নিউজ ডেস্ক: পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার ঘটনার পর থেকেই সামনে এসেছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর ভিডিয়ো। উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর সব তথ্য। ঘন জঙ্গল থেকে ধীরে সুস্থে বেরিয়ে এসে ধর্ম জিজ্ঞাসা করে, ঠান্ডা মাথায় পরপর খুন। হত্যালীলার পর জঙ্গলের পথ ধরেই পালিয়ে যাওয়া। একেবারে নিখুঁত অপারেশন। সূত্র বলছে, ভৌগলিক অবস্থানের জন্যই পরিকল্পনা করে বাছা হয়েছিল পিরপঞ্জালে ঘেরা দক্ষিণ কাশ্মীরের বৈসরন উপত্যকাকে। তবে পরিকল্পনা ছিল অন্য।
হামলাকারীদের পরিকল্পনা ছিল অন্য, তবে কেন শেষ মুহূর্তে প্ল্যান বদল?
জানা গিয়েছে, হামলার আগে ৪ বার রেকি করেছিল জঙ্গিরা। ড্রোনের মাধ্যমে বোমা বিস্ফোরণের ছকও ছিল জঙ্গিদের। শুধু এভাবে হিন্দু হত্যা নয়, হামলাকারীদের পরিকল্পনা ছিল আরও বড়। আরও ভয়ঙ্কর। পরিকল্পনা ছিল ড্রোনের মাধ্যমে বোমাও ফেলা হতে পারে। কিন্তু বোমা ফেললে বা গুলি চালালে, একটি সম্প্রদায়কে নির্দিষ্ট করে টার্গেট করা হত না। তাই সেই প্ল্যান বাতিল হয়। এরপর এভাবে পরিচয় জেনে জেনে, ধর্ম দেখে দেখে, খুন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
উল্লেখ্য পহেলগাঁও থেকে সাইট সিনের জন্য সাধারণত চারটি জায়গা রয়েছে। বৈসরন ভ্যালি, আরু ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি, এবং চন্দনবাড়ি। সূত্রের দাবি, তার মধ্যে বৈসরনকে টার্গেট করার নেপথ্যে ছিল নিঁখুত অঙ্ক । কারণ বাকি তিনটি ট্যুরিস্ট স্পটের কাছাকাছি সেনা বা আধাসেনার ক্যাম্প বা নজরদারি থাকলেও একমাত্র বৈসরন উপত্যকাতেই সেই ব্যবস্থা নেই। বৈসরনের থেকে নিকটবর্তী CRPF-এর ক্যাম্পের দূরত্ব ৬ কিলোমিটার। সাড়ে ৬ কিলোমিটার দূরে পহেলগাঁও থানা। তাই যে কোনও সাহায্য আসতে বা পৌঁছতে বহু সময় লেগে যাবে। । তাছাড়াও রাস্তা অত্যন্ত খারাপ এবং খাঁড়া। উপরে বৈসরনে কোনও ঘটনা ঘটলে নীচ থেকে সেনা বা পুলিশের পৌঁছতে সময় লাগবে। এই সুযোগকেই কাজে লাগায় জঙ্গিরা।
সেলফি ভিডিয়োতে ধরা পড়ল সব
পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার ঘটনায় সম্প্রতি সামনে এসেছে এক চাঞ্চল্যকর ভিডিয়ো। এক পর্যটকের সেলফি ক্যামেরায় তোলা সেই ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, পিছনে গুলি লেগে পড়ে যাচ্ছেন পর্যটক। সবাই চীৎকার করছেন। প্রায় ১৫ ফুট উঁচুতে দড়িতে ঝুলতে থাকা ওই পর্যটক প্রথমটায় কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। অ্যাডভেঞ্চারের খুশিতে হাসছিলেন তিনি। তবে ভিডিয়োতে যা দেখা গেল, তা ভয়ঙ্কর।
গিয়েছে, ওই ব্যক্তির নাম ঋষি ভট্ট। ২২ এপ্রিল ছুটি কাটানোর জন্য স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে তিনিও গিয়েছিলেন পহেলগাঁওয়ের ওই ‘অভিশপ্ত’ জায়গায়। ওই দিন জিপলাইন রাইডে ওঠার পর সেলফি স্টিক দিয়ে মোবাইলে ভিডিও বানাচ্ছিলন তিনি। যেখানে দেখা গিয়েছে, রাইডে উঠে খুবই উচ্ছ্বসিত ঋষি। আনন্দে চিৎকার করছেন। কিন্তু স্লাইড শুরু করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিচে দেখা যাচ্ছে সেই ভয়ংকর দৃশ্য। অনেকেই বসে খাবার খাচ্ছিলেন। কেউ কেউ বাচ্চাদের নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন। ঠিক সেই সময়ই গুলির কান ফাটানো আওয়াজ। শুরু হয় জঙ্গিদের তাণ্ডব। তাদের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন একের পর এক পর্যটক। ভয়ে বাকিরা এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছেন। কিয়স্কে লুকানোর চেষ্টা করছেন। জিপলাইন রাইড শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত ঋষি এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড একচুলও উপলব্ধি করতে পারেননি। তিনি তখনও মজে নিজের আনন্দে।
কিন্তু জিপলাইনের ওপর প্রান্তে নামার পরই গোটা পরিস্থিতি মালুম হয় ঋষির। চোখের সামনে সবুজ উপত্যকার রঙ টকটকে লাল হয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই নেটিজেনদের চর্চায় তিনি। সাংবাদিকরাও পৌঁছে গিয়েছে তাঁর কাছে। হারহিম অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে গলা শুকিয়ে আসে ঋষির। তিনি জানান, “আমি আমার স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। আমরা দেখলাম সকলে একটা গর্ত মতো জায়গায় লুকানোর চেষ্টা করছে। যাতে তাদের সহজে দেখা না যায়। আমরাও সেখানেই লুকিয়ে ছিলাম। ৮-১০ মিনিট পর যখন গুলির আওয়াজ থামল, তখন আমরা মেন গেটের দিকে দৌড়াতে শুরু করি। কিন্তু ফের গুলি শুরু হয় এবং চার থেকে পাঁচজনকে গুলি করা হয়। এভাবে আমাদের সামনে প্রায় ১৫-১৬ জন পর্যটককে গুলি করা হয়। আমরা যখন গেটে পৌঁছালাম, তখন দেখি স্থানীয় বাসিন্দারা ইতিমধ্যেই চলে গিয়েছে। টাট্টু ঘোড়ার গাইড আমাদের বাইরে যেতে সাহায্য করেন।”
পহেলগাঁও হামলার মূল চক্রী পাক সেনার প্রাক্তন কমান্ডো?
বৈসরনে হামলায় জড়িত সন্দেহে ইতিমধ্যেই ১৫ জন স্থানীয়কে গ্রেফতার করে জেরা করছেন তদন্তকারীরা। সূত্রের খবর, জেরায় বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে-পহেলগাঁওয়ে হামলার নেতৃত্বে ছিল পাক জঙ্গি হাশিম মুসা। তদন্তে এমনই তথ্য উঠে এসেছে বলে সূত্রের খবর। উল্লেখ্য, এই জঙ্গিই পাক সেনার প্রাক্তন কমান্ডো ছিল। পরে লশকর-এ-ত্যায়বা জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দেয়। সূত্রের খবর, জম্মু-কাশ্মীরে নিরাপত্তাবাহিনী এবং কাশ্মীরি নন, এমন ব্যক্তিদের উপর হামলা চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মুসাকে। ওই সূত্রের দাবি, শুধু পহেলগাঁওই নয়, গত বছরে বারামুলা-সহ কাশ্মীরের দুই জায়গায় হামলার নেপথ্যেও ছিল এই কট্টরপন্থী পাক জঙ্গি। আর তা থেকেই তদন্তকারীদের সন্দেহ, কী ভাবে, কোন পথে হামলা চালানো হবে, তার পুরো নীল নকশা (ব্লুপ্রিন্ট) তৈরি হয়েছিল মুসার হাতেই। প্যারা কমান্ডোর প্রশিক্ষণ থাকায় সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এই হামলা চালায় মুসা এবং তার সহ-জঙ্গিরা।
সূত্রের খবর, এসএসজি-র প্যারা কমান্ডোদের অত্যন্ত কঠিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যে কোনও পরিস্থিতি, যে কোনও আবহাওয়ায় মানসিক এবং শারীরিক ভাবে সক্ষম থাকা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী কৌশল বদলের মতোও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই কমান্ডোরা যেমন অত্যাধুনিক অস্ত্র চালাতে দক্ষ, তেমনই সামনাসামনি লড়াই এবং কী ভাবে বেঁচে ফিরতে হবে তার কৌশলও তাদের আয়ত্তে। সূত্রের খবর, গ্রেফতার হওয়া সন্দেহভাজনদের জেরা করে এই হামলার নেপথ্যে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-যোগও পাওয়া যাচ্ছে।
জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ যে জঙ্গিদের ছবি প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে মুসা ছাড়াও রয়েছে আলি ভাই ওরফে তালহা এবং স্থানীয় জঙ্গি আদিল ঠোকর। সন্দেহ করা হচ্ছে, প্যারা কমান্ডোর প্রশিক্ষণ থাকায় মুসাকে হামলা চালানোর দায়িত্ব দিয়েছে লশকর।
পহেলগাঁও হামলায় স্থানীয়রাই জড়িত?
সূত্রের খবর, পহেলগাঁও হামলায় স্থানীয়দের অনেকে জড়িত বলে সন্দেহ। যারা ‘ওভারগ্রাউন্ড ওয়ার্কার’ হিসাবে জঙ্গিদের হয়ে কাজ করত। তেমনই বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সন্দেহ করা হচ্ছে, তারাই জঙ্গিদের আশ্রয়, হামলাস্থলে পৌঁছে দেওয়া এবং পহেলগাঁওয়ে ব্যবহৃত অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। আর কত জন ‘ওভারগ্রাউন্ড ওয়ার্কার’ হিসাবে কাজ করছে তার তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ এবং সেনা। ইতিমধ্যেই ১০ স্থানীয় জঙ্গির বাড়ি গুঁড়িয়েও দেওয়া হয়েছে। ১৪ স্থানীয় জঙ্গিকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে সেনাবাহিনী।
ফের জম্মু ও কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা?
পহেলগাঁওয়ের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর আর কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না ভারত। তাই গোপন সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে সরকার ৮৭টি পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে ৪৮টি বন্ধ করে দিল অনির্দিষ্ট কালের জন্য। কারণ গোয়েন্দা সংস্থাগুলি গত সপ্তাহের পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার পর আরও সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, কিছু স্লিপার সেল কাশ্মীর উপত্যকায় সক্রিয় হয়েছে এবং পহেলগাঁও হামলার পরে তাদের অপারেশন শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার মোট ৪৮টি রিসোর্ট ও পর্যটন কেন্দ্র আপাতত ভাবে বন্ধ করার কথা ঘোষণা করেছে উপত্যকার প্রশাসন। যার জেরে পর্যটকদের পছন্দের অন্যতম কিছু জায়গা যেমন দুধপাত্রি, ভেরিনাগে সাময়িক ভাবে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
মঙ্গলবার থেকে বন্ধ রয়েছে ইউসমার্গ, তৌসিময়দান, দুধপাথরি, আহরবাল, কাউসারনাগ, বাঙ্গুস, চান্দিগাম, উলার, রামপোরা প্রভৃতি এলাকা। তাছাড়া গুলমার্গ, সোনমার্গ, ডাল লেক-সহ অন্য যে সব পর্যটনকেন্দ্র খোলা রয়েছে, সেগুলিতেও নিরাপত্তা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। সূত্র অনুসারে, উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ কাশ্মীর জুড়ে সক্রিয় সন্ত্রাসীরা লক্ষ্যবস্তু হত্যার পরিকল্পনা করছে, পাশাপাশি পহেলগাঁও হামলার পরে উপত্যকায় সক্রিয় সন্ত্রাসীদের বাড়ি ধ্বংসের প্রতিশোধ হিসাবে একটি বৃহত্তর হামলার পরিকল্পনা করছে।