নিউজ ডেস্ক: ভারতের প্রাচীনতম চিড়িয়াখানাগুলির মধ্যে কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানা অন্যতম। ১৮৭৫ সালে এটি সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৮৭৬ সালে ১ মে, অর্থাৎ আজকের দিনেই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল এই চিড়িয়াখানা। দেখতে দেখতে দেড়শ বছর পেরলো আলিপুর চিড়িয়াখানা।
ইতিহাস
১৮৭৫ সালে প্রিন্স অব ওয়েলস (পরে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড) কলকাতা ভ্রমণের সময় উদ্বোধন করেছিলেন এই জ়ুলজিক্যাল গার্ডেনের। এই প্রিন্স ওফ ওয়েলসকে আমরা চিনি সপ্তম এডওয়র্ড নামে। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগেই কলকাতায় চিড়িয়াখানা স্থাপনের চিন্তা শুরু করে ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৮৭৫ সালে, বাংলার বড়লাট স্যর রিচার্ড টেম্পল জিরাট ব্রিজের দু’পাশের বস্তি সরিয়ে জায়গা করে দেয় চিড়িয়াখানার জন্য। চিড়িয়াখানার প্রাথমিক খরচ তুলতে দেড়শ বছর আগে, দুই লক্ষ টাকারও বেশি চাঁদা তোলা হয়। প্রথম দিকে চিড়িয়াখানা পরিচালন কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন জার্মান প্রযুক্তিবিদ কার্ল লুইস শোয়েন্ডলার ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী জর্জ কিং। উনিশ শতকের প্রায় শুরু থেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে শহরে বিরল পশুপাখির একাধিক সংগ্রহ গড়ে উঠেছিল।
তবে রামব্রহ্ম সান্যাল, এই নামটা ছাড়া চিড়িয়াখানার ইতিহাস অসম্পুর্ণ। তিনি ছিলেন আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় সুপারিন্টেনডেন্ট। জর্জ কিং তাঁর প্রাক্তন ছাত্র রামব্রহ্মকে চিড়িয়াখানায় কাজে নিযুক্ত করেন ১৮৭৬-এর ২৪ জানুয়ারি। এরপর ১৮৭৭ সাল থেকে রামব্রহ্ম হেডবাবু হিসেবে কাজের দায়িত্ব পান। তিনি আলিপুর পশুশালার নামকরণ করেছিলেন ‘আলিপুর জীবনিবাস’। পশুপাখিদের বিজ্ঞানসম্মত নামের উল্লেখ থাকা দরকার, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। জীবজন্তুদের স্বাস্থ্য, অসুখবিসুখ, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারেও খোঁজ রাখতেন তিনি। প্রতিদিন সকাল-বিকেল কর্মচারীদের নিয়ে পশুশালা ঘুরে দেখতেন। তাদের নিজের হাতে খাওয়াতে ভালবাসতেন। সাধ্য মতো অসুস্থ প্রাণীর চিকিৎসা করতেন, প্রয়োজনে পশুচিকিৎসককে দেখিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন।
অনেক সময় ছোটখাটো অপারেশন করতে হত চিড়িয়াখানার পশু পাখির, সে ক্ষেত্রে তাঁর ডাক্তারি বিদ্যা কাজে লাগত। কোনও পশুর মৃত্যু হলে তার পোস্টমর্টেমে পশুচিকিৎসককে সাহায্য করতেন, কমিটির কাছে রিপোর্ট পাঠাতেন রামব্রহ্ম সান্যাল। ১৮৮০-র ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনে দর্শকদের টানতে চিড়িয়াখানার ভিতরে ইলেকট্রিক ট্রেন চালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রামব্রহ্ম ট্রেন চালানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন বার্ন কোম্পানিকে। পশুশালায় এই ছোট ট্রেন দেখতে খুব ভিড় হয়েছিল। বাংলার ছোটলাট স্যর অ্যাশলে ইডেন স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন সে দিন। চিড়িয়াখানায় টিকিট বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল হু-হু করে। ১৮৮৩-৮৪ সালের এক হিসাব বলছে, সারা বছরে ১,৮৮,৫৯৩ জন এসেছিলেন চিড়িয়াখানায়।
চিড়িয়াখানা নিয়ে বর্তমান সরকারের ভাবনা
এত গেল ইতিহাস, এবার ফিরি বর্তমানে। আলিপুর মহিলা সংশোধনাগারের কাছে চিড়িয়াখানার পশুপাখিদের জন্য কোয়ারেন্টাইন সেন্টার তৈরি করার ভাবনা নিয়েছে হিডকো। সেজন্য জমি দেখার কাজও হয়ে গিয়েছে বলে সূত্রের খবর। আলিপুর চিড়িয়াখানার বিপরীতে জমিতে পিপিপি মডেলে বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে। সেজন্য চিড়িয়াখানার প্রায় আড়াইশো কাঠা জমি ছাড়তে হয়েছে বন দপ্তরকে। তার পরিবর্তে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষকে পশুপাখিদের জন্য উন্নতমানের কোয়ারেন্টাইন সেন্টার তৈরি করে দেবে হিডকো।
চিড়িয়াখানার বিপরীতে বনদপ্তরে ওই জমি রয়েছে। সেখানে পশু হাসপাতাল ও অ্যাকোয়ারিয়াম রয়েছে। এছাড়া রয়েছে কোয়ার্টার। যেখানে চিড়িয়াখানার প্রাণী চিকিৎসক ও কর্মী আধিকারিকরা থাকেন। পশু হাসপাতাল ছাড়া বাকি জমি পিপিপি মডেলে বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে। ওই জমি হিডকোকে দিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বরাত দেওয়া হচ্ছে। যেখানে বহুতল নির্মাণ করা হবে। যেখানে একটি ফ্লোরে থাকবে সরকারি জিনিসপত্র বিক্রির স্টল। আর অন্যগুলোতে বেসরকারি ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসা করতে পারবেন। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যে রাজ্য সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে। এদিকে ওই জমি ছাড়ার জন্য চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ পাবে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার। চিড়িয়াখানায় আসা নতুন অতিথিদের জন্য ২০০০ বর্গমিটারের বিকল্প জমিতে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করতে হবে হিডকোকে। আলিপুর চিড়িয়াখানা সূত্রে খবর, আলিপুর মহিলা সংশোধনাগারের কাছে একটি জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে হিডকো কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করার কথা ভাবছে।
কেন এই সিদ্ধান্ত?
সাধারণত, যখন বাইরে থেকে নতুন পশুপাখি চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয় তখন বেশ কিছুদিন তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখাটাই নিয়ম। কারণ বাইরে থেকে আসা পশুপাখিরা অনেক সময় ভাইরাস বহন করে আনে। কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ শেষে তাদের দর্শকদের সামনে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু আলিপুর চিড়িয়াখানা আলাদা করে কোনও কোয়ারেন্টাইন সেন্টার নেই। চিড়িয়াখানার প্রাঙ্গণের ভিতরে আইসোলেশন ইউনিটে কোয়ারেন্টাইন করা হয় পশুপাখিদের। আলিপুরের এক আধিকারিক জানান, চিড়িয়াখানার ভিতরে যেহেতু আইসোলেশন ইউনিট, তাই এখানে বাকি পশুপাখিদের ঝুঁকি থেকে যায়। চিড়িয়াখানা প্রাঙ্গণের বাইরে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করা হলে এই ঝুঁকি থাকবে না। তাছাড়া আলিপুর মহিলা সংশোধনাগার থেকে চিড়িয়াখানার দূরত্বও খুব বেশি নয়। সেখানে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার গড়া হলে সুবিধা হবে।
চিড়িয়াখানায় নতুন অতিথি
বর্তমানে চিড়িয়াখানাকে আরও সাজানোর কথা ভাবছে সরকার। রসিকবিলের মিনি জু-তে ঘড়িয়ালের ডিম থেকে ফোটানো ৪৪টি বাচ্চার মধ্যে ছ’টি এবার কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সব ঠিক থাকলে মে মাসের শুরুতে ছ’টি ঘড়িয়ালের বাচ্চা সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। অপরদিকে দু’জোড়া ম্যাকাও এবং একজোড়া ফিশিং ক্যাট, চাইনিজ প্যাঙ্গোলিন এখানে নিয়ে আসার পরিকল্পনা বনদপ্তরে রয়েছে।
বনদপ্তরের কোচবিহারের এনডিএফও বিজন নাথ জানিয়েছেন, দু’বছর আগে ঘড়িয়ালের ডিমকে ইনকিউবেটরে রেখে পরীক্ষামূলকভাবে ফোটানো হয়েছিল। তাতে ঘড়িয়ালের ৪৪টি বাচ্চা ডিম ফুটে বেরিয়েছিল। ইতিমধ্যে তাদের বয়স প্রায় দু’বছর হয়েছে। এবার তাদের মধ্যে ছ’টি ছোট্ট ঘড়িয়াল কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানা নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পর্যটক বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ
বনদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, রসিকবিল থেকে গত বছর ভালো পরিমাণ আয় করেছিল বনদপ্তর। পর্যটকদের সংখ্যাও অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আরও বেশি সংখ্যাক পর্যটক টানতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তারজন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে সংস্কার কাজ শুরু করা হয়েছে। জলজ পাখিদের জন্য একটি আলাদা খাঁচা তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছে। সেটা তৈরি হয়ে গেলে আকর্ষণ আরও অনেকটাই বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন বনকর্তারা। তাছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির পাইথন রাখার এবং তাদের জন্য পরিকাঠামো তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছে। ফিশিং ক্যাট নিয়ে আসার আগে তাদের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। পুরনো পাখির খাঁচাগুলো সংস্কার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে এবং তার জন্য কাজ চলছে। বিশেষভাবে সেখানে থাকা চিতাবাঘগুলি নজর কাড়ে পর্যটকদের। কাজেই তাদের খাবার দেওয়ার জন্য এবং গরমে যাতে কোনও ধরনের সমস্যার মুখে তারা না পড়ে, তারজন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনেই তাদের খাওয়া-দাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
আলিপুর চিড়িয়াখানার গ্রন্থাগার এবার সাধারণ মানুষের জন্য
দেড়শো বছরের ইতিহাসে আরও নতুন পদক্ষেপ আলিপুর চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের। আলিপুর চিড়িয়াখানার গ্রন্থাগার এবার সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হবে। প্রতিষ্ঠার দিন থেকে আজ পর্যন্ত এই লাইব্রেরি সাধারণ দর্শক বা মানুষজন ব্যবহার করতে পারেন না। তবে চলতি বছর থেকেই সেই সুযোগ হাতে আসার সম্ভাবনা৷ ইতিমধ্যেই তার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে।
চিড়িয়াখানার প্রথম সুপারিনটেনডেন্টের হাতে লেখা চিঠি-সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও লাইব্রেরিতে থাকা বই ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে । প্রায় ১৪০০-রও বেশি দুষ্প্রাপ্য বই ডিজিটাল কপি করা হচ্ছে। সূত্রের দাবি, এই গ্রন্থাগার যেমন সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে, ঠিক তেমনই চিড়িয়াখানার ওয়েবসাইটের গ্রন্থাগারে থাকা বিপুল পরিমাণ বইয়ের ডিজিটাল কপি আপলোড করা হবে। সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু করা হয়েছে। রাজ্যের বনদফতর এবং চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ চলতি বছরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়েছে।
আলিপুর চিড়িয়াখানার গ্রন্থাগারটি ‘স্যার জ্যোতিন্দ্রমোহন টেগোর – কেসিআইই অফ ক্যালকাটা’ নামে নামাঙ্কিত৷ চিড়িয়াখানা শুরুর সময়ে তিনি চিড়িয়াখানার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, প্রাণীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত পৃথিবীর সমস্ত প্রয়োজনীয় বই এই গ্রন্থাগারে থাকবে। সেই উদ্দেশ্যে তিনি চিড়িয়াখানায় প্রচুর অর্থ দান করেন। সেই অর্থের সাহায্যে ১৮৯৮ সালে চিড়িয়াখানায় এই গ্রন্থাগার গড়ে তোলা হয়। এ প্রসঙ্গে, চিড়িয়াখানার এক পৃষ্ঠপোষক স্যার জন এডগার এই গ্রন্থাগারের জন্য বইয়ের আলমারি দান করেন। বর্তমানে এখানে প্রায় ১৪০০-রও বেশি বই রয়েছে৷ এর মধ্যে অধিকাংশই দুষ্প্রাপ্য। সেই তালিকায় চিড়িয়াখানার ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত বইটিও যুক্ত হবে। এমনকি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন বিভাগ এবং রাজ্য চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রকাশিত নানা বইও সেই তালিকায় সংযোজিত হবে।