নিউজ ডেস্ক: পহেলগাঁওতে বেছে বেছে হিন্দু নিধনের ১৩ দিন পার। এখনও পর্যন্ত অধরা জঙ্গিরা। সূত্র জানাচ্ছে, পহলগাম কাণ্ডে জড়িত জঙ্গিরা এখনও কাশ্মীরেই ঘাপটি মেরে রয়েছে। এই জঙ্গিরা অত্যন্ত সুকৌশলী ও যে কোনও রকম আত্মরক্ষার মতো স্বনির্ভর বলে জানা গিয়েছে। গত ২২ এপ্রিল পহলগামে গুলি করে বেছে বেছে হিন্দুদের নিধনের পর অনেকের সন্দেহ ছিল জঙ্গিরা সীমানা ডিঙিয়ে পালিয়ে গিয়েছে।
এখনও কাশ্মীরেই লুকিয়ে জঙ্গিরা?
কিন্তু, এনআইএ তদন্তে প্রকাশ তারা এখনও দক্ষিণ কাশ্মীরে লুকিয়ে রয়েছে এবং সক্রিয় রয়েছে। এই তদন্তের কাজে নিযুক্ত এক সূত্র জানাচ্ছে, তাদের সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য বেশ কিছু তথ্য হাতে এসেছে। তারা এখনও এই এলাকায় লুকিয়ে রয়েছে। জানা গিয়েছে, এই জঙ্গিরা পুরোপুরি আত্মনির্ভর। এদের কাছে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার রয়েছে, এছাড়াও অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জামও এরা নিয়ে এসেছে। সে কারণে স্থানীয়দের খাদ্য-আশ্রয় ছাড়াই তারা জঙ্গলঘেরা তরাই এলাকায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা আরও অপারেশন চালাতে পারে বলে সন্দেহ।
লক্ষ্য জীবিত অবস্থায় জঙ্গিদের ধরা
ভারতীয় সেনা চাইছে এই হত্যাকারীদের জীবিত গ্রেফতার করতে। তাই যথেষ্ট সাবধনতার সঙ্গে অপারেশন চালাতে হচ্ছে। এনআইএ সূত্রে জানা যাচ্ছে, পাকিস্তান থেকে আসা মোসা ও তালহা ভাই তারা দীর্ঘদিন পাহাড়ের জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে অপারেশন চালানোর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ তাদের রয়েছে। তাদের গতিবিধি সীমিত করে দেওয়া হচ্ছে সেনার তরফে। তাদের চারপাশের বৃত্তটা সেনা দ্বারা ঘিরে ফেলা হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, পহেলগাঁওয়ের ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে তারা। তবে এলাকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে জঙ্গিরা। পাকিস্তানও তাদের এখান থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছে। এমনও সম্ভাবনা রয়েছে যে গুহায় লুকিয়ে থাকা এই সন্ত্রাসীদের কাছে এখন মাত্র কয়েক দিনের খাবার অবশিষ্ট রয়েছে। এর পর তারা ক্ষুধায় কষ্ট পাবে এবং বের হয়ে আসতে বাধ্য হবে।
জঙ্গি লুকোচ্ছে পাকিস্তান?
উল্লেখ্য, পহেলগাঁও হামলার বদলা নেওয়ার স্বাধীনতা পেয়েছে ভারতীয় সেনা। তারপর থেকেই আতঙ্কে ভুগছে পাকিস্তানে বসে থাকা সন্ত্রাসবাদী নেতা হাফিজ সইদ। এহেন পরিস্থিতিতে এই জঙ্গি নেতাকে নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে রাখতে মাথলাকারী পায়ে ফেলছে পাকিস্তান। সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হওয়া পাকিস্তান অবশ্য একা হাফিজ সইদকে নয়, রক্ষা করছে আধ ডজন জঙ্গি নেতাকে। ভারতীয় সেনার পদক্ষেপের ভয়ে এই লস্কর জঙ্গিদের লুকিয়ে রেখেছে পাকিস্তান।
এছাড়াও পেহেলগাঁও-এ হাম্লাকাজঙ্গিদের খুঁজে বের করতে স্থানীয় সহায়তাকারীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে পাক হ্যান্ডলাররা। তবে জঙ্গিদের ধরতে অভিযানে যুক্ত নিরাপত্তা বাহিনী আত্মবিশ্বাসী যে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে জঙ্গিদের সঠিক অবস্থান ট্র্যাক করা যাবে এবং তারা ধরা পড়বে অথবা এনকাউন্টারে তাদের হত্যা করা হবে। সূত্রের খবর, এই মামলায় আপাতত তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে ব্যস্ত গোয়েন্দা সংস্থাগুলি। সমস্ত কার্যক্রম সম্পূর্ণ গোপন রাখা হচ্ছে।
তবে গোয়েন্দা সূত্রে খবর, পাক অধিকৃত কাশ্মীরের (পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর বা পিওকে) নিয়ন্ত্রণরেখায় রয়েছে একগুচ্ছ জঙ্গি লঞ্চ প্যাড। সেগুলির কোনওটা প্রশিক্ষণ শিবির, কোনওটাকে আবার ভারতে ঢুকে হামলার জন্য ব্যবহার করে থাকে ইসলামাবাদের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীরা। পহেলগাঁও হামলার পর প্রমাণ লোপাটে দ্রুত ওই লঞ্চ প্যাডগুলি খালি করতে চাইছে পাক গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স’ বা আইএসআই। বিশ্লেষকদের দাবি, সেই লক্ষ্যেই এলওসিতে লাগাতার বারুদ-বর্ষণ করছে পাক ফৌজ। ইসলামাবাদ ভাল করেই জানে এতে ভারতীয় সেনা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বর্ডার সিকিয়োরিটি ফোর্স বা বিএসএফ) নজর ঘোরানো যাবে। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে খালি করে ফেলা যাবে যাবতীয় জঙ্গি লঞ্চ প্যাড।
জানা গিয়েছে, কুপওয়াড়া, বারামুল্লা, পুঞ্চ, রাজৌরি, মেন্ধর, নৌসেরা, সুন্দেরবানি ও আখনুর সেক্টরে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গুলি চালিয়েছে পাকিস্তান সেনা। গুলির জবাব গুলি দিয়েই দিয়েছে ভারতীয় সেনাও। সংঘর্ষে ভারতের কোনও সেনা আহত হননি বলেই খবর। পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। আর সেই সুযোগেই ক্রমাগত সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন করছে পাকিস্তান। প্রতিদিনই রাতে ভারত-পাক সীমান্তে গুলি চালাচ্ছে পাক সেনা। বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণ রেখায় লাগাতার গুলি চালাচ্ছে।
গতকাল, শনিবার রাতেও ফের একই কাজ করে পাক সেনা। সূত্রের খবর, বাকি দিনের তুলনায় গতকাল পাকিস্তানের একাধিক পোস্ট থেকে গুলি চালানো হয়েছে ভারত লক্ষ্য করে। এর মধ্যে কুপওয়াড়া, বারামুল্লা, পুঞ্চ, রাজৌরি, মেন্ধর, নৌসেরা, সুন্দেরবানি ও আখনুর সেক্টর রয়েছে। প্রসঙ্গত, শনিবারই সীমান্তরক্ষী বাহিনী রাজস্থানে ভারত-পাক সীমান্তের কাছ থেকে এক পাকিস্তানি রেঞ্জারকে গ্রেফতার করে। ওই পাকিস্তানি রেঞ্জার জেনে বুঝেই ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিল। বর্তমানে বিএসএফের হেফাজতেই রয়েছে ওই পাক রেঞ্জার।
সূত্রের দাবি, সীমান্তের ওপারে বসে থাকা লস্কর কমান্ডার এবং পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই হাশিম মুসাকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এই মুসা হামলায় জড়িত ছিল। এক আধিকারিক জানিয়েছেন, মুসাকে গ্রেফতার করা হলে পাকিস্তানের মুখোশ খুলে দেওয়া আরও সহজ হয়ে যাবে। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, অনন্তনাগ জেলার ঘন জঙ্গল ও প্রাকৃতিক গুহাগুলি জঙ্গিদের ঢাল হিসেবে কাজ করছে। সেনার আশা, খুব শিগগিরই সঠিক স্থানে অভিযান চালানো হবে। জঙ্গিরা নিশ্চয়ই অন্তত ১৫-২০ দিনের রেশন জোগাড় করেছে। ২০ এপ্রিল থেকে পহেলগাঁও ও বৈসরন ও তার আশেপাশে যে সমস্ত মোবাইল ফোন সক্রিয় ছিল সেগুলির তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়াও সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত স্যাটেলাইট ফোনের বিশদ সংগ্রহের জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তাও নেওয়া হচ্ছে। প্রমাণের ভিত্তিতে নিরাপত্তা সংস্থাগুলি বিশ্বাস করে যে পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের নির্দেশে লস্কর-ই-তৈবা এই হামলা চালিয়েছে। যদিও পাকিস্তান এই দাবি অস্বীকার করে আসছে বিগত সময়ের মতোই।
অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনা থাকা সত্তেও কেন সন্ত্রাসবাদীদের রুখতে ব্যর্থ হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী?
আসলে অত্যন্ত দুর্গম পাহাড় ও ছায়াঘন জঙ্গলে ঢাকা কাশ্মীর উপত্যকা। পহেলগাঁওয়ের কাছে অবস্থিত সবচেয়ে উচুঁ পর্বতটির উচিচতা প্রায় এভারেস্টের অর্ধেক। যা বৈসরন থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দুরে। সবমিলিয়ে পহেলগাঁওয়ের সীমান্তবর্তী এলাকা দুর্গম পাহাড়ি ঢাল এবং ঘন বনের একটি গোলকধাঁধা তৈরি করে। যেখানে জঙ্গিরা অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারে। শহরের দক্ষিণ-পূর্বে ঘন বন, ঝর্ণা ও একটি কর্দমাক্ত দুর্গম ট্রেকরুট দিয়ে বৈসরন তৃণভূমিতে পৌঁছানো যায়। যার বেশিরভাগই যান চলাচলের উপযুক্ত নয়। ফলে খুব সহজেই এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভূ-খন্ডকে কাজে লাগিয়ে জম্মুর কাঠুয়া থেকে দক্ষিণ কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গিরা।
তবে, পিছিয়ে নেই ইন্ডিয়ান আর্মিও। ঘটনার পর থেকেই গোটা এলাকা ঘিরে ফেলেছে নিরাপত্তা বাহিনী। পাহাড়ি প্রতিকূলতাকে চ্যালেন্জ জানিয়ে চলছে চিরুনী তল্লাশি।
অন্যদিকে, ভারত-পাকিস্তান চলতি উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই পাঞ্জাবের অমৃতসর জেলার ভারোপাল গ্রামের কাছে জঙ্গি হামলার ছক ফাঁস। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পাঞ্জাব পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর যৌথ অভিযানে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গোয়েন্দা সূত্রে খবর পেয়ে বুধবার রাতে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। তল্লাশি চালিয়ে দুটি হাত গ্রেনেড, তিনটি পিস্তল, ৬টি ম্যাগাজিন ও ৫০টি কার্তুজ উদ্ধার হয়েছে।
ব্যাকফুটে পাকিস্তান
উত্তেজনার এই আবহে ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করেছে ভারত। পাশাপাশি, পশ্চিম সীমান্ত বসানো হয়েছে অত্যাধুনিক জ্যামার। সূত্রের খবর, এর ফলে পাকিস্তানি সেনার বিমান যে ‘গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম’ (জিএনএসএস) ব্যবহার করে লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান স্থির করে, তা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কমবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার ক্ষমতা। পাকিস্তানের সেনাবিমান লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান জানার জন্য জিপিএস (আমেরিকা), গ্লোনাস (রাশিয়া), বেইডু (চিন)— এই তিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এ বার এই তিন প্রযুক্তিকেই মাত দেবে ভারতীয় জ্যামিং প্রযুক্তি, জানিয়েছে নয়াদিল্লির একটি সূত্র। সবমিলিয়ে পাকিস্তান কিছুটা ব্যাকফুটে রয়েছে, তা বলাই যায়। জঙ্গি হামলার নিন্দা করেছে আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো তাবড় বিশ্বশক্তি। তবে পরমাণু শক্তিধর দুই দেশকেই সংযত হতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং চিন। এই পরিস্থিতিতে সংঘাতের জল কোন দিকে গড়ায়, সেটাই এখন দেখার।