নিউজ ডেস্ক: পহেলগাঁও-এ জঙ্গি হামলার ঘটনার পর থেকে গত ১১ দিন ধরে একটানা সীমান্তে গুলিবর্ষন করে চলেছে পাকিস্তান। সেই আবহেই এবার দেশের সব রাজ্যকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রের তরফে। আগামী ৭ মে, বুধবার একাধিক রাজ্যে হবে মক ড্রিল। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যে কোনও হামলার পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ যাতে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে, সেই কারণে এই ড্রিল করতে হবে।
রাজ্যে রাজ্যে মক ড্রিল করার নির্দেশ কেন্দ্রের
সরকারি সূত্রের দাবি, রাজস্থান, গুজরাত, পাঞ্জাব এবং জম্মু-কাশ্মীরের সিমান্ত এলাকায় এই মহড়া চালানো হতে পারে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, সব মিলিয়ে দেশের ২৪৪টি জেলায় এই মহড়া চলবে। মহড়া চলবে গ্রামীণ এলাকাতেও। তালিকায় রয়েছে- অন্ধপ্রদেশ, অরুনাচল প্রদেশ, আসাম, বিহার, ছত্রিশগড়, দিল্লি, গোয়া, গুজরাট, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর, ঝাড়খন্ড, কর্ণাটক, কেরালা, মধ্য প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মনিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, রাজস্থান, সিকিম, তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখন্ড পশ্চিমবঙ্গ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক যে যে বিষয়ে মহড়া দিতে বলেছে, তার মধ্যে রয়েছে— বিমান হামলার সতর্কতা সাইরেন ব্যবস্থাকে সক্রিয় করা, নাগরিকদের সুরক্ষার স্বার্থে সাধারণ মানুষ, বিশেষত পড়ুয়াদের ভূমিকা কী হবে, হঠাৎ ব্ল্যাকআউট হলে কী করণীয় এবং জরুরি পরিস্থিতিতে কী ভাবে দ্রুত উদ্ধারকাজ চালানো হবে।
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে কোন কোন জেলায় মক ড্রিল করার নির্দেশ?
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে কুচবিহার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, মালদা, শিলিগুড়ি, দুর্গাপুর, হলদিয়া, খড়গপুর, আসানসোল, বালুরঘাট, আলিপুরদুয়ার, রায়গঞ্জ, ইসলামপুর, দিনহাটা, মাথাভাঙ্গা, কালিম্পং, কার্শিয়াং, কোলাঘাট, বীরভূম, মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি মুর্শিদাবাদ।
গত ২৪ ঘণ্টায় একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক সেরেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সোমবার উচ্চপর্যায়ের একটি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বৈঠকও করছেন প্রধানমন্ত্রী। সান্ধ্যকালীন এই বৈঠকে ছিলেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, স্বরাষ্ট্র সচিব গোবিন্দ মোহন। এছাড়াও এদিন প্রতিরক্ষা সচিবের সঙ্গেও কথা বলেছেন তিনি। আর তারপরই এই মক ড্রিলের নির্দেশ পৌঁছল রাজ্যে রাজ্যে। যে পরিস্থিতিতে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারন, দেশের সব রাজ্যে ‘মক ড্রিল’ হবে , এটা যে কোনও সাধারণ বিষয় নয়। এভাবে দেশের সব রাজ্যে মক ড্রিল করার কথা সচরাচর বলা হয় না কেন্দ্রের তরফে। এর আগে শেষবার এমন মক ড্রিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭১ সালে। অর্থাৎ ঠিক যে বছর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়, সেবার এমন মহড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
কী এই মক ড্রিল?
যুদ্ধের সাইরেন আসলে একটি জোরে শব্দ করার মাধ্যমে সতর্কীকরণ ব্যবস্থা। এটি যুদ্ধ, বিমান হামলা বা দুর্যোগের মতো জরুরি পরিস্থিতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সজাগ করে তোলে। এর শব্দে একটানা অস্বস্তিকর কম্পন থাকে। এই সাইরেনগুলি সাধারণত প্রশাসনিক ভবন, পুলিশ সদর দফতর, ফায়ার স্টেশন, সামরিক ঘাঁটি এবং শহরের জনবহুল এলাকায় উঁচু করে লাগানো হয়। এর উদ্দেশ্য হল সাইরেনের শব্দ যতদূর সম্ভব পৌঁছনো। যুদ্ধের সাইরেনের আওয়াজ খুব জোরে হয়৷ সাধারণত ২-৫ কিলোমিটার পর্যন্তও এই সাইরেন শোনা যেতে পারে৷ সাইরেন বাজানোর অর্থ হল, লোকজনকে অবিলম্বে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে হবে। কিন্তু মক ড্রিলের সময় আতঙ্কিত হবেন না। খোলা জায়গা থেকে দূরে থাকুন। ঘর বা নিরাপদ ভবনের ভেতরে যান। টিভি, রেডিও এবং সরকারি সতর্কতার প্রতি মনোযোগ দিন। গুজব এড়িয়ে চলুন এবং প্রশাসনের নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, মহড়ায় অংশ নেবেন জেলাশাসক-সহ জেলা প্রশাসনের অন্যান্য আধিকারিক, নাগরির সুরক্ষা কর্মী, হোমগার্ডেরা। এ ছাড়াও মহড়ায় অংশ নিতে বলা হয়েছে এনসিসি ক্যাডেট, নেহরু যুব কেন্দ্র সংগঠনের সদস্য এবং স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের।
ঠিক কী কী নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র?
১। দেশের ২৪৪টি জেলায় মক ড্রিল হবে। রাজ্য প্রশাসন বিষয়টি দেখবে। নেহরু যুব কেন্দ্র সংগঠন, এনসিসি অংশ নেবে।
২। এয়ার রেড সাইরেন বাজিয়ে পরীক্ষা করা হবে। সাধারণ মানুষকে সতর্ক করার জন্য বাজবে এই অ্যালার্ম।
৩। স্কুল, অফিস, কমিউনিটি সেন্টারে হবে ওয়ার্কশপ। হামলা হলে, কাছাকাছি আশ্রয়স্থল কীভাবে খুঁজে বের করতে হবে, তা শেখানো হবে। হামলার মুহূর্তে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করা, প্রাথমিক চিকিৎসা করাও শেখানো হবে।
৪। হঠাৎ ব্ল্যাকআউট বা অন্ধকার হয়ে যাবে শহর। নিভে যাবে সব আলো। রাতের অন্ধকারে কোনও এয়ার স্ট্রাইক হলে এই কৌশল নেওয়া হয়। ৭১-এর যুদ্ধের সময় এই কৌশল নেওয়া হয়েছিল।
৫। মিলিটারি বেস, পাওয়ার প্লান্ট বা গুরুত্বপূর্ণ বিল্ডিংগুলি এমনভাবে ঢেকে দেওয়া হবে, যাতে স্যাটেলাইটে ধরা না পড়ে।
৬। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় শেখানো হবে, কীভাবে দ্রুত উদ্ধারকাজ চালাতে হয়, কীভাবে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয় সাধারণ মানুষকে।
যে বিষয়গুলি রাজ্যকে খতিয়ে দেখতেই হবে
১। বিমান হামলার সতর্কতা ব্যবস্থার কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা।
২। ভারতীয় বিমান বাহিনীর সঙ্গে হটলাইন/রেডিও সংযোগের কার্যকারিতা খতিয়ে দেখা।
৩। কন্ট্রোল রুম এবং শ্যাডো কন্ট্রোল রুমের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা।
৪। প্রতিকূল আক্রমণের ক্ষেত্রে নিজেদের রক্ষা করার জন্য সাধারণ নাগরিক, ছাত্রদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত দিক সম্পর্কে প্রশিক্ষণ।
৫। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য ও জায়গাগুলির প্রাথমিকভাবে ছদ্মবেশে রাখা।
৬। ওয়ার্ডেন পরিষেবা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, উদ্ধার অভিযান-সহ সামরিক প্রতিরক্ষা পরিষেবাগুলির সক্রিয়তা এবং কাজ যাচাই করা।
৭। দুর্ঘটনা ব্ল্যাকআউট ব্যবস্থার বাস্তবায়ন মূল্যায়ন করা।
৮। পরিকল্পনা মাফিক নিজেদের সরিয়ে রাখা এবং তা বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি মূল্যায়ন করা।
ফিরোজপুরে মক ড্রিল শুরু
উল্লেখ্য, এখনও পহেলগাঁওয়ের হামলার সঙ্গে যুক্ত জঙ্গিরা ধরা পড়েনি। তার জন্য জম্মু-কাশ্মীরে চলছে চিরুনি তল্লাশি। সেনাবাহিনীর সঙ্গে রয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ। উপত্যকার বিভিন্ন প্রান্তে মক ড্রিল চালাচ্ছে নিরাপত্তাবাহিনী। আর এবার একাধিক রাজ্যকে আগামী ৭ মে বুধবার মক ড্রিল করার নির্দেশ দিল কেন্দ্র। কেন্দ্রের নির্দেশের পরেই ফিরোজপুরে মক ড্রিল শুরু হয়েছে। পাঞ্জাবেও ব্ল্যাক আউটের মক ড্রিল করা হয়েছে। প্রত্যেক রাজ্যকে মক ড্রিল করানোর নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র। এয়ার রেড সাইরেনের জন্য প্রস্তুতির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, রোববার রাত ৯টা নাগাদ পাঞ্জাবের ফিরোজপুর ক্যান্টনমেন্টে সব আলো নিভিয়ে ‘ব্ল্যাকআউট ড্রিল’ করেছে সেনাবাহিনী। স্থানীয় বাসিন্দাদের আগে থেকেই এ নিয়ে সতর্ক করে বলা হয়েছিল, তাঁরা যেন আলোকিত বা দূর থেকে চোখে পড়ে এমন কোনও বস্তু ব্যবহার না করেন ওই সময়টুকু। সাধারণত যুদ্ধের সময় বিপক্ষের নজর এড়াতে বা বিপক্ষের বায়ুসেনাকে বিভ্রান্ত করতে বিস্তীর্ণ এলাকার আলো নিভিয়ে ‘ব্ল্যাকআউট’ করে দেওয়া হয়।
পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হলে কী কী পদক্ষেপ?
১। এয়ার রেড সাইরেন ব্যবস্থাকে অপারেশনাল করার নির্দেশ।
২। আচমকা হামলা হলে কীভাবে আত্মরক্ষা? সাধারণ মানুষ, ছাত্রদের মক ড্রিল।
৩। যেকোনও মুহূর্তে ব্ল্যাক আউটের জন্য প্রস্তত থাকার নির্দেশ।
৪। বিশেষ বিশেষ কারখানা, সংস্থাকে বাঁচাতে ক্যামোফ্লেজের প্রস্তুতি।
৫। হামলা হলে মুহূর্তের মধ্যে এলাকার খালি করতে মক ড্রিলের নির্দেশ।
এয়ার সাইরেন শুনলে কী করা উচিত?
এয়ার সাইরেন আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত দেয়, যেমন বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র। জরুরি পরিস্থিতিতে (যেমন যুদ্ধ বা ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকির সময়) একটি অভ্যন্তরীণ ঘর বেছে নিন যেখানে জানালা নেই, পুরু দেয়াল,ম ভবনের যতটা সম্ভব নিচু (যেমন বেসমেন্ট), আলো বন্ধ করুন, প্রয়োজনে টর্চলাইট ব্যবহার করুন। প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম, গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র সঙ্গে রাখুন। শিশু বা বয়স্ক পরিবারের সদস্যদের শান্ত থাকতে সাহায্য করুন। কর্তৃপক্ষের নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন।
আসলে গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ের বৈসারন উপত্যকায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের। তাঁদের মধ্যে ২৫ জন পর্যটক, একজন স্থানীয় ঘোড়াচালক। পর্যটকদের ধর্ম জেনে, বেছে বেছে হিন্দুদের টার্গেট করে গুলি করে খুন করেছে জঙ্গিরা। এই ঘটনার পর থেকেই ক্রমশ অবনতির দিকেই এগোচ্ছ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। পড়শি দেশের প্রতি যে আর কোনওভাবে নরমপন্থা দেখানো হবে না ইতিমধ্যেই তার একাধিক নিদর্শন দিয়েছে ভারত। আর এরই মধ্যে এবার রাজ্যে রাজ্যে মক ড্রিল করার নির্দেশ দিল কেন্দ্র।