নিউজ ডেস্ক: খুব শিগগির জাতীয় জনগণনা শুরু হবে। ওই সময় আদমশুমারির সঙ্গেই জাতি গণনাও হবে। বুধবার ঘোষণা করলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। তিনি জানান, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সর্বসম্মতিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বুধবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটির বৈঠক ছিল। বৈঠক শেষে মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানান, এবার দেশে জনগণনার সঙ্গেই হবে জাতি গণনা। তবে সেই তথ্য আলাদাভাবে প্রকাশিত হবে না। জনগণনার সঙ্গেই প্রকাশিত হবে জাতি গণনার তথ্য। অর্থাৎ, এবার জনগণনার তথ্যের সঙ্গেই জানা যবে, দেশে কোন জাতির, কোন উপজাতির কত জনসংখ্যা রয়েছে।
এতদিন লাগাতার জাতি গণনার দাবি জানিয়ে আসছিলেন বিরোধীরা। বিশেষত কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী বারবার এই দাবিতে সরব হয়েছেন। এদিন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বে, রাজনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আসন্ন আদমশুমারিতে জাতি গণনা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এটি প্রমাণ করে যে সরকার সমাজের মূল্যবোধ এবং স্বার্থের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ তিনি একই সঙ্গে বলেন, কিছু রাজ্য ইতিমধ্যে এই গণনা শুরু করেছে। তবে বেশকিছু রাজ্যে প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ, যা সন্দেহ তৈরি করছে বলেও দাবি করেন তিনি।
অমিত মালব্যর মন্তব্য
উল্লেখ্য, বিহার বিধানসভা ভোটের আগে হাত শিবির ক্রমাগত এই বিষয়ে চাপ বাড়াচ্ছিল সরকারের উপর। তবে ঠিক আগে আগেই, বড় সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিল কেন্দ্র। এ প্রসঙ্গে বুধবার বিজেপি নেতা অমিত মালব্য কংগ্রেস সাংসদ এবং লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর সমালোচনা করে বলেন, আসন্ন আদমশুমারিতে জাতি গণনা করার কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
একইসঙ্গে এদিন এক্স হ্যান্ডেলের একটি পোস্টে অমিত মালব্য বলেছেন, “রাহুল গান্ধীর জাতি গণনার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের কৃতিত্ব নেওয়া বন্ধ করা উচিত। কারন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে ঘোষণাটি আসন্ন।”
কংগ্রেস এবং ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিকরা জাতি গণনাকে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে: অশ্বিনী বৈষ্ণব
রাহুল গান্ধী জাতি গণনার কথা বারবার বললেও এদিন অশ্বিনী বৈষ্ণব দাবি করেন, “কংগ্রেস সরকার বরাবর জাতি গণনার বিরোধিতা ক’রে আসছে। ২০১০ সালে মনমোহন সিং বলেছিলেন জাতি গণনার বিষয়টি মন্ত্রিসভায় বিবেচনা করা উচিত। এই বিষয়ে বিবেচনা করার জন্য মন্ত্রীদের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই জাতি গণনা সুপারিশ করে। যদিও কংগ্রেস সরকার জাতি গণনা করায়নি, কেবল মাত্র জাতি সমীক্ষা করায়।” এদিন অশ্বিনী আরও দাবি করেন, “এটা স্পষ্ট যে কংগ্রেস এবং ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিকরা জাতি গণনাকে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কিছু রাজ্য জাতি সমীক্ষা চালাচ্ছে। কিছু রাজ্য কাজটা ভালোভাবেই করেছে। আবার কিছু রাজ্য কেবল রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অস্বচ্ছভাবে এই ধরনের জরিপ পরিচালনা করেছে।” রাজনীতির দ্বারা আমাদের সামাজিক কাঠামো যাতে বিঘ্নিত না হয় তা নিশ্চিত করতে সমীক্ষার পরিবর্তে জাতিভিত্তিক জনগণনাকে জাতীয় জনগণনার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এটি আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করবে এবং দেশের অগ্রগতি অব্যাহত রাখবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে অশ্বিনী বৈষ্ণব বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত সমাজ ও দেশবাসীর মূল্যবোধ এবং স্বার্থের প্রতি সরকারের অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করে। অতীতের মতো, যখন সরকার সমাজের কোনও অংশকে কষ্ট না দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য ১০% সংরক্ষণ চালু করেছিল, এই সিদ্ধান্তও একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির প্রতিফলন।’
উল্লেখ্য, চলতি বছরের শেষে বিহারে বিধানসভা নির্বাচন ৷ রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে বিহারের রাজনীতিতে জাতিকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সমীকরণের বিশেষ তাৎপর্য আছে ৷ সেদিক থেকে জাতিভিত্তিক গণনার ঘোষণা সবদিক থেকেই বিশেষ ৷ আর তাছাড়া কংগ্রেস-সহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বারবার এই দাবি তুলেছে৷ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার৷ এক্স হ্যান্ডেলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন তিনি ৷ মুখ্যমন্ত্রী জানান, দীর্ঘদিন ধরে জাতিভিত্তিক জনগণনার পক্ষে সওয়াল করে আসছিলেন ৷ শেষমেশ কেন্দ্রীয় সরকার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তিনি খুশি ৷ এর ফলে সমাজের পিছিয়ে পড়া জাতির উন্নয়নের জন্য রূপরেখা তৈরির কাজ আরও ভালোভাবে করা সম্ভব বলে তাঁর অভিমত ৷
প্রসঙ্গত, শেষবার ২০১১ সালে ভারতে জনগণনা হয়েছিল। কোভিড এবং অন্যান্য জটিলতা কাটিয়ে চলতি বছরে নতুন করে জনগণনা হতে পারে। আগামী জনগণনা ডিজিটাল নির্ভর হবেই বলেই মনে করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে একমাত্র বিহার জাতি গণনা করেছে। তাতে উঠে এসেছে রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশই অতি-অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ। অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ ২৭.১ শতাংশ, ১৯.৭ শতাংশ তফসিলি জাতি এবং ১.৭ শতাংশ তফসিলি উপজাতি।’
দেশের তৃতীয় রাজ্য হিসাবে জাতিগত জনগণনা করিয়েছে তেলেঙ্গানা
রাহুল সরব হওয়ার আগেই অবশ্য বিহারে জাতিগত জনগণনা করান নীতীশ কুমার। পরে কর্নাটকেও জাত সমীক্ষা করানো হয়। দেশের তৃতীয় রাজ্য হিসাবে জাতিগত জনগণনা করিয়েছিল তেলেঙ্গানা। তবে বিহার বা কর্নাটক ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে সংরক্ষণ বাড়াতে পারেনি। কিন্তু তেলেঙ্গানার রেবন্ত রেড্ডির সরকার দেশের প্রথম রাজ্য হিসাবে জাতিগত জনগণনার রিপোর্টের ভিত্তিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করেছে। তেলেঙ্গানা সরকার বিধানসভায় যে বিল পাশ করিয়েছে, সেই বিল অনুযায়ী অনগ্রসর জাতির সংরক্ষণ বেড়ে হল ৪২ শতাংশ। যা আগে ছিল ২৯ শতাংশ। তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষণ ১৫ থেকে বাড়ি ১৮ শতাংশ করা হয়েছে। তফসিলি উপজাতির সংরক্ষণের পরিমাণ ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। সব মিলিয়ে এই বিল কার্যকর হলে সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭০ শতাংশ হয়ে যাবে। অর্থাৎ অসংরক্ষিত চাকরির পরিমাণ দাঁড়াবে মাত্র ৩০ শতাংশ।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, কোনও রাজ্যেই সংরক্ষণের পরিমাণ ৫০ শতাংশের বেশি হতে পারে না। তেলেঙ্গানার এই আইন কার্যকর করতে হলে সেই নিয়ম ভাঙতে হবে। যদিও বিল পাশ হলেই সেটা আইনে কার্যকর হবে না। এই আইন কার্যকর করতে হলে কেন্দ্রের অনুমতি লাগবে।
রাজ্যে জাতিগণনা কেন জরুরি
১৯৩১ সালের জনগণনার পর ভারতে আর কখনও পূর্ণাঙ্গ জাতিভিত্তিক জনগণনা না হওয়ায় তফসিলি জাতি ও জনজাতি ব্যতীত অন্য জাতিগুলির জনসংখ্যা এবং আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির প্রকৃত তথ্য নেই। ২০১১ সালে জাতীয় জনগণনার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক এবং জাতিভিত্তিক জনগণনা হয়েছিল। কিন্তু সেই গননার ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। ২০২১ সালের জনগণনা কোভিড অতিমারির সময় থেকেই স্থগিত হয়ে রয়েছে। তবে এই আসন্ন জনগণনায় তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানবোন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে পূর্ণাঙ্গ জাতিভিত্তিক জনগণনা সুনিশ্চিত করা সারা দেশের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি কর্মক্ষেত্রে সর্বশেষ স্টাফ সেন্সাসের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে। তার পরের তথ্য কেন প্রকাশিত হয়নি, তা রাজ্য সরকারের জবাবদিহি করা উচিত। ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গে মোট সরকারি কর্মচারী ছিল ৩০৫৫২৫, অর্থাৎ ৩ লক্ষের একটু বেশি (এই হিসাবে সরকারি স্কুলশিক্ষকদের ধরা হয়নি)। এর মধ্যে তফসিলি জাতির কর্মচারী ছিল ১৭%, জনজাতির ৫% আর অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মাত্র ৪.৩%। গ্রুপ-এ এবং গ্রুপ-বি পদে তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির অংশীদারি আরও কম। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনগ্রসর কল্যাণ নীতি অনুযায়ী রাজ্যে সরকারি চাকরির ২২% তফসিলি জাতির জন্য আর ৬% জনজাতির জন্য সংরক্ষিত হওয়ার কথা। বাস্তবে এই কোটা অপূর্ণ রয়ে গিয়েছে। সাচার কমিটি রিপোর্ট এবং রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ আসার পর ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষিত কোটা ৭% থেকে বাড়িয়ে ১৭% করা হয়েছিল, এবং ৪১টি অনগ্রসর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অনগ্রসর শ্রেণির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ২০১২ সালে রাজ্য বিধানসভায় অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণের জন্য নতুন আইন পাশ হওয়ার পর তালিকায় আরও ৬৫টি অনগ্রসর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাজ্য সরকার দাবি করেছিল যে, এর ফলে রাজ্যের মুসলমান সমাজের বহুলাংশই অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণের আওতায় এসে গেছে। কিন্তু ২০১৪-১৫ সালের পর থেকে স্টাফ সেন্সাস রিপোর্ট প্রকাশিত না হওয়ায় আদতে কত অনগ্রসর শ্রেণির মুসলমান এই সংরক্ষণের মাধ্যমে সরকারি চাকরি পেয়েছে সেটা আজ অবধি জানা যায়নি।
উল্লেখ্য, ১৯৮০-র মণ্ডল কমিশন বা ২০০৬-এর সাচার কমিটি রিপোর্ট দেখিয়েছিল যে তফসিলি জাতি, জনজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি এবং সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এখনও বহুবিধ বৈষম্য, বঞ্চনা এবং শোষণের শিকার। এই অন্যায্য স্থিতাবস্থার অবসান ঘটাতে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি প্রয়োজন। জাতিভিত্তিক আর্থ-সামাজিক জনগণনা তার প্রথম ধাপ।