নিউজ ডেস্ক: যেকোনও সময়ে শুরু হবে অ্যাকশন। ভারতের ভয়ে থরহরিকম্প পাকিস্তান। ভয় এতটাই যে মাঝ রাতে বড় নির্দেশ দিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি। ডাকলেন বিশেষ অধিবেশন। কী হবে এই অধিবেশনে, তা নিয়েই জল্পনা। আসলে পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একের পর এক কড়া পদক্ষেপ করছে ভারত সরকার। স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে সিন্ধু জল চুক্তি। বন্ধ সীমান্ত, পাকিস্তানি নাগরিকদের দেশে ফিরে যাওয়ার কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভিসাও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে পাকিস্তানিদের। নতুন ভিসাও দেওয়া হবে না। পাকিস্তান ভারতের এয়ারস্পেসও ব্যবহার করতে পারবে না। এসবের মধ্যেই এবার শনিবার ভারত পাকিস্তান থেকে সমস্ত আমদানি বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানের জন্য ভারতীয় বন্দরও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের কোনও জাহাজ ভারতের বন্দরে ঢুকতে বা নোঙর করতে পারবে না। একইসঙ্গে ডাক যোগাযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানকে ভাতে মারার চেষ্টা ভারতের
সামরিক প্রস্তুতি তো চলছেই, এ বার পাকিস্তানকে ভাতে মারার চেষ্টা। শনিবার পাকিস্তানের উপর ভারত যে তিন দফা নিষেধাজ্ঞা চাপানোর কথা ঘোষণা করেছে, তাতে এমন ইঙ্গিতই দেখছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। আসলে সরাসরি পাকিস্তানের নাম না করলেও ‘সন্ত্রাসের মদতদাতা’ হিসেবে প্রতিবেশীকেই যে নিশানা করেছেন নরেন্দ্র মোদী, তা মোটামুটি স্পষ্ট। আর সেই মদতদাতাকে কোণঠাসা করতেই শনিবারের নয়া তিন নিষেধাজ্ঞা।
কী সেই নিষেধাজ্ঞা?
প্রথমত, পাকিস্তান থেকে সরাসরি বা ঘুরপথে যে কোনও ধরনের দ্রব্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। জাতীয় সুরক্ষার কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত।
দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান থেকে ডাকযোগে আসা সব ধরনের চিঠিপত্র এবং পার্সেলের উপর নিষেধাজ্ঞা।
তৃতীয়ত, পাকিস্তানের পতাকাবাহী কোনও জাহাজকে ভারতের কোনও বন্দরে নোঙর করতে দেওয়া হবে না। ভারতের কোনও জাহাজও পাকিস্তানের বন্দরে নোঙর করবে না।
পাক সরকারের সমুদ্র বিষয়ক মন্ত্রকের বন্দর ও জাহাজ চলাচল বিভাগ শনিবার এই বিবৃতি জারি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘‘পড়শি দেশের সঙ্গে সমুদ্র বিষয়ক সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে পাকিস্তান তার সমুদ্রের স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য, অর্থনৈতিক এবং জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত করতে পদক্ষেপ করছে: ভারতের পতাকাধারী কোনও জাহাজকে পাকিস্তানের বন্দরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। পাকিস্তানের পতাকাধারী কোনও জাহাজ ভারতের বন্দরে ঢুকবে না। কোনও ঘটনায় এর ব্যতিক্রম হলে তা আলাদা করে যাচাই করা হবে এবং তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’
একের পর এক খাঁড়া নেমে আসায় কার্যত দিশেহারা পাকিস্তান। এমত অবস্থায় শনিবার, ৩ মে মধ্য রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি সংসদের বিশেষ অধিবেশনের ডাক দেন। জানা গিয়েছে, আগামী সোমবার, ৫ মে বিকেল ৫টায় এই অধিবেশন বসবে। সূত্রের খবর, ভারতের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করতেই এই অধিবেশনের ডাক দিয়েছেন পাক প্রেসিডেন্ট।
আমদানি-রপ্তানি সম্পর্ক
এমনিতে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতে আমদানি বাণিজ্য নগণ্য। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১–২২ সালে পাকিস্তান থেকে ভারতের আমদানি বাণিজ্য হয়েছিল মাত্র ২৫.৪ লক্ষ ডলারের, যেখানে ভারত পাকিস্তানে রপ্তানি করেছিল প্রায় ৫২ কোটি ডলারের দ্রব্য। একই ভাবে ২০২২–২৩ অর্থবর্ষে পাকিস্তান থেকে ভারতের আমদানি ২.০১ কোটি ডলারের, যেখানে রপ্তানি প্রায় ৬৩ কোটি ডলারের। অর্থাৎ, ভারত থেকেই বেশি দ্রব্য যায় পাকিস্তানে। ২০২৪–এর এপ্রিল থেকে ২০২৫–এর জানুয়ারির মধ্যেও পাকিস্তান থেকে ভারতের আমদানির অর্থমূল্য মাত্র ৪.২ লক্ষ ডলার! যেখানে ভারত থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি ডলারের সামগ্রী। অর্থাৎ, বাণিজ্য ক্ষেত্রে পাকিস্তানেরই ভারত–নির্ভরতা বেশি। পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক লেনদেন ভারতের মোট বাণিজ্যের মাত্র ০.০৬ শতাংশ! অর্থাৎ, পাকিস্তান ভারতীয় দ্রব্য আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করলে ভারতের খুব একটা চাপ হবে না, কিন্তু দূরের দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে গিয়ে বেশি কড়ি গুণতে হবে পাকিস্তানকেই। আবার ভারত দরজা বন্ধ করে দেওয়ায় পাকিস্তানের রপ্তানিও পড়বে মুখ থুবড়ে। ফলে অর্থনৈতিক ভাবে ধুঁকতে থাকা ইসলামাবাদের বিপদ আরও বাড়ার আশঙ্কা।
পাকিস্তানের আকাশ এড়িয়ে যাচ্ছে অন্যান্য দেশের উড়ানও
অন্যদিকে, পহেলগাম হামলার পর ভারত–পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতির কথা মাথায় রেখে পাকিস্তানের আকাশ এড়িয়ে যাচ্ছে অন্যান্য দেশের উড়ানও৷ সূত্রের দাবি, এর জেরে প্রতিদিন অন্তত ৩ মিলিয়ন বা ৩০ লক্ষ ডলার ক্ষতি হচ্ছে পাকিস্তানের! কারণ, পাক আকাশ এড়িয়ে যাওয়া বিমানগুলির থেকে কোনও ‘পরিষেবা ফি’ পাচ্ছে না পাকিস্তানের লাহোর এবং করাচি এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)৷ কোনও দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করলে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স একটি নির্ধারিত মূল্যের ‘ফি’ দিয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট রুটের পরিষেবা প্রদানকারী এটিসিকে, যা পাচ্ছে না পাকিস্তান৷ আগামী দিনে এই অবস্থা চলতে থাকলে পাকিস্তানের রাজকোষের হাল আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা।
যুদ্ধ এড়াতে ‘ঈশ্বরে’ ভরসা পাক-প্রতিরক্ষামন্ত্রীর
এসবের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ সতর্ক করে বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সংঘাতের সম্ভাবনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে, যদিও বিভিন্ন দেশ এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছে। পহেলগাঁওয়ে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা এবং নিয়ন্ত্রণ রেখায় (এলওসি) পাকিস্তানের অযাচিত গুলিবর্ষণের পর উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে। আসিফের এই মন্তব্য দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধের আশঙ্কাকে আরও জোরালো করেছে।
পাকিস্তান তাদের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করেছে এবং উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। আসিফ জানিয়েছেন, পাকিস্তান কেবল “অস্তিত্বের সরাসরি হুমকি” হলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। তিনি আরও বলেন, তারা খলিস্তানি নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুকে হত্যার জন্য ভারতকে দায়ী করছে এবং পাকিস্তানের শহরগুলোতে ভারত জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করছে বলে অভিযোগ করেছেন।
ভারতের অবস্থান
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং পহেলগাঁও হামলার পর প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) হামলার তদন্তে নেমেছে, এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। তবে জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ পাকিস্তানের নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। পহেলগাঁও হামলা এবং এলওসি-তে পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে একটি বিপজ্জনক মোড়ে নিয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে খাজা আসিফের মন্তব্য, বিশেষ করে যুদ্ধের সম্ভাবনা এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি, পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। ভারতের কঠোর কূটনৈতিক এবং সামরিক পদক্ষেপ এবং পাকিস্তানের পাল্টা ব্যবস্থা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। সর্বোপরি এই পরিস্থিতিতে ভারত-পাক কূটনৈতিক সম্পর্কও অনেকটাই খারাপ হয়েছে। দুই দেশ দূতাবাসের স্তরও নিচে নামিয়েছে। সীমান্তে উত্তেজনা তীব্র, নিয়মিত গুলি চালাচ্ছে পাকিস্তানি সেনা। এমত অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ এবং উভয় দেশের সংযমই এখন এই সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ।
ভয়াবহ স্মৃতির পুনরাবৃত্তি
প্রসঙ্গত, পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তির এক ভয়াবহ অনুভূতি ফিরিয়ে এনেছে। ২০১৬ সালে উরিতে ১৯ সেনা নিহত হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) পেরিয়ে পাকিস্তানে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায় ভারত। লক্ষ্য ছিল জঙ্গি ঘাঁটিগুলো। এরপর, ২০১৯ সালে ফের একই ঘটনা ঘটে। ভারতের পুলওয়ামায় বোমা হামলায় দেশটির ৪০ আধা–সামরিক জওয়ান নিহত হন। প্রতিক্রিয়ায় ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানও ভারতের একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে এবং এক পাইলটকে বন্দী করে। পরে অবশ্য তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এটি ছিল ভারতের এমন প্রথম পদক্ষেপ। এর আগেও, ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। হোটেল, রেলস্টেশন ও একটি ইহুদি কেন্দ্র ৬০ ঘণ্টা ধরে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল সন্ত্রাসীরা। এতে প্রাণ হারায় ১৬৬ জন।
প্রতিবারই ভারত এসব হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করেছে। ইসলামাবাদ তাদের পরোক্ষভাবে সমর্থন করছে—এমন অভিযোগ এনেছে। তবে পাকিস্তান বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।