নিউজ ডেস্ক: আজ ২৫শে বৈশাখ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাধক, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মবার্ষিকী। রবীন্দ্রনাথ শুধু কবিই ছিলেন না, ছিলেন গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক। তার অসংখ্য কবিতা, গান, নাটক, গল্প ও প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে এক নতুন রূপ ও গভীরতা। বাঙালির কাছে তিনি কেবল কবি গুরু নন, ‘চিরসখা’ও বটে। হাসি হোক বা কান্না, রাগ হোক বা দুঃখ প্রতিনিয়ত সব আবেগে তাঁর সৃষ্টি আমাদের চলার পথের সঙ্গী।
কবিতা, গান, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ, শিশুতোষ, পত্র, নাটকসহ সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তাঁর অজস্র রচনা বাংলা সাহিত্যকে করেছে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। রচনাকর্ম ছাড়াও তাঁর চিত্রকলা নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে উপমহাদেশের চারুকলা চর্চায়। কালজয়ী তাঁর এসব সৃজনসম্ভার যুগে যুগে মানুষের মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে, অন্যায়ের প্রতিবাদে, দেশপ্রেমে, সত্য ও কল্যাণের পথে নির্ভীক-নিঃশঙ্ক চিত্তে এগিয়ে যেতে প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল আমাদের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবল তাঁর সৃজনকর্মে অনুপ্রেরণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি। নিজেও অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ শাসকদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তাদের দেওয়া নাইটহুড উপাধি বর্জন করেছিলেন, যা ছিল সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে অকল্পনীয়। এসব কারণে তিনি গণমানুষের কাছে প্রিয় ও চির নূতন হয়ে আছেন। আজ তাঁর জন্মবার্ষিকীতে জেনে নেব তাঁর জীবনের কিছু অজানা ইতিহাস।
রবীন্দ্রনাথের বংশের আসল পদবী কী জানেন?
১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ (ইংরেজির ১৮৬১ সালের ৭ মে) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ। তবে রবীন্দ্রনাথ যে ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের প্রকৃত পদবী আসলে ‘ঠাকুর’ ছিল না। এবার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন আসবে, তাহলে কী ছিল ঠাকুর বংশের আসল পদবী? ঠাকুর বংশের আসল পদবী হল ‘কুশারি’।
কুশারি থেকে কীভাবে ঠাকুর হয়ে উঠলেন তাঁরা?
এর উত্তর পেতে হলে আমাদের ফিরতে হবে বহু বছর আগে। প্রায় দেড় শতকের ধর্মীয় গঞ্জনা, অপমান সহ্য করে, বছরের পর বছর দরিদ্র মানুষের সেবা নিয়োজিত থেকে কুশারী বংশধরেরা, হয়ে ওঠেন ঠাকুর। শোনা যায়, এক বিশেষ মাংসের গন্ধ শোঁকার অপরাধে সমাজে কলঙ্কিত হতে হয় সুন্দরবন অঞ্চলের চার ব্রাহ্মণ জমিদার ভাই রতিদেব কুশারি, কামদেব কুশারি, শুকদেব কুশারি, জয়দেব কুশারি। এঁদেরই পরবর্তী বংশধর হলেন জগন্নাথ কুশারী। তাঁর বংশধর রামানন্দের মহেশ্বর আর শুকদেব নামে দুই ছেলে ছিল। তাঁরা গোবিন্দপুরে দরিদ্রদের সেবা করা থেকে শুরু করে প্রচুর দান-ধ্যান করে সেখানকার মানুষের মনে জায়গা করে নেন। তাঁরা হয়ে ওঠেন দরিদ্রের ভগবান বা ‘ঠাকুর’। এইভাবেই তাঁরা ‘কুশারী’ পদবীর ত্যাগ করে গোবিন্দপুরে এসে ওখানকার মানুষদের ভালোবেসে দেওয়া নাম ঠাকুর-কেই নিজেদের পদবী হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। প্রথমে অবশ্য শুকদেব ঠাকুর পদবী ব্যবহার করতেন। পরে তাঁর ভাই মহেশ্বরের ছেলে পঞ্চাননও কাকা শুকদেবকে অনুসরণ করে ‘ঠাকুর’ পদবী ব্যবহার করতে শুরু করেন।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস
পরে এই বংশেরই এক বংশধর নীলমণি তৎকালীন সময়ের জোড়াবাগান অঞ্চলের বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী বৈষ্ণবচরণ শেঠের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। বৈষ্ণবচরণ শেঠ নীলমণিকে বর্তমানের জোড়াসাঁকোয় দেড় বিঘা জমি বন্ধুত্বের উপহার হিসেবে দেন। তিনি চান যাতে তাঁর পরম মিত্র সেখানেই বাড়ি করে থাকেন। আর এর পর সেখানেই গড়ে ওঠে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি।
২৫ বৈশাখ নয়, ১লা বৈশাখ শান্তিনিকেতনে পালিত হত রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন
২৫ বৈশাখ জন্ম হয় রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেখানে বহু বছর তাঁর জন্মদিন পালন হয়েছে। ৮১ বছরের জীবদ্দশায় কলকাতার পাশাপাশি শান্তিনিকেতনও তাঁর জন্মোৎসব ঘিরে মেতে উঠত। কিন্তু ২৫ বৈশাখ নয়। শান্তিনিকেতনে একটা সময় কবির জন্মদিবস পালিত হত পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ শুরুর দিনেই কবির জন্মদিবস পালনের বিশেষ রীতি ছিল শান্তিনিকেতনে।
কীভাবে সেই রীতির শুরু?
১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রহ্ম বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শুরু হয়। তারপর থেকেই শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ থাকতেন বছরের নানা সময়। তখন থেকেই ২৫ বৈশাখে কবির জন্মোৎসব পালন করা হত শান্তিনিকেতনে। কিন্তু শান্তিনিকেতন মানেই লাল মাটির দেশ। ফেব্রুয়ারি শেষ হলেই মার্চের শুরু থেকে সেখানে গরম পড়তে শুরু করে। গোটা চৈত্র মাস জুড়ে কাঠফাটা গরম থাকে। স্বাভাবিকভাবে কবির জন্মমাস অর্থাৎ বৈশাখ বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে মে মাসে অসহ্য গরম পড়ত শান্তিনিকেতনে। ওই গরমের মধ্যে জন্মোৎসব পালন করা রীতিমতো কষ্টকর ছিল আশ্রমিকদের কাছে। এই সময় বিকল্প হিসেবেই কবির জন্মদিবস বর্ষবরণের দিন পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, এই ব্যাপারে পূর্ণ সম্মতি ছিল কবিগুরুর।
তবে পয়লা বৈশাখে জন্মদিবস পালন অবশ্য শুরু হয়েছিল কবির শেষ বয়সে। ১৯৩৬ সাল। বাংলা সন ১৩৪২। কবির বয়স তখন ৭৬ বছর। সেই বছর প্রথম পয়লা বৈশাখে শান্তিনিকেতনে পালিত হল রবীন্দ্র জন্মোৎসব। তার পর থেকে প্রতি বছর কবির মৃত্যু পর্যন্ত পয়লা বৈশাখেই পালিত হয়েছিল তাঁর জন্মোৎসব। কবির শেষ জন্মদিন অর্থাৎ ৮০ তম জন্মদিনও ওই রীতি মেনেই পালিত হয়েছিল শান্তিনিকেতনে।
গান রচনার জন্য বাবার কাছে পুরস্কৃত
কবির বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোট থেকেই তাঁকে সঙ্গীত শিক্ষা ও গান রচনার ক্ষেত্রে উৎসাহ দিতেন। দেবেন্দ্রনাথ বলতেন, ‘রবি আমাদের বাংলাদেশের বুলবুল’। একবার মাঘোৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ কতগুলি গান রচনা করেছিলেন। খবর পেয়ে ছেলেকে ডেকে সবক’টি গান শুনলেন দেবেন্দ্রনাথ। তারমধ্যে ‘রয়েছ নয়নে নয়নে’ গানটি শুনে ছেলের হাতে ৫০০ টাকার চেক পুরস্কার হিসেবে তুলে দেন তিনি।
কবি গুরুর বিবিধ ছদ্মনাম
বেশিরভাগ মানুষই জানেন রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি ছদ্মনাম রয়েছে। ভানুসিংহ, আন্নকালী পাকড়াশী, অকপটচন্দ্র লস্কর, দিকশূন্য ভট্টাচার্য এবং ষষ্ঠীচরণ দেব শর্মা। কিন্তু এছাড়াও রবি ঠাকুর অনেকগুলি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন যা অনেকেরই অজানা। যেমন নবীন কিশোর শর্মণ, বাণীবিনোদ বিদ্যাবিনোদ, শ্রীমতী কনিষ্ঠা, শ্রীমতী মধ্যমা। চিনের সরকার তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘চু চেন তান’।
নোবেল জয়ের খবর পেয়ে কী বলেছিলেন?
১৯১৩ সালের ঘটনা। পাঠভবনের শিশুদের আম্রকুঞ্জে গাছের তলায় ইংরাজি পড়াচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেইসময় ক্ষিতিমোহন সেন এসে জানান,বিদেশ থেকে খবর এসেছে। নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। খবর শুনে প্রথমেই তিনি বলেন, বিশ্বভারতীর ড্রেন কাটার সংস্থান হবে ওই টাকা থেকে। কারন বিশ্বভারতীর আর্থিক দায়িত্ব ছিল প্রায় সমস্তটাই রবীন্দ্রনাথের।
নোবেলের টাকায় জনহিতকর কাজ
১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বভারতীর পাশাপাশি এই নোবেল পুরস্কারে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃষকদের জন্য একটি ব্যাঙ্ক তৈরি করেন। বাড়ির সংলগ্ন এলাকায় সেতু, রাস্তা ইত্যাদি মেরামতের জন্যও তিনি নোবেলের টাকা দান করেছিলেন।