নিউজ ডেস্ক: এ যেন ন্যায়বিচার নিয়ে পরিহাস চলছে। হাইকোর্টের জামিনের নির্দেশেই স্থগিতাদেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। বুধবারই বাংলাদেশের হাই কোর্ট থেকে জামিন পেয়েছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস। তবে দিনের বেলায় জামিন পেলেও সন্ধ্যায় তাঁর জামিনের আদেশে স্থগিতাদেশ দিয়েছে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের ‘আপিল বিভাগ’। দীর্ঘদিন জেলবন্দি থাকার পর গতকাল জামিন পেয়েছিলেন চিন্ময় প্রভু। তবে ফের তাঁর জামিনের নির্দেশে স্থগিতাদেশ জারি হওয়ায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আবার জেলবন্দি হতে হবে কিনা তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
ঠিক কী ঘটেছিল?
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৫ অক্টোবর চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে সনাতনী সম্প্রদায়ের একটি বড় সমাবেশ হয়। এর কয়েক দিন পর গত ৩১ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহের সেই মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গত ২৫ নভেম্বর ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয়। একইসঙ্গে এ মামলায় আরও ১৮ জনকে আসামি করা হয়। তবে পরদিন চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন আবেদন করা হলে তা নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। আদালত চিন্ময়কে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলে সেদিন বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে চিন্ময়ের অনুসারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এ সময় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে চট্টগ্রাম আদালত চত্বরের বাইরে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে চট্টগ্রাম কারাগারে রয়েছেন চিন্ময়।
তবে গ্রেফতারির পর বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বা চিন্ময় কুমার ধরের জন্য এর আগেও একাধিকবার জামিনের আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু জামিন পাওয়া যায়নি। উল্টে আদালত চত্বরে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিন্ময় প্রভুর হয়ে লড়েছিলেন যে আইনজীবীরা, তাঁরা নিগৃহীত হয়েছিল মারাত্মক ভাবে। প্রায় ছয় মাসের কাছাকাছি সময় ধরে জেলবন্দি ছিলেন চিন্ময় প্রভু। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির কথা বলে জামিনের আবেদন করলেও বাংলাদেশের আদালত জামিন মঞ্জুর করেনি। তবে অবশেষে ৩০ এপ্রিল, ২০২৫, বুধবার জামিন পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেটাও ক্ষণিকের জন্য।
চিন্ময় প্রভুর জামিনে স্থগিতাদেশ বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের
কারন, জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরিদ উদ্দিন খান। এই আবেদনের ওপর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আগামী রোববার শুনানি হতে পারে।
চিন্ময় প্রভুর গ্রেফতারে উত্তাল বাংলাদেশ
প্রসঙ্গত, চিন্ময় প্রভুর গ্রেফতারের পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল ক্ষোভের আগুন। তাঁর মুক্তির জন্য গলা তুলেছিলেন বিভিন্ন দেশের মানুষ। আসলে চিন্ময় প্রভুর বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিলেন চট্টগ্রামের এক বিএনপি নেতা ফিরোজ খান। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মামলা করায় বিএনপি ওই নেতাকে বহিষ্কার করলেও মামলা বহাল থাকে। আর সরকারপক্ষ বারে বারে জামিনের আবেদনের বিরোধিতা করায় অসন্তোষ দেখা দেয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে। একজন সাধুকে কেন জামিন না দিয়ে জেলে আটকে রাখা হয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে সে ব্যাপারে জবাবদিহি করতে বলেছিল।
হিন্দুদের প্রতিবাদে উত্তাল ঢাকা
চিন্ময় কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতার করার পর থেকেই হিন্দুদের বিক্ষোভে উত্তাল হয় বাংলাদেশ। হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই পড়শি দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন ভয়ঙ্কর হয়েছে বলে, একাধিক অভিযোগ এসেছে। সমানাধিকারের দাবিতে ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই বহুবার পথে বসে বিক্ষোভ জানিয়েছে সে-দেশের হিন্দুরা। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের মধ্যে মানসিক দৃঢ়তা সঞ্চার করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী। বিভিন্ন সময় তাঁর মন্তব্য ভাইরাল হয়েছে। সে-দেশের হিন্দুদের কাছে তিনি গুরুপ্রতিম। তাই চিন্ময় কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারীকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গ্রেফতার করার পর থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ।
গত বছর চিন্ময় কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারীর গ্রেফতারের পর থেকে ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা শাহবাগ এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সে সময় নেটমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন ভিডিওয় দেখা গিয়েছে, রাজধানী ঢাকার পথে পথে প্রভুর অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে অবরোধ চলছে। ঢাকা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে দাবি, ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসায়ন্স বা ইসকন-এর সদস্যরাও চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। বিক্ষোভ চলাকালীন অজ্ঞাত ব্যক্তিদের হামলায় বেশ কয়েকজন আহতও হয়েছেন।
প্রতিবাদ চট্টগ্রামেও
প্রভুর গ্রেফতারের প্রতিবাদে বাংলাদেশের চট্টগ্রামেও মানুষ বিক্ষোভ করেছে। সংখ্যালঘু হিন্দুরা সন্ন্যাসীর গ্রেফতারির প্রতিবাদে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে স্লোগান তুলেছে। Voice Of Bangladesh Hindus নামে এক সংস্থা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছে, ‘বাংলাদেশের অবস্থা খুবই খারাপ। ঢাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা। আমরা সংখ্যালঘুরা মার্কিন হস্তক্ষেপ চাইছি, আমরা আমেরিকান সেনাদের সাহায্য চাইছি।’
বাংলাদেশের ইসকনের প্রতিক্রিয়া
এদিকে সনাতনী নেতার গ্রেফতারি এবং জামিন না দেওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণা কনসিয়াসনেস (ইসকন)৷ সেসময় একটি বিবৃতিতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারির কড়া নিন্দা করা হয়েছে ইসকনের তরফে৷ পাশাপাশি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে হিন্দুদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছিল৷
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ইসকন-এর সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী বলেছিলেন, “আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন৷ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারির তীব্র নিন্দা করছি৷ এর পরবর্তী যে সংঘর্ষ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সনাতনীদের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, তারও নিন্দা করছি৷”
চট্টগ্রামে হিন্দুদের প্রতিবাদ মিছিলে হামলা
অন্যদিকে চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের মুক্তির দাবিতে গতবছর চট্টগ্রামে হিন্দুদের প্রতিবাদ মিছিলে হামলার ঘটনায় সংঘর্ষে এক আইনজীবী নিহত হয়েছিলেন। প্রশাসন সূত্রের খবর, সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে বছর পঁচিশের ওই তরুণ শিক্ষানবীশ আইনজীবী গোলমালের মাঝে পড়ে গিয়ে নিহত হন। তবে তাঁর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যায়নি।
অশান্ত বাংলাদেশে আটক ৩০
আইনজীবী হত্যা এবং নিরাপত্তা কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগে প্রায় ৩০ জনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী(সেনা ও পুলিশ)। সরকারি আইনজীবীকে হত্যার অভিযোগে ছয়জনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে পুলিশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার উৎখাতের পর থেকে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনা বাড়ছে। উগ্রপন্থীরা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করছে। পুলিশের এই পদক্ষেপে সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
ঘটনার কঠোর সমালোচনা বঙ্গ বিজেপির
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের এই ঘটনার কঠোর সমালোচনা করেছে বঙ্গ বিজেপি। সাংসদ সুকান্ত মজুমদার চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুর গ্রেফতারের নিন্দা করে বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্করের হস্তক্ষেপের আবেদন জানিয়েছিলেন। সেসময় তিনি বলেছিলেন, “বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা জরুরি, শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বাংলাদেশের একজন সনাতনী হিন্দু নেতা, ইসকন মন্দিরের একজন সন্ন্যাসী এবং বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের কণ্ঠস্বর। সোমবার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার জন্য ঢাকা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে।”
অন্যদিকে শুভেন্দু অধিকারীও বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন সেসময়। সংখ্যালঘুদের জন্য লড়াই করছিলেন চিন্ময়কৃষ্ণ দাস প্রভু। অবিলম্বে চিন্ময়কৃষ্ণকে মুক্তি না দিলে সীমান্তে অবরোধ হবে। কলকাতায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনেও বিক্ষোভ দেখানো হবে বলেও জানিয়েছিলেন শুভেন্দু।
বাংলাদেশকে কড়া বার্তা ভারতের
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের পর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের একাধিক সংগঠন প্রতিবাদ সভা করে। আর ওই সভায় একাধিক হামলার ঘটনাও ঘটে। সেসব ঘটনারই নিন্দা করেছে ভারত। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সরকারকে আমরা অনুরোধ করছি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষত হিন্দুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। তাঁদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও মত প্রকাশের অধিকার রক্ষা করাও জরুরি।’
আসলে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, ধর্মীয় স্থানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনাগুলি উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মতো হিন্দু ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনার বিষয়টি দুই দেশের সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করেছে। সর্বোপরি চিন্ময় দাসকে গ্রেফতার করায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক বিরোধও বেড়েছে।