নিউজ ডেস্ক: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) যখন ধর্মের রাজনীতিতে মত্ত, তখন জতুগৃহ (Fire) হয়ে পুড়ছে কলকাতা (Kolkata)। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন দিঘায় জগন্নাথ দেবের মন্দির উদ্বোধনে ব্যস্ত, তখন দমবন্ধ হয়ে তিলে তিলে মারা যাচ্ছেন ১৫ জন। পুরীর আদলে দিঘায় কালচারাল সেন্টার করে যখন হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলে ধরতে আকুল মুখ্যমন্ত্রী, তখন গ্যাসচেম্বারে পরিণত হয়েছে বড়বাজারের হোটেল ঋতুরাজ।
বড়বাজারে অগ্নিকাণ্ড, গাফিলতি স্পষ্ট
বড়বাজারের হোটেলে আগুন (Hotel Fire)। আর তাতে ঝলসে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ফের সামনে আনল প্রশাসনিক গাফিলতি। প্রশাসনের নজরদারি যে কোথাও নেই, তা একটার পর একটা ঘটনায় সামনে আসছে। এসি হোটেলে কেন অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা থাকবে না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠছে জলের ব্যবস্থা নিয়ে। প্রশ্ন উঠছে, যে হোটেলে বহু মানুষের থাকার ব্যবস্থা, সেখানে একটাই বেরোবার পথ কেন? কেন ৬২ জন কর্মী থাকা সত্ত্বেও রান্নাঘর থেকে আগুন লাগার সময় কাউকে সতর্ক করা গেল না! ছাদে উঠে বেশ কিছু মানুষের প্রাণ বেঁচেছে। তা নিয়েই বড়াই করছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তিনি একবারও ভেবে দেখছেন না, রাজ্যটা কীভাবে চলছে! কেন কেউ নিয়ম মেনে চলে না! এই কলকাতাতেই গত ৬ মাসে ১৩ট জায়গায় আগুন লেগেছে। কিন্তু কোথাও সতর্কতা নেই। কেন? কেন? কেন?
ফিরে দেখা অতীত…
স্টিফেন কোর্ট থেকে আমরি। বাংলার বুকে বারবার ঘটে গিয়েছে বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। আর এই বড়বাজার এলাকা তো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জতুগৃহে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি বড়বাজারের বুকে অবস্থিত একটি বিলাসবহুল হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যেখানে শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী দুই নাবালক সহ ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
নন্দরাম মার্কেট অগ্নিকাণ্ড, ২০০৮
২০০৮ সালের ১২ জানুয়ারি বড়বাজারের নন্দরাম মার্কেটে ঘটে যায় এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, যা কলকাতার ইতিহাসে অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ও বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে যায় সাততলা একটি বিল্ডিংয়ের পাশাপাশি হাজারেরও বেশি দোকান।সকালবেলা মার্কেটের একটি গুদামে আগুন লাগে। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে বহুতল ভবনের একাধিক অংশে। মার্কেটে বিক্রি হতো কাপড়, প্লাস্টিক, কেমিক্যাল, কাগজ। দাহ্য পদার্থ থাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আনুমানিক ২০০–২৫০ কোটি টাকার বেশি মালপত্র পুড়ে যায়।প্রশাসন জানায়, বেআইনি নির্মাণ ও অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিকমতো না থাকায় এই পরিস্থতি। এরপর বহুদিন বন্ধ ছিল মার্কেটের একাংশ।
স্টিফেন কোর্ট অগ্নিকাণ্ড
এই ঘটনার ঠিক ২ বছর পর।দিনটা ছিল ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ। স্টিফেন কোর্ট অগ্নিকাণ্ড কলকাতার এক ভয়াবহ নাগরিক বিপর্যয়ের অন্যতম ঘটনা। এটি শহরের নিরাপত্তা, পুরনো ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ, এবং অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার ঘাটতির এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে রয়েছে। দুপুর দুটো নাগাদ পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্টের একটি অংশে আগুন লাগে। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে উপরতলা পর্যন্ত। পুরনো কাঠের সিঁড়ি ও সেসময়ের তারের জটিল ব্যবস্থার কারণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আগুন। দমকলকে খবর দেওয়া হলেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বহু সময় লেগে যায়। প্রাণে বাঁচতে উপর থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়েন অনেকে। ঘটনায় ৪৩ জনের মৃত্যু হয়। দরজা বন্ধ থাকায় ছাদেও যেতে পারেননি কেউ। ফলে গেটের কাছে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় অনেকের।
আমরি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ড…
স্টিফেন কোর্ট কাণ্ডের ঠিক এক বছরের মাথায় বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালে। ২০১১ সালের ৯ ডিসেম্বরের ওই ঘটনায় অসহায়ভাবে ছটফট করতে করতে মৃত্যু হয় ৮৯ জনের। দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় অবস্থিত AMRI হাসপাতালে ঘটে যাওয়া বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ভারতের হাসপাতালের ইতিহাসে অন্যতম কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। ভোরবেলা ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন মূলত হাসপাতালের বেসমেন্টে থাকা অপ্রচলিত ও দাহ্য কেমিক্যাল, বর্জ্য, এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের মধ্যে থেকে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুত আগুন পৌঁছে যায় রোগী ভর্তি উপরতলার ইউনিটে। ৮৯ জন রোগীর মৃত্যু হয়। ঘুমন্ত অবস্থাতেই বেশিরভাগ রোগী দমবন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
বাগরি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড
২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বাগরি মার্কেটের ৬ তলা বাড়িতে বিধ্বংসী আগুন লাগে। বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় কোটি কোটি টাকার জিনিস। ওই বাড়িতে হাজারেরও বেশি দোকান ও গোডাউন ছিল। গভীর রাতে আগুন লাগে। তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভবনে। কেমিক্যালস, কাগজ, প্লাস্টিক, পারফিউমের মতো দাহ্য বস্তু থাকায় আগুন নেভাতে কালঘাম ছুটে যায় দমকল বাহিনীর। মার্কেট বন্ধ থাকায় কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তবে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়।
নিউ কয়লাঘাটা বিল্ডিংয়ে অগ্নিকাণ্ড
২০২১ সালের ৮ মার্চ স্ট্র্যান্ড রোডে নিউ কয়লাঘাট বিল্ডিংয়ে আগুন লাগে। ২টি লিফটে আটকে ঝলসে মৃত্যু হয় ৯ জনের। ১৩ তলা এই বিল্ডিংটি ছিল পূর্ব রেলওয়ে-র সিগন্যালিং এবং টেলিযোগাযোগ দপ্তরের সদর দফতর। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ আগুন লাগে বিল্ডিংয়ের একটি অফিস ঘরে।আগুন ছড়িয়ে পড়ে উপরের তলাগুলিতে। ভবনের লিফট তখন চলছিল। আগুনের সময় ৯ জন লিফট ব্যবহার করছিলেন। তাঁরা ভিতরে আটকে পড়েন। পরে ঝলসে মারা যান। মৃতদের মধ্যে ছিলেন ৪ জন রেলকর্মী, ১ জন কলকাতা পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর, ১ জন ফায়ার অফিসার ও ৩ জন দমকল কর্মী।
এরপরও কলকাতায় বেশ কিছু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেসময় প্রশাসন তৎপর হলেও পরে সব ধামাচাপা পড়ে যায়। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আর সরকারি আধিকারিকদের উপঢৌকন দিয়ে শুরু হয় বেআইনি কাজ। বড় বড় বিল্ডিংয়ে আগুন নেভানোর জন্য ইলেকট্রিক মই কেনা হলেও তা অব্যবহারে খারাপ হয়ে পড়ে থাকে। আর সাধারণ মানুষকে পড়তে হয় ভোগান্তিতে। কখনও স্বীকার হতে হয় নির্মম পরিণতির। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন ক্ষতিপূরণের। কিন্তু এই ক্ষতিপূরণ কি সমাজের ক্ষতি নির্মূল করতে পারবে? এর জন্য চাই প্রশাসনিক সতর্কতা। নৈতিকতার সাথে সবকিছু খতিয়ে দেখা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় না। একটার পর একটা মেলা, খেলা আর অনুষ্ঠানে আগের ঘটনা ভুলে যায় জনগণ। আর এভাবেই বাংলা নামতে থাকতে এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে।