নিউজ ডেস্ক: মুর্শিদাবাদ থেকে ফিরে আসার পরেই কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি রিপোর্ট পাঠান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। ওই রিপোর্টে সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। বস্তুত, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদেই রাষ্ট্রপতি শাসনের কথা বর্ণিত রয়েছে। রাজভবন সূত্রে খবর, শারীরিক সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগেই কেন্দ্রকে ওই রিপোর্ট পাঠিয়ে দেন বোস।
কী হয়েছিল মুর্শিদাবাদে?
সম্প্রতি সংশোধিত ওয়াকফ আইন ঘিরে গত মাসে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু অঞ্চলে। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে অশান্তির আগুন৷ জঙ্গিপুর মহকুমা অশান্ত হয়ে ওঠে৷ ৪ এপ্রিল রঘুনাথগঞ্জে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভকারীরা৷ একাধিক গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়৷ পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটবৃষ্টিও হয়। পরে সুতি থেকে শুরু করে সামসেরগঞ্জে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়৷ অশান্তির জেরে তিনজনের প্রাণও যায় । পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কয়েকটি এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এমত অবস্থায় বিএসএফের সাহায্য নিয়ে রাজ্য পুলিশ শুরুর দিকে সেখানে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছিল। পরে হাই কোর্টের নির্দেশে সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনীও মোতায়েন করা হয়। মুর্শিদাবাদের অশান্তিতে যাঁরা ঘরছাড়া হয়েছিলেন, তাঁদের একাংশকে নিয়ে রাজভবনেও গিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার-সহ অন্যেরা। রাজ্যপালের কাছে তাঁরা পাঁচ দফা দাবি পেশ করেন। সামসেরগঞ্জ এবং ধুলিয়ানে গিয়ে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে আসার জন্যও রাজ্যপালকে অনুরোধ করেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে এপ্রিলের মাঝামাঝি দু’দিনের সফরে (১৮ এবং ১৯ এপ্রিল) মালদহ এবং মুর্শিদাবাদে গিয়েছিলেন বোস। মালদহে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করে তিনি। পরের দিন মুর্শিদাবাদের উপদ্রুত এলাকাও পরিদর্শন করেন। কথা বলেন সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে। এরপর সেখান থেকে ফিরেই কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি রিপোর্ট পাঠান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। ওই রিপোর্টে সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি শাসন কী? কেনই বা ৩৫৬ অনুচ্ছেদ জারি করা হয়?
সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির বিধান রয়েছে। যে কোনও রাজ্যে জারি করা হতে পারে ৩৫৬। সাংবিধানিক ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে ৩৫৬ জারির সুপারিশ করেন রাজ্যপাল। অর্থাৎ কোনও রাজ্যের বিধানসভা সাংবিধানিক ভাবে ব্যর্থ হলে তবেই ৩৫৬ ধারা জারি হয়। এ সময় কার্যনির্বাহী প্রধান হিসেবে প্রশাসন চালাবেন রাজ্যপাল। এর মধ্যে প্রতি ২ মাস অন্তর সংসদের অনুমোদন নিতে হবে। সর্বোচ্চ ৩ বছর রাষ্ট্রপতি শাসন জারি থাকা সম্ভব। তবে, এ ক্ষেত্রে প্রতি ৬ মাস অন্তর সংসদের অনুমোদন নেওয়া প্রয়োজন। ৩৫৬ জারি হওয়ার পর, তা বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির হাতেই। এ জন্য অবশ্য সংসদের সম্মতির প্রয়োজন নেই।
আরও বিস্তারিতভাবে বলা যায়-
সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে: যদি কোনো রাজ্যে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ভেঙে যায়, যেমন, রাজ্য সরকার ভেঙে যায়, বা সরকার গঠন করা সম্ভব না হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি ৩৫৬ অনুচ্ছেদ জারি করতে পারেন।
রাজ্য সরকার সংবিধান মেনে চলতে ব্যর্থ হলে: যদি কোনো রাজ্য সরকার সংবিধানের নিয়মকানুন মেনে চলতে ব্যর্থ হয়, বা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশাবলী পালন না করে, তাহলে রাষ্ট্রপতি ৩৫৬ অনুচ্ছেদ জারি করতে পারেন।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে: যদি কোনো রাজ্যে দাঙ্গা বা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, যা রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রপতি ৩৫৬ অনুচ্ছেদ জারি করতে পারেন।
অর্থনৈতিক সংকট: যদিও ৩৫৬ অনুচ্ছেদের মূল কারণ সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ব্যর্থতা, কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকটও এই ধারা জারির কারণ হতে পারে।
৩৫৬ ধারার ইতিহাস ও বিতর্ক
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ৩৫৬ ধারা ১৩৪ বার প্রয়োগ হয়েছে। যদিও সংবিধান প্রণেতা বি আর আম্বেদকরের মতে, এটি একটি ‘মৃত চিঠি’ হওয়া উচিত ছিল — অর্থাৎ, একান্ত প্রয়োজনে ছাড়া ব্যবহার করা উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবে বহু সময় এই ধারা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলে অভিযোগ।
রাজ্যে জারি হবে ৩৫৬ ধারা?
মুর্শিদাবাদে ওয়াকফ অশান্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে কড়া রিপোর্ট দিয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ করেছেন তিনি। তাঁর মতে, এটা পূর্ব পরিকল্পিত হামলা। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতার উল্লেখ করে রিপোর্ট দিয়েছেন তিনি। রিপোর্টে রাজ্যপাল উল্লেখ করেছেন, ধর্মীয় পরিচয় জেনে রাজনৈতিক হিংসা হয়েছে। রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়লে হস্তক্ষেপ করুক কেন্দ্র, সুপারিশ করেছেন রাজ্যপাল।
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের বক্তব্য
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের বক্তব্য, “রাজ্যপাল যে রিপোর্ট দিয়েছেন, সেটি সম্পূর্ণ ভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি নিজের রাজনৈতিক অ্যাসাইনমেন্টের কারণে রিপোর্টটি দিয়েছেন। তিনি জানেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, সুতরাং অবনতি যদি হয়… এই কথাগুলি এ ক্ষেত্রে আসে না। রাজ্যপাল এটিও জানেন ওই সীমান্তবর্তী এলাকার দায়িত্ব তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের, বিএসএফের। যদি ও পার থেকে হামলাকারীরা ঢুকে উস্কানি দেয় বা অনুপ্রবেশ হয়, তার দায়িত্ব বিএসএফের।” বিএসএফের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা বৃদ্ধির কথা স্মরণ করিয়ে কুণালের দাবি, বিএসএফকে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে, সেটিই উল্লেখ থাকা প্রয়োজন ছিল রাজ্যপালের রিপোর্টে। এই রিপোর্টে বিজেপিকে ‘খুশি করার মতো’ এবং বাংলাকে ‘ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে কলুষিত’ চেষ্টা হয়েছে বলে দাবি তৃণমূল নেতার।
রাষ্ট্রপতি শাসন জারি প্রসঙ্গে মিঠুন
মিঠুন বলেন, “এখন তাঁরা (ক্ষতিগ্রস্ত) রাস্তায় ৷ ত্রাণশিবিরে খিচুড়ি খাচ্ছেন ৷ এটা খুবই দুঃখের ৷ ওঁদের বাড়িঘর হয়তো ছোট কুঠি, কিন্তু সেটাই ওঁদের কাছে মহল ৷ এখন সেখান থেকে তাঁরা ত্রাণশিবিরে গিয়ে সেবার খিচুড়ি খাচ্ছেন ৷ খুব খারাপ অবস্থা ৷ এরকমটাই যদি চলতে থাকে, তাহলে আমি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের কাছে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির আবেদন জানাব ৷”তিনি আরও বলেন, “আর এটা যদি নাও হয়, অন্তত নির্বাচনটা যেন সেনার নিরাপত্তায় হয় ৷ তাহলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হবে ৷ আমরা মারামারি চাই না ৷ আমাদের ভোট করতেই দেওয়া হয়নি ৷”
রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশের বিরোধিতায় সিপিএম–কংগ্রেস
এই নিয়ে মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি শাসনের নামে রাজ্যপালের হাতে ক্ষমতা এলে সমস্যার সমাধান হবে না। আগে এই বিষয়ে কুৎসিত অভিজ্ঞতা রয়েছে রাজ্যবাসীর। রাজ্যকে ভেঙে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলা রোখা যায়নি। এখন দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টাকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মণিপুরে ডবল ইঞ্জিন সরকার চললেও মানুষের জীবন বিপন্ন। রাজ্য সরকারকেই মানুষের সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। রাষ্ট্রপতি শাসন কোনও সমাধান নয়।’
অন্যদিকে, এই প্রসঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারের বক্তব্য, ‘রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস রাষ্ট্রপতি শাসন জারির জন্য যে সুপারিশ করেছেন সেটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সরাসরি আঘাত। এটি একদিকে সংবিধানসম্মত নয়। অপরদিকে এটি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ। যা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির পরিপন্থী। নির্বাচিত রাজ্য সরকারের আইন প্রণয়ন এবং শাসনব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেওয়ার জন্য অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে জরুরি শাসন জারির চেষ্টার নিন্দা করছি।’
এর আগে কোথায় কোথায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছে?
পাঞ্জাব
২০ জুন ১৯৫১ সালে পাঞ্জাবে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গ
১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত রাজ্যে মোট চারটি জোট সরকার গঠিত হয় এবং মোট তিনবার সীমিত সময়ের জন্য রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়।
মহারাষ্ট্র
এর আগে, মহারাষ্ট্রেই তিন বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছিল। ১৯৮০-র ১৭ ফেব্রুয়ারি ১১২ দিনের জন্য রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়, তা চলে ওই বছরের ৮ জুন পর্যন্ত। ফের সেই ছবি দেখা যায় ২০১৪-র ২৮ সেপ্টেম্বর। এ দফায় রাষ্ট্রপতি শাসনের মেয়াদ ছিল ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। আর সব শেষে ২০১৯ সালের নভেম্বরেও রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছিল মহারাষ্ট্রে।
মণিপুর
ফেব্রুয়ারি মাসেই মণিপুরে জারি করা হয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসন। সে সময় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে বিবৃতি জারি করে বলা হয়, মণিপুরের রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতিকে একটি রিপোর্ট দেয়। সেই রিপোর্ট দেখে বোঝা যায়, রাজ্যে এই মুহূর্তে সাংবিধানিক শাসন চালানোর অবস্থা নেই। তাই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫৬-র আওতায় প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হল।
জম্মু-কাশ্মীর
২০১৮ সালের ১৯ জুন রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয় উপত্যকায়। এই সময় জম্মু ও কাশ্মীরে পিডিপি-নেতৃত্বাধীন সরকার ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এবং রাজ্যপালের শাসন কার্যকর করা হয়েছিল।