নিউজ ডেস্ক: ফের জম্মু ও কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা। পহেলগাঁওয়ের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর আর কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না ভারত। তাই গোপন সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে সরকার কাশ্মীরের ৮৭টি পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে ৪৮টি বন্ধ করে দিল অনির্দিষ্ট কালের জন্য।
কেন এই সিদ্ধান্ত?
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, পহেলগাঁওয়ে হামলার পরেই উপত্যকায় কিছু স্লিপার সেল সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং তাদের ‘অপারেশন’-এ নামার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সক্রিয় জঙ্গিদের বাড়ি ভেঙে ফেলার পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে পরিকল্পনা করা হচ্ছে আরও বড় হামলা এবং লক্ষ্য স্থির করে হত্যার। গোয়েন্দা সূত্র আরও জানিয়েছে, আইএসআইয়ের ছক অনুযায়ী পাক জঙ্গিরা স্থানীয় জঙ্গিদের সাহায্য নিয়ে নিরাপত্তা রক্ষী, অ-কাশ্মীরি, পুলিশ ও কাশ্মীরি পণ্ডিতদের টার্গেট করতে পারে।এই পরিস্থিতিতে প্রশাসন কোনও রকম ঝুঁকি নিতে নারাজ। পহেলগাঁওয়ের মতো ঘটনার যাতে জঙ্গিরা না চালাতে পারে, সেজন্য অধিকাংশ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পর্যটনকেন্দ্র আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নাশকতার ঝুঁকি বাড়তেই কাশ্মীরে বড় পদক্ষেপ সরকারের
গত ২২ এপ্রিল অনন্তনাগের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় জঙ্গিদের গুলিতে প্রাণ হারান ২৬ জন পর্যটক। সেই জঙ্গিহানার পরেই কাশ্মীর জুড়ে পুরোদমে শুরু হয় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান। উড়িয়ে দেওয়া হয় একাধিক জঙ্গির ঘরবাড়ি। তবে এখনও পর্যন্ত পহেলগাঁওয়ের হামলাকারীদের নাগাল পাওয়া যায়নি। কমেনি জঙ্গি হামলার আশঙ্কাও। বরং গোয়েন্দা সূত্রে খবর, ‘প্রত্যাঘাত’ হিসাবে শীঘ্রই দ্বিতীয় হামলা করতে পারে জঙ্গিরা। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা জানাচ্ছে, গত কয়েক দিনে জম্মু ও কাশ্মীরের নানা প্রান্তে জঙ্গিদের একাধিক ‘স্লিপার সেল’ সক্রিয় হয়েছে। শীঘ্রই আবারও কোনও জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে হামলা চালাতে পারে তারা। সেই আবহেই বাড়তি সতর্কতা প্রশাসনের।
কোন কোন জায়গা বন্ধ করা হল?
মঙ্গলবার মোট ৪৮টি রিসোর্ট ও পর্যটন কেন্দ্র আপাতত ভাবে বন্ধ করার কথা ঘোষণা করেছে উপত্যকার প্রশাসন। এই তালিকায় রয়েছে, শ্রীনগরের জামিয়া মসজিদ, বাদামওয়ারী, রাজোরি কাদল হোটেল কানাজ, আলি কাদল জেজে ফুড রেস্তোরাঁ, আইভরি হোটেল, পদশপাল রিসোর্ট এবং রেস্তোরাঁ, চেরি ট্রি রিসোর্ট (ফকির গুজরি), নর্থ ক্লিফ ক্যাফে এবং স্টে প্যাটার্ন দ্বারা রিট্রিট, ফরেস্ট হিল কটেজ, ইকো ভিলেজ রিসোর্ট (দারা), আস্তানমার্গ ভিউ পয়েন্ট, আস্তানমার্গ প্যারাগ্লাইডিং, মামনেথ এবং মহাদেব পাহাড়, বৌদ্ধ মঠ, দাচিগাম – বিয়ন্ড ট্রাউট ফার্ম / ফিশারিজ ফার্ম, আস্তানপোরা (বিশেষ করে কায়াম গাহ রিসোর্ট, লাচপাত্রি)।
এছাড়াও বারামুল্লা জেলার উলার/ওয়াটল্যাব, রামপোরা এবং রাজপোরা, চেয়ারহার, মুন্ডিজ-হামাম-মারকুট জলপ্রপাত, খাম্পু, বসনিয়া, ভিজিটপ, বাবরেশি, শ্রুঞ্জ জলপ্রপাত, কামানপোস্ট, নাম্বলান জলপ্রপাত, ইকো পার্ক খাদনিয়ার, গোগলদারা, হাব্বা খাতুন পয়েন্ট, রিঙ্গাওয়ালি, বদরকোট পর্যটনকেন্দ্র আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তালিকায় রয়েছে ইউসমার্গ, তৌসিময়দান, দুধপাথরি, সূর্য মন্দির, ভেরিনাগ গার্ডেন, সিন্থান টপ, মারগানটপ, আকদ পার্ক,আহরবাল, কাউসারনাগ,বাঙ্গুস, কারিওয়ান ডুবুরি চান্দিগাম, বাঙ্গুস ভ্যালি, হাং পার্ক এবং নারানাগ, সাঙ্গারওয়ানির নামও।
তবে গুলমার্গ, সোনমার্গ, ডাল লেক-সহ অন্য যে সব পর্যটনকেন্দ্র খোলা রয়েছে, সেগুলিতেও নিরাপত্তা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পহেলগাঁও হামলার পর থেকে জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগর, ডোডা এবং কিশ্তোয়ারের বেশ কিছু জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থা। নিরাপত্তাবাহিনী সূত্রে খবর, গত ছ’দিনে উপত্যকার ৬০০ টিরও বেশি স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে।
পর্যটকশূন্য পহেলগাঁওয়ে বাড়ছে বেকারত্ব
অন্যদিকে, জঙ্গি হামলার পর পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে পহেলগাঁও (Kashmir Situation Update)। বৈসরন ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। রাস্তায় টহল দিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। ফাঁকা হোটেল। ভরা মরশুমে ব্যবসা লাটে উঠেছে। কাজ হারিয়েছেন প্রায় ৮০ শতাংশ হোটেলকর্মী। রোজগার নেই ট্যাক্সি চালক ও ঘোড়াওয়ালাদের।
এক হোটেলকর্মী জানিয়েছেন, ”একেবারে জুন পর্যন্ত পুরো বুকিং ছিল। ২৩ তারিখ থেকেই সব বুকিং ক্যান্সেল হয়ে গেছে। কার্যত অলিখিত কার্ফু জারি হয়েছে পহেলগাঁওয়ে। পাইন গাছে ঘেরা সবুজ ঘাসে মোড়া একের পর এক উপত্যকা। কিন্তু ২২ এপ্রিল জঙ্গি হামলার পর থেকেই এই সমস্ত জায়গায় যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। এক হোটেল মালিকের কথায়, “এটা আমাদের পিক সিজন। বছরের এই ৩টে মাস…১৫ মার্চ থেকে ১৫ জুন…সমস্ত জায়গায় পর্যটকরা ভিড় করেন। হোম স্টে, গেস্ট হাউস, ৪ তারা, ৩ তারা হোটেল, সব ভর্তি থাকে। জায়গাই পাওয়া যায় না।”
অঘোষিত লকডাউন পহেলগাঁও জুড়ে
পর্যটকদের প্রথম পছন্দ পহেলগাঁও বর্তমানে পর্যটকশূন্য। বলা ভালো জঙ্গি হামলার পর থেকে অঘোষিত লকডাউন হয়ে গেছে গোটা পহেলগাঁও জুড়ে। ব্যবসা লাটে ওঠায় হোটেলগুলোতে প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। রুজি-রোজগারে টান পড়েছে পহেলগাঁওয়ের ট্যাক্সি চালক ও ঘোড়াওয়ালাদের। এক ট্যাক্সিচালক বলছেন, “পর্যটকদের উপরেই আমাদের রোজগার নির্ভর করে। ঘোড়াওয়ালা, শালওয়ালা, হোটেলওয়ালা…এখন সব বন্ধ। দোকান খুলেছে, পর্যটকরা এলেও সাইট সিয়িং বন্ধ।”
তবে এই নাশকতার ঘটনায় কাশ্মীরের পর্যটন ব্যবস্থা যে একটু লাইনচ্যুত হবে, সেই ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিল ওয়াকিবহাল মহল। ২০২৩ সাল থেকেই ধাপে ধাপে রের্কড পর্যটক এসেছে কাশ্মীরে। এমনকি, চলতি গ্রীষ্মেও পর্যটনের মাধ্য়মে বাড়তি অক্সিজেন পেত কাশ্মীর, সেই নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার আগেই যেন সব শেষ।
কাশ্মীরের পর্যটন অস্তিত্বের সংকটে?
রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সন্ত্রাসবাদী হামলার সংখ্যা ছিল ২২৮। ২০২৩ সালে ওই হামলা কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৪৬-এ। এর ফলে পর্যটনকে ঘিরে বিনিয়োগ বাড়ছিল। যা অর্থনৈতিক গতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠছিল। এই হামলার আগে পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীরের অর্থনৈতিক গতি ছিল শক্তিশালী। কাশ্মীরে ঘুরতে যাওয়া বাঙালি পর্যটকের সংখ্যাও যথেষ্ট। কিন্তু সন্ত্রাস হামলার আবহে বেড়াতে গিয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তার প্রশ্নে ট্যুর বাতিল করছেন ট্যুর অপারেটররা।
কাশ্মীরের পর্যটন ব্যবস্থায় ১৫০০ র বেশি হাউসবোট, ৩ হাজারের বেশি হোটেল রুম, ট্যাক্সি অপারেটর, ট্যুর গাইড, ঘোড়া চালক আছে। হস্তশিল্প বিক্রেতারা রয়েছেন। এঁদের অনেকেই ঋণ নিয়ে পর্যটনে বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু এই হামলা হঠাৎ করেই তাদের সেই আশা ও বিনিয়োগকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে। প্রচুর বুকিং বাতিল হয়েছে। এর ফলে আয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু হঠাৎ করে কেনই বা পর্যটনে বাঁধ ফেলল উপত্যকার সরকার?
জানা গিয়েছে, পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর ‘ভয়ের আবহ’ তৈরি হয়েছে গোটা কাশ্মীর জুড়ে। আবার কি নিজের ভয়াল রূপ ফিরে পাচ্ছে উপত্যকা? প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এই পরিস্থিতিতে চাই কড়া শাসন। যার জন্য ইতিমধ্যেই ‘অ্যাকশনে’ নেমে পড়েছে সেনা। সূত্রের খবর, এখনও কাশ্মীরের অন্দরেই লুকিয়ে আছে পহেলগাঁওয়ের চক্রীরা। সেই ভিত্তিতেই উপত্যকাকে ‘ট্র্যাকে’ ফেরাতে সাময়িক বিরতিতেই আস্থা সরকারের। পাশাপাশি, এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, আবার জঙ্গি হামলার সম্ভবনা বাড়ছে কাশ্মীরে। এই পরিস্থিতিতে পহেলগাঁও থেকে শিক্ষা নিয়ে আগেভাগেই পর্যটনের ঝাঁপ বন্ধ করছে তারা।