নিউজ ডেস্ক: কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে হামলা চালাতে কীভাবে জঙ্গি জাল বিস্তার করেছিল পাকিস্তান? এনআইএ-র তদন্তে বেরিয়ে এল চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। দেখা যাচ্ছে আইএসআই থেকে লস্কর থেকে কাশ্মীরের ওভারগ্রাউন্ড ওয়ার্কার। এক তারে বেঁধে ফেলেছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানে বসেই হয়েছিল চক্রান্ত। কাজে লাগানো হয়েছিল পহেলগাঁও থেকে রাজৌরি, দক্ষিণ কাশ্মীর জুড়ে ২,৫০০-র বেশি চরকে। হামলার ১০ দিন পর প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা NIA ।
প্রমাণ সংগ্রহ
গত ১০ দিন ধরে প্রচুর ফরেনসিক তথ্য সংগ্রহ করেছে এনআইএ। যোগাড় করেছে ইলেকট্রনিক ডেটা। হামলাস্থল থেকে উদ্ধার হয়েছে ৪০টির বেশি কার্তুজ। সেগুলো ব্যালিস্টিক ও কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের জন্য পাঠানো হয়েছে। বৈসরণ এলাকার থ্রি ডি ম্যাপিং করানো হয়েছে। উপত্যকার মোবাইল টাওয়ার থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
জানা যাচ্ছে, হামলাকারীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখার জন্য স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করছিল।এখনও বৈসরণ এলাকায় ৩টি স্যাটেলাইট ফোন সচল আছে। এরমধ্যে ২টির সিগন্যাল সনাক্ত করা গেছে। তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জিজ্ঞাসাবাদ ও আটক
এখনও পর্যন্ত ২,৮০০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এনআইএ ও নিরাপত্তা আধিকারিকরা। ২রা মে পর্যন্ত ১৫০ জনের বেশি কাশ্মীরিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের আরও জেরা করার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে যেমন আছে ওভারগ্রাউন্ড ওয়ার্কার্স, তেমনি আছে জামাত ই ইসলামি সহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ শাখার সদস্যরা।
তল্লাশি চলছে কুপওয়ারা, পুলওয়ামা, সোপোর, অনন্তনাগ, বারামুল্লায়। সীমান্ত পারাপারে সাহায্য করে এমন সন্দেহভাজনদের জেরা করা হচ্ছে।
তল্লাশি চালানো হয়েছে মুস্তাক আহমেদ জারগর ওরফে লাতরামের বাড়িতে। ১৯৯৯ সালে বিমান অপহরণ কাণ্ডে যুক্ত ছিল ওই মুস্তাক। বর্তমানে সে পাকিস্তানে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে মুস্তাকের শ্রীনগরের বাড়িটিকে ইউএপিএ-র অধীনে অ্যাটাচ করা হয়েছিল।
পহেলগাঁও কাণ্ডের ১০দিন পর প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা NIA । সেই রিপোর্টে উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যাচ্ছে প্রাথমিক রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে এই হামলার নেপথ্যে রয়েছে লস্কর, পাক সেনা এবং পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের সম্মিলিত ষড়যন্ত্র। ২২ এপ্রিল পহেলগাঁও হামলা চালায় সন্ত্রাসবাদীরা। ২৬ জনের মৃত্যু হয়। ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও হামলার মূল অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার বা নিকেশ করা যায়নি। তারমাঝেই প্রকাশ্যে এল এই রিপোর্ট। এখন দেখার কী সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার।
জেলে গিয়ে লস্কর জঙ্গিদের জেরা?
NIA সূত্রে খবর, খুব শীঘ্রই তারা লস্করের স্লিপার সেলের সঙ্গে জড়িত ২ জঙ্গি নিসার আহমেদ ওরফে হাজি ও মুস্তাক হুসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ২ জনেই এখন কাশ্মীরের ভালওয়াল জেলে বন্দি। ২০২৩ সালে সেনা কনভয়ে হামলার পিছনে এরা যুক্ত ছিল।গোয়েন্দাদের সন্দেহ, সেনা কনভয়ে হামলা ও পহেলগাম হামলা একই লস্কর মডিউলের কাজ।
২০ কিমি ব্যাসার্ধ জুড়ে জঙ্গি খোঁজ
হামলাকারী জঙ্গিদের এখনও খোঁজ মেলেনি। নিরাপত্তা বাহিনী তাদের জীবিত ধরার চেষ্টা করছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, জঙ্গলের মধ্যে বা কোনও গুহার মধ্যে তারা লুকিয়ে থাকতে পারে। স্থানীয় সূত্রে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলেও মনে করছে গোয়েন্দারা। তাই ঘন জঙ্গলের মধ্যে চিরুণি তল্লাশ জারি রয়েছে। তল্লাশি চলছে বৈসরণ ভ্যালি, তারনু, হাপ্তগুন্ড, দায়ারু সহ কাছাকাছি সমস্ত অঞ্চলে। পহেলগাঁও ও বৈসরণ ভ্যালির ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মোবাইল ফোন ও কল ডিটেলস খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ২০ এপ্রিল থেকে সেখানে কার সঙ্গে কার কথা হয়েছল, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
এনআইএ সূত্রে খবর, হামলার ঠিক আগে বৈসরনে দু’টি আল্ট্রা স্টেট সিগন্যাল চালু ছিল। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মোবাইল সংযোগ করে অডিয়ো, ভিডিয়ো এবং এসএমএসও করা হয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যবস্থায় মোবাইলের কোনও সিমকার্ড লাগে না। তদন্তকারীদের সন্দেহ, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই নিজেদের মধ্যে সংযোগস্থাপন করছিল জঙ্গিরা।
হামলার নেপথ্যে পাক গুপ্তচর সংস্থা ISI
এএনআইয়ের প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, পহেলগাঁওয়ে হামলার নেপথ্যে রয়েছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই ও জঙ্গি সংগঠন লস্কর এ তৈবার যোগসাজস। আইএসআইয়ের সিনিয়র আধিকারিকদের নির্দেশে লস্কর এই পরিকল্পনা করেছে। পাকিস্তানে লস্করের হেডঅফিসে এই পরিকল্পনা করা হয়।
হামলায় সরাসরি যারা যোগ দিয়েছিল, তাদের একজন হাসিম মুসা ওরফে সুলেমান ও আলি ভাই ওরফে তালহা। দুজনেই পাক নাগরিক। আটক জঙ্গিদের জেরা করে জানা গেছে, মুসা ও তালহা দুজনেই পাক হ্যান্ডলারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। কোন সময়ে কীভাবে হামলা চালাতে হবে, লজিটিক্স কী থাকবে, সব কিছুর নির্দেশই আসতো তাদের কাছে।
ধৃতদের জেরা করে জানা গেছে, ১৫ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে পৌঁছে গিয়েছিল ঘাতকেরা। তারা দলে ৪-৫ জন ছিল। বৈসরণ উপত্যকায় রেকি করার পাশাপাশি আরু, লিড্ডার নদীর ধারে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, বেতাব ভ্যালি ঘুরে দেখে এসেছিল তারা। এই বেতাব ভ্যালিতে স্থানীয়রাও প্রচুর পরিমাণে ভিড় করে। সেখানে নিরাপত্তারক্ষীও বেশি মজুত। তাই সবদিক খতিয়ে দেখেই বৈসরণ ভ্যালিতে হামলা চালায় তারা। ওই এলাকা অনেকটাই নির্জন ও জঙ্গলে ঘেরা।
তদন্তে সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য
পহেলগাঁও জুড়ে যেখানে যেখানে সিসিটিভি লাগানো আছে, তার ফুটেজ খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। হামলাকারীদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে এই সিসিটিভির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানও গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই জানিয়েছেন, হামলাকারীদের শরীরে ক্যামেরা লাগানো ছিল। গোয়েন্দারা মনে করছেন, প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য তারা এই কৌশল নিয়েছিল। তবে কোন গোপন গুহায় বা কোন গভীর অরণ্যে তারা লুকিয়ে আছে, তা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে রয়েছে সেনাবাহিনী। শ্রীনগরে পৌঁছে গোটা ঘটনা খতিয়ে দেখছেন এনআইএ-র ডিজি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, জঙ্গিদের এক এক করে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হবে। অন্যদিকে পাকিস্তান চাইছে, সীমান্ত পার করে জঙ্গিদের ঘরে ফেরাতে। তাই লাগাতার তারা সীমান্তের ওপার থেকে গোলাবর্ষণ করছে। বোঝা যাচ্ছে তাদের প্রকৃত মানসিকতা। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সামনে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে যতই নিজেদের তারা নিরপরাধ প্রমাণ করার চেষ্টা করুক না কেন, সারা বিশ্বের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেছে, কীভাবে ও কারা চালিয়েছে এই বর্বরোচিত হামলা।