি জগন্নাথ ধাম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বা মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবে?’
তাঁর তৃতীয় প্রশ্ন, ‘বর্তমানে হিডকোর চেয়ারম্যান কে? হিডকোর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এখনও ফিরহাদ হাকিমের নাম চেয়ারম্যান হিসেবে আছে।’ এই সূত্রেই বিরোধী দলনেতার পরের প্রশ্ন, ‘যদি ফিরহাদকে সরানো হয়ে থাকে, তবে হিডকোর ওয়েবসাইটে কেন এখনও তাঁর নাম? যদি তাঁকে সরানো না হয়ে থাকে তবে জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে ফিরহাদের কী যোগসূত্র?’
পুনর্বাসন না পেয়ে অন্ধকারে ১৯টি পরিবার
দিঘায় চারিদিকে এখন শুধুই আলোর রোশনাই। অক্ষয় তৃতীয়ার দুপুরে উদ্বোধন হবে দিঘার জগন্নাথ মন্দির। ইতিমধ্যেই চন্দননগরের আলোকসজ্জায় সেজে উঠেছে সৈকতনগরী দিঘার গেট। যেখান দিয়ে প্রবেশ করে পৌঁছে যাওয়া যাবে জগন্নাথধামে। কিন্তু এত আলোর মধ্যেও অন্ধকারে কারা? এই জগন্নাথ মন্দিরের জন্য জমি অধিগ্রহণে যাঁদের উচ্ছেদ হতে হয়েছে, আজ তাঁরা অন্ধকারে রয়েছেন। কারণ তাঁদের পুনর্বাসন এখনও মেলেনি। তাই তো গরিব পরিবারগুলির চোখে আজ জল। অনেক আশা ছিল, দিদির কাছে। উচ্ছেদের সময় প্রশাসন এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা তাঁদের বলেছিলেন ৬ মাসের মধ্যে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হবে। কিন্তু দিঘার সমুদ্রসৈকত দিয়ে অনেক জল বয়ে গেলেও জোটেনি পুনর্বাসন-তেমনই অভিযোগ।সালটা ছিল ২০১৮। তারিখ ৬ ডিসেম্বর। দিঘার প্রশাসনিক বৈঠক থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, পুরীর আদলে দিঘায় জগন্নাথ মন্দির গড়ে তোলা হবে। ১১৬বি জাতীয় সড়ক সংলগ্ন ভগীব্রহ্মপুর মৌজায় যেখানে বর্তমানে মন্দিরটি গড়ে উঠেছে সেখানেই ওই গরিব পরিবারগুলি থাকত। জীবন–জীবিকাও ওখানেই চলত। আজ এই ১৯টি পরিবার ভিটেহারা। আশ্রয়হীন। বর্তমানে ওখানের হাসপাতালের পাঁচিলের গায়ে পলিথিন লাগিয়ে বসবাস করছেন তারা।
গৃহহীন বহু পরিবার
ওই এলাকা থেকে প্রায় ৭০টি ঝুপড়ি দোকান উচ্ছেদ করা হয় বলে অভিযোগ। এখনও মেলেনি পুনর্বাসন। গৃহহীন হয়ে রয়েছেন—বরুণ জানা, গণেশ জানা, নিতাই পাত্র, পূর্ণিমা জানা, বাপি শ্যামল, সুমিতা পাত্ররা। হাসপাতালে পাঁচিলের এক ফাঁকে ছেঁড়া পলিথিন, বাঁশ এবং টিনেঘেরা ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। উচ্ছেদ হয়ে এখানে আসা বাপি শ্যামল জানান, এখনও হুমকি মেলে এখান থেকে উঠে যাওয়ার। আর সুমিতা পাত্রের বক্তব্য, ‘মন্দির হয়েছে সেটা ভালো কথা। অনেক দর্শনার্থী আসলে পর্যটনের উন্নতি হবে। কিন্তু দিদির উপর অনেক ভরসা। তাই জানতে চাই, আমাদের কী হবে? আমাদের জীবিকার কিছু ব্যবস্থা করলে ভালো হতো।’
উল্লেখ্য, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে দীঘা, শংকরপুর, মন্দারমণিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে সাজিয়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। তৈরি হয় দীঘা শংকরপুর উন্নয়ন পর্ষদ (ডিএসডিএ)। সেই সময়কালে উন্নয়ন পর্ষদ মন্দারমণিকেও যুক্ত করে। সে সময় সমুদ্র বিজ্ঞানী ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়কে দীঘা উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান করে, দীঘার উন্নয়ন এবং সমুদ্রের পরিবেশ ও সমুদ্র ভাঙন রোধের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। এলাকার গরিব মানুষ যাতে করে রুটি রুজির সংস্থান করতে পারেন। তার জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তোলা সহ নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। দীঘা-শংকরপুর উন্নয়ন পর্ষদের প্রাক্তন সদস্য আশিস প্রামাণিকের কথায়, ”বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে উন্নয়নের প্রধান লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান। এই এলাকায় ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসারের পরিকল্পনা হয়েছিল। দীঘার স্টেট জেনারেল হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি ডাক্তার, নার্স পরিষেবার আরও উন্নতি ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সব উদ্যোগ চাপা পড়ে গেছে তৃণমূল-শাসনে।”
তবে যাই হয়ে যাক না কেন, শেষ পর্যন্ত দিঘার মাটিতে জগন্নাথদেবের আগমন যে, রাজ্যের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করবে, এমনই প্রত্যাশা রয়েছে সকলেরই।