নিউজ ডেস্ক: খুব শিগগির জাতীয় জনগণনা শুরু হবে। আর ওই সময়ই আদমশুমারির সঙ্গেই জাতি গণনাও হবে। বুধবার একথা ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। তিনি জানান, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সর্বসম্মতিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন্দ্রের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী জনগণনার অংশ হবে জাতিগণনা। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে কোন জাতির সংখ্যা কত, কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে কত উপজাতি রয়েছে, সেই সবকিছুর হিসেব থাকবে। আগামী বছর নাগাদ জনগণনার কাজ শুরু হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে। এ বছর বিহার এবং আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। আর তার আগে এই ঘোষণা করে কার্যতই চমক দিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।
জাতি গণনা কী?
জাতি গণনা বা জাতিগত আদমশুমারি বলতে বোঝায় আদমশুমারির সময় জাতিভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা। এই তথ্যে জাতিগত গোষ্ঠীর বন্টন, তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শিক্ষাগত অবস্থা এবং অন্যান্য সম্পর্কিত বিষয়গুলির বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়। জাতিগত আদমশুমারির পেছনের ধারণা হল সাধারণ আদমশুমারির সময় জাতি সম্পর্কিত প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করা।
ভারতে জাতি গণনার ইতিহাস
ভারতে জাতি গণনার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৮৮১ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনামলে জাতি গণনা নিয়মিতভাবে আদমশুমারি অনুশীলনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। তবে, ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম আদমশুমারির মাধ্যমে সরকার এই অনুশীলনটি বন্ধ করে দেয়। ভারত স্বাধীনতা লাভের পর, সরকার সামাজিক ও শিক্ষাগত মানদণ্ডের ভিত্তিতে নাগরিকদের চারটি বিস্তৃত গোষ্ঠীতে শ্রেণীবদ্ধ করে: তফসিলি উপজাতি (ST), তফসিলি জাতি (SC), অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী (OBC) এবং সাধারণ শ্রেণী। কিন্তু ১৯৫১ সাল থেকে ভারতে আদমশুমারির সময় সংগৃহীত তথ্যে হিন্দু ও মুসলিমের মতো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পাশাপাশি তফসিলি জাতি ও উপজাতির ব্যক্তিদের সংখ্যাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বৈদিক যুগ: জাতি বা বর্ণ ধারণাটি প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল, যেখানে সমাজকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র – এই চার বর্ণে ভাগ করা হতো।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ: ১৮৮১ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে ব্রিটিশ ভারতে আদমশুমারিতে জাতি গণনা করা হতো। ঔপনিবেশিক সরকার বিভিন্ন জাতি, ধর্ম এবং পেশা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করত, যাতে তারা ভারতীয় সমাজকে ভালোভাবে বুঝতে পারে।
স্বাধীন ভারত: ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম আদমশুমারিতে জাতি গণনা করা হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে সরকার কেবল তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের গণনা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
জাতি গণনার মূল বিষয়গুলি:
বর্ণ: প্রাচীন ভারতে বর্ণ বা জাতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিভাজন ছিল।
উপজাতি: ভারতে বিভিন্ন উপজাতি বা আদিবাসী গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের জাতিগত পরিচয় আলাদা।
অন্যান্য জাতিগত গোষ্ঠী: বিভিন্ন জাতিগত এবং ভাষাগত গোষ্ঠীর মানুষ ভারতের বিভিন্ন অংশে বসবাস করে।
জাতি গণনার তথ্য ব্যবহার ও সামাজিক নীতি নির্ধারণ: জাতিগত তথ্য ব্যবহার করে সরকার সামাজিক নীতি নির্ধারণ করে, যেমন – শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়া: জাতিগত পরিচয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
জাতিগত আদমশুমারি কীভাবে একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল?
মন্ডল কমিশন (১৯৮০): কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে ওবিসিদের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য মন্ডল কমিশনের সুপারিশ জাতিকে আবার রাজনৈতিক আলোচনায় নিয়ে আসে। সেসময় জাতিগত তথ্যের অভাবের কারণে ওবিসি জনসংখ্যা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা এবং পরিমাপ করা কঠিন হয়ে পড়ে, যা জাতিগত আদমশুমারির দাবিকে আরও উসকে দেয়।
আর্থ-সামাজিক ও বর্ণ শুমারি (SECC) ২০১১: ২০১১ সালে, ইউপিএ সরকার আর্থ-সামাজিক ও বর্ণ শুমারি পরিচালনা করে, যা ১৯৩১ সালের পর দেশব্যাপী বর্ণ তথ্য সংগ্রহের প্রথম প্রচেষ্টা ছিল। তবে, SECC ২০১১ থেকে প্রাপ্ত বর্ণ তথ্য কখনই সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা হয়নি, যার ফলে বিরোধী দল এবং জাতি-ভিত্তিক সংগঠনগুলি সমালোচনার মুখে পড়ে।
রাজ্য-স্তরের উদ্যোগ: জাতীয় জাতিগত আদমশুমারির অনুপস্থিতিতে, বিহার, তেলেঙ্গানা এবং কর্ণাটকের মতো রাজ্যগুলি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তাদের নিজস্ব জাতিগত জরিপ পরিচালনা করেছে। এই জরিপগুলির লক্ষ্য ছিল রাজ্য-নির্দিষ্ট সংরক্ষণ নীতি এবং কল্যাণ কর্মসূচিগুলিকে সমর্থন করার জন্য তথ্য সংগ্রহ করা। ২০২৩ সালে বিহারের জাতিগত জরিপে দেখা গেছে যে রাজ্যের জনসংখ্যার ৬৩ শতাংশেরও বেশি ওবিসি এবং অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রেণী (ইবিসি) ছিল।
জাতি গণনার গুরুত্ব:
জাতি গণনা বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ:
জাতীয় ঐক্য: জাতি গণনা জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা এবং জাতীয় ঐক্যে সহায়তা করে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন: জাতি গণনার মাধ্যমে বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়, যা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা তৈরি করতে সাহায্য করে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: জাতি গণনার তথ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে, যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে।
জনসংখ্যা পরিকল্পনা: জাতি গণনা জনসংখ্যার গঠন এবং বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা দেয়, যা জনসংখ্যা পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সঠিক জাতিগত তথ্য বর্তমান আর্থ-সামাজিক বৈষম্য মোকাবেলায় শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণের মতো ইতিবাচক পদক্ষেপ তৈরিতে সহায়তা করতে পারে। অনেকেই প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলিকে চিহ্নিত এবং উন্নীত করার জন্য জাতি গণনা অপরিহার্য বলে মনে করেন, কিন্তু মানুষ সতর্কও করে যে এটি জাতি পরিচয়কে আরও দৃঢ় করে তুলতে পারে এবং মানুষের মধ্যে বিভাজনকে আরও গভীর করতে পারে। জাতি গণনার ইতিহাস এবং গুরুত্ব আলোচনা করে, এটি দেখা যায় যে জাতি গণনা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি যা সমাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে এবং উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে।
শেষবার ২০১১ সালে ভারতের জনগণনা হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী, ১৮৭২ সাল থেকে প্রতি ১০ বছর অন্তরই ভারতের জনগণনা হয়ে আসছে। তবে এর আগে, ২০২১ সালে জনগণনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিডের জেরে তা বাতিল করা হয়। ২০২৫ সালে জনগণনার কাজ শুরু হবে বলে পরে ঠিক হয়। আগামী জনগণনা ডিজিটাল নির্ভর হবে বলেও জানা যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, এদিন জাতি গণনার ঘোষণা করতে গিয়ে কংগ্রেসকেই আক্রমণ করেন অশ্বিনী। পাশাপাশি, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডি জোটকেও আক্রমণ করেন তিনি। বলেন, “কংগ্রেসের সরকার বরাবরই জাতিগণনা এড়িয়ে এেসেছে। ২০১০ সালে মনমোহন সরকার বলেছিলেন, বিষয়টি মন্ত্রিসভায় ওঠা উচিত। মন্ত্রিদের নিয়ে একটি গোষ্ঠীও তৈরি করা হয়। প্রায় সব রাজনৈতিক দলই জাতিগণনাপ পক্ষে মত দেন। তার পরও কংগ্রেস সরকার জাতিগণনা করায়নি, শুধু জাতি সমীক্ষা করায়। বোঝাই যাচ্ছে, কংগ্রেস এবং ইন্ডি জোট জাতিগণনাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সমীক্ষায় সমাজে ধন্দ তৈরি হয়। স্বচ্ছতা তৈরি করতে গণনা প্রয়োজন। তাই আজ মন্ত্রিসভা জনগণনায় জাতিগণনাকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”