নিউজ ডেস্ক: মুর্শিদাবাদে হিংসার জন্য নাম না করে হিন্দু সন্ন্যাসীর দিকে আঙুল তুললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওয়াকফ সংশোধিত আইনের বিরোধিতায় মুর্শিদাবাদে যে হিংসা শুরু হয়, তারপর এই প্রথম সেখানে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। এপ্রিল মাসের ওই দাঙ্গায় নির্মম ভাবে খুন হন দুই হিন্দু। ঘটনার কথা শুনেই সেখানে ছুটে যান রাজ্যপাল। আর সবকিছু শান্ত হওয়ার পর এবার গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি জানালেন, ধর্মীয় নেতা সেজে অনেকে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। এতে হাত আছে বহিরাগতদের।
মমতার নিশানায় ভারত সেবাশ্রম
মুর্শিদাবাদে হিংসার জন্য ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের এক সন্ন্যাসীর দিকে আঙুল তুললেন মুখ্যমন্ত্রী। কারও নাম নেননি মুখ্যমন্ত্রী। তবে ওই সন্ন্যাসী যে মুর্শিদাবাদ জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত, তা বুঝিয়ে দেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ৪৮ ঘণ্টা ওখানে আলো বন্ধ রাখা হয়েছিল কেন? কী লুকোতে চাইছিলেন ওই সন্ন্যাসী? ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘকে তিনি ভালোবাসেন বললেও, সন্ন্যাসীর কাজকর্মে প্রশ্ন তোলেন তিনি। আর এতেই বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন সন্ন্যাসীরা। তাঁদের মতে, আলো নিভিয়েই তো হিন্দুদের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। তাহলে সঙ্ঘের সন্ন্যাসীকে দায়ী করা হচ্ছে কীভাবে!
মাত্র ২টো ওয়ার্ডে গণ্ডগোল, দাবি মমতার
মমতা দাবি করেন, ‘মাত্র ২টো ওয়ার্ডে গন্ডগোল হয়েছে। সেটা হয়েছে পূর্ব পরিকল্পনা হুঁশয়ারি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি পরিষ্কার বলছি, এই তথ্য সবটাই সত্য। যাচাইয়ের আর কিছু বাকি আছে। সবটা পেয়ে গেলে সংবাদমাধ্যমের সামনে আসবে। জানা যাবে, কারা করেছে, কী ভাবে করেছে?’
বহিরাগতদের দুষলেন মুখ্যমন্ত্রী
এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এই জেলায় আমি দেখছি বহিরাহত কিছু লোক এসে ধর্মের নামে বিধর্ম কথাবার্তা বলে। আমি কোনও সম্প্রদায়কে এজন্য দোষ দেব না। কয়েকজন ধর্মীয় নেতা সেজেছে যারা পালে বাঘ না পড়লেও বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করে। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়। এবং তারাই কিন্তু দাঙ্গা ঘটিয়ে সবচেয়ে আগে পালিয়ে যায়। এরা বাংলার শত্রু। সবাই আমার মিত্র, কিন্তু দাঙ্গা যারা লাগায় তাদের আমি মিত্র বলে মনে করি না।’
বিএসএফকেও তির মুখ্যমন্ত্রীর
মমতার মতে, বিএসএফ গুলি না চালালে মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জে পরের দিন অশান্তির ঘটনা ঘটত না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এহেন মন্তব্য নিয়েই পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন বিজেপি নেতারা। তাঁদের মতে, ঘটনার দিন পুলিশ কোথায় ছিল? ৪ ঘণ্টা ধরে হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি হামলা হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে। বারবার জানানো সত্বেও পুলিশ হাজির হয়নি। সকলের সামনে খুন হয়ে গেছে ২ জন। এর পিছনে কাদের হাত ছিল? পুলিশ মন্ত্রী হয়ে তার জবাব দিতে পারবেন মমতা?
কী হয়েছিল মুর্শিদাবাদে?
ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বিরোধিতার নামে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে দাঙ্গা শুরু হয় মুর্শিদাবাদ জেলায়। সেখনে সামসেরগঞ্জ, ধুলিয়ান, সুতিতে হিন্দুদের বাড়ি-দোকান নির্বিচারে ভাঙচুর করে উন্মত্ত জঙ্গিরা। সামসেরগঞ্জের জাফরাবাদে বাড়ি থেকে টেনে বার করে কুপিয়ে খুন করা হয় পেশায় মূর্তি শিল্পী বাবা ও ছেলেকে। অভিযোগ, বার বার পুলিশকে ফোন করেও দীর্ঘক্ষণ সাহায্য পাননি আক্রান্তরা। এমনকী প্রাণ বাঁচাতে গঙ্গা নদী পার করে মালদার বৈষ্ণবনগরে আশ্রয় নেয় বহু হিন্দু পরিবার। ওই ঘটনার পর মুর্শিদাবাদে গিয়ে আক্রান্ত পরিবারগুলির সঙ্গে দেখা করেন রাজ্যপাল।
রাজ্যপালের রিপোর্টে ৩৫৬ প্রসঙ্গ
মুর্শিদাবাদে ওয়াকফ অশান্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে কড়া রিপোর্ট দিয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ করেছেন তিনি। তাঁর মতে, এটা পূর্ব পরিকল্পিত হামলা। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতার উল্লেখ করে রিপোর্ট দিয়েছেন তিনি। রিপোর্টে রাজ্যপাল উল্লেখ করেছেন, ধর্মীয় পরিচয় জেনে রাজনৈতিক হিংসা হয়েছে। রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়লে হস্তক্ষেপ করুক কেন্দ্র, সুপারিশ করেছেন রাজ্যপাল। এলাকায় স্থায়ী ভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের সুপারিশ করেছেন সিভি আনন্দ বোস।
প্রসঙ্গ এড়ালেন মমতা
রাজ্যপালের এই রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। রাজ্যপালের রিপোর্টকে স্বাগত জানিয়েছে বিজেপি। রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “আমরা এবার রেজাল্ট চাই। রাজ্যপাল বলেছেন, আবারও কিছু হলে রাষ্ট্রপতি শাসন করা হোক। রাষ্ট্রপতি শাসন জারির আবেদনের ক্ষেত্রে যে ধরনের নির্দিষ্ট সুপারিশের প্রয়োজন হয়, আমার মনে হয় না এক্ষেত্রে সেটা রয়েছে। তবে রিপোর্টটা স্বাগত জানানোর মতো। রাজ্যপাল গ্রাউন্ডে গিয়েছিলেন। এই রিপোর্টকে এককথায় বাংলার শান্তিকামী গণতান্ত্রিক মানুষ স্বাগত জানাতে পারেন।” তবে এনিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রস্ন করা হলে তিনি বলেন, এবিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
হিংসা নিয়ে ইন্ডিয়া টুডের রিপোর্ট
ইন্ডিয়া টুডের রিপোর্ট বলছে, মুর্শিদাবাদে ওয়াকফ আইন বিরোধী সমাবেশে বেশ কিছু উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখা হয়। তার কিছু ভিডিও-ও এসে পৌঁছায় ইন্ডিয়া টুডে টিভি-র কাছে। জঙ্গিপুরের পিডব্লুডি মাঠে এই সমাবেশ হয়েছিল। আয়োজক ‘ইমাম মোয়াজ্জিন অ্যাসোসিয়েশন’। আর তাকে সমর্থন করেছিল ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ ডেমোক্রেটিক রাইটস (APDR) এবং সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া (SDPI)-সহ বেশ কয়েকটি সংগঠন।
সূত্রের খবর, বেঙ্গল পুলিশের তদন্তকারীরা বেশ কিছু তথ্য হাতে পেয়েছেন। তাতে মুর্শিদাবাদের হিংসায় SDPI-এর জড়িত থাকার ইঙ্গিত মিলছে। পুলিশি তদন্তে জানা গিয়েছে যে, SDPI-এর সদস্যরা গত বেশ কয়েকদিন ধরে ওয়াকফের নামে এলাকার মুসলিম যুবকদের উস্কানি দিচ্ছিল। SDPI-এর সদস্যরা প্রত্যন্ত এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যুবক ও কিশোরদের ওয়াকফের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে বলছিলেন।
মুসলিম সম্প্রদায়ের যুবক ও কিশোরদের বলা হয় যে, সরকার ওয়াকফের নামে মুসলমানদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেবে। ফলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করতে হবে। এমন বেশ কিছু উস্কানিমূলক কথা বলা হয় বলে দাবি করা হচ্ছে।
SIMI-SDPI পরিকল্পিত চক্রান্ত ?
কেন্দ্রের প্রাথমিক রিপো্ট ও পুলিশি সূত্রে যে খবর উঠে আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, মুর্শিদাবাদে হিংসা ছড়ানোর পিছনে গুরুত্বপূর্ণ হাত আছে এসডিপিআই-এর। মুর্শিদাবাদে তাদের লোকবল বেশ শক্তিশালী। পুলিশের মতে, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গেই হিংসায় যোগ দিয়েছিল বাইরের লোকজন।
সিমির কা্র্যকলাপ
পুলিশের মতে, এক সময় বাংলায় সিমির কার্যকলাপ এই মুর্শিদাবাদেই সবচেয়ে বেশি ছিল। SIMI-র ফুল ফর্ম ‘Students’ Islamic Movement of India’। জঙ্গি সংগঠন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন-এর সঙ্গে এটি যুক্ত। তবে পরে, সিমি-র লোকেরা PFI-তে(Popular Front of India, কট্টরপন্থী সংগঠন) যোগ দেয়। মুর্শিদাবাদ পিএফআই-এর ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২-এ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বেআইনি কার্যকলাপ আইন (UAPA)-এর অধীনে পাঁচ বছরের জন্য এই পিএফআইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, নিষিদ্ধ সংগঠনের লোকজনই ওয়াকফের নামে মুর্শিদাবাদে দাঙ্গা বাঁধিয়েছে।
মৃতের পরিবারও দুষছে SDPI-কে
বিক্ষোভ চলাকালীন গুলিবিদ্ধ হয় ইজাজ আহমেদ। হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ইজাজের পরিবারও জানিয়েছে, মুর্শিদাবাদে SDPI উস্কানিমূলক প্রচার চালাচ্ছে।
হিংসার টাইমলাইন
সবার প্রথমে মুর্শিদাবাদের সুতিতে জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হয়। সেখান থেকেই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু। এর ঠিক পরপরই, বিপুল সংখ্যায় বিক্ষোভকারী রাস্তায় নামে। আন্দোলনের নামে সামশেরগঞ্জে হিংসা ও অগ্নিসংযোগের শুরু হয়। চলে লুটপাট।
সুতি ও সামশেরগঞ্জ, দুই স্থানেই সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হিন্দুদের দোকান ও বাড়ি বেছে বেছে টার্গেট করা হয়। তদন্তে দেখা যাচ্ছে, হিংসার ঘটনায় অল্পবয়সী যুবক এবং নাবালকদের একটি বড় অংশ ছিল। দশ থেকে কুড়ি বছর বয়সীদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন ভিডিও খতিয়ে দেখলেই সেটা স্পষ্ট।
প্রাথমিক তদন্তে আরও জানা গিয়েছে যে, উন্মত্ত হামলাকারীদের বেশিরভাগই ভিনরাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। ইদের ছুটি কাটাতে মুর্শিদাবাদের বাড়িতে এসেছিল।
২০২৬ এর আগে রাষ্ট্রপতি শাসন?
মুর্শিদাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে রাষ্ট্রপতি শাসনের মতো পরিস্থিতি। এমন মত রাজ্যপালের। মমতা জমানায় এই প্রথম এমন কড়া কোনও রিপোর্ট পাঠালেন রাজ্যপাল। তাই প্রশ্ন উঠেছে, বিধানসভা ভোটের আগেই কি রাজ্যে জারি হবে রাষ্ট্রপতি শাসন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ফের এমন পরিস্থিতি যদি তৈরি হয়, তাহলে ব্যবস্থা নিতেই পারে কেন্দ্র।