নিউজ ডেস্ক: স্বপ্নের ছুটি কাটাতে ওরা ছুটেছিলেন কাশ্মীরে। কিন্তু তা পরিণত হল দুঃস্বপ্নে। স্ত্রী ও ছেলে মেয়ের সামনে জঙ্গিদের গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন আইবি অফিসার মণীশরঞ্জন মিশ্র। কাশ্মীরের পহেলগাঁও জঙ্গি হামলায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম পুরুলিয়ার মণীশরঞ্জন মিশ্র।পেশায় তিনি একজন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্মী। কর্মসূত্রে স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন হায়দরাবাদে। গত ১৫ এপ্রিল হায়দরাবাদ থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন মণীশ। প্রথমেই তাঁদের গন্তব্য ছিল অযোধ্যা। সেখান থেকে হরিদ্বার হয়ে কাশ্মীরে পৌঁছন তাঁরা। পহেলগাঁওয়ের সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে পরিবার নিয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন মণীশ। কথা ছিল সেখান থেকেই বৈষ্ণোদেবী যাবেন। সেখানে তাঁদের সঙ্গে পরিবারের কয়েকজন সদস্য যোগ দিতেন। কিন্তু তা হয়নি। তাঁকে ফিরতে হল কফিনবন্দি হয়ে। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে মণীশের শরীর।
ক্রিকেট থেকে কুইজ, সবার নজরে মণীশ
সবদিক থেকেই অসাধারণ ছিলেন মণীশ। যেমন ভালো ছিলেন খেলাধূলায়, তেমনি ভালো পড়ালেখায়। বইয়ের পোকা ছিলেন তিনি। খেলতেন ক্রিকেট। স্কুল থেকে কলেজে যোগ দিতেন কুইজ প্রতিযোগিতায়। ২০১২ সালে ২৯ বছর বয়সে যোগ দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ইনটেলিজেন্স ব্যুরো অফিসে। কিন্তু মাত্র ৪২ বছর বয়সেই শেষ হয়ে গেল এই তরুণ প্রাণ।
যাযাবর জীবন
মণীশের পরিবার থাকে ঝালদার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের পুরনো বাঘমুণ্ডি রোডে। আগে তিনি কর্মসূত্রে রাঁচীতে ছিলেন। ৬ বছর সেখানে কাজ করেন। মাস কয়েক হল হায়দরাবাদে বদলি হয়ে যান। সেখানে তাঁর সঙ্গে থাকতেন স্ত্রী, তাঁদের এক পুত্র এবং কন্যা। তাঁদের নিয়েই কাশ্মীরে গিয়েছিলেন। পরিকল্পনা ছিল, পহেলগাঁও ঘুরে বৈষ্ণোদেবী দর্শনে যাবেন। কিন্তু তা আর হল না।
তীর্থ পথে শোক বার্তা
মণীশের ভাই দীনেশরঞ্জন বলেন, ‘‘বৌদি, সন্তানদের নিয়ে দাদা অযোধ্যা ও হরিদ্বার হয়ে কাশ্মীরে পৌঁছেছিলেন। সেখান থেকেই তাঁদের বৈষ্ণোদেবী যাওয়ার কথা ছিল। আমাদেরও সেখানে যাওয়ার কথা। কিন্তু রাস্তাতেই দুঃসংবাদ পাই।’’ মণীশের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে ঝালদায়।
পৃথিবী ভেঙে খানখান
মণীশের বাবা ছেলের মৃত্যু সংবাদ শুনে শোকে পাথর হয়ে যান। ঝালদা হিন্দি হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন তিনি। এখন অবসরপ্রাপ্ত। সেই মঙ্গলেশ মিশ্র জানান, ‘আমার সারা পৃথিবী ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। মণীশই সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাত্র ছিল। কারুর সঙ্গে বিবাদ ছিল না। একেবারে ভোলেভালা। তার এরকম অবস্থা হল, ভাবা যায় না। কেউ আমার কষ্ট বুঝতে পারবে না।‘
জন্মসূত্রে সাসারাম
মণীশের কাকা অলোক কুমার প্রিয়দর্শী জানান, ‘পরিবার নিয়ে ওরা যখন কাশ্মীর গেল, আমাদেরও যেতে বলেছিল। কিন্তু শরীর ভালো না থাকায় যাইনি। মণীশের জন্ম বিহারের সাসারামে। সেখানেই ছোটবেলায় স্কুলে ভর্তি হয়। পরে দাদা পুরুলিয়ার স্কুলে চাকরি পেলে সেখানে চলে যায়। মণীশই দাদার বড় ছেলে। সকলের খুব প্রিয় ছিল সে।‘
রাঁচির বন্ধুর আক্ষেপ
মণীশের রাঁচীর এক বন্ধু জানান, “কুইজ কম্পিটিশনে যোগ দিতে প্রায়ই রাঁচিতে আসতো মণীশ। সে অলরাউন্ডার ছিল। সকলের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করতো। আমার ছোট ভায়ের মতো। এভাবে তার গুলিবিদ্ধ দেহ দেখতে হবে, ভাবতে পারিন। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আমাদের একযোগে লড়তে হবে। “
কী দোষ ছিল ওঁদের! নেহাতই ছুটি কাটাতে বেছে নিয়েছিলেন কাশ্মীর ভ্রমণ। আপাতদৃষ্টিতে শান্ত হয়ে আসা উপত্যকায় পরিবার নিয়ে ঘুরছিলেন নিজের আনন্দে। আচমকাই জঙ্গিদের বেশে যে মৃত্যুদূত আসতে পারে, ভাবতে পারেননি কেউই। পরিবারের চোখের সামনে এভাবে যে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মারা যায়, তা বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউ। সকলেই স্তম্ভিত কাশ্মীরের জঙ্গিদের রূপ দেখে। স্তম্ভিত এই চলতে থাকা সন্ত্রাসবাদের চেহারা দেখে। সকলের প্রশ্ন, এরা কীভাবে তৈরি? এদের মানবিকতা কোথায়? আসলে কী চায় তারা?