নিউজ ডেস্ক: পাক অধিকৃত কাশ্মীর (POK) দখলের বর্তমান সময়কে “সেরা সময়” বলা হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে—POK কীভাবে দখল হয়েছিল, সেখানে কীভাবে সন্ত্রাসবাদ পরিচালিত হয়, এবং বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি কতটা অনুকূল।পহেলগাঁও হামলার পর সন্ত্রাসবাদকে গোড়া থেকে খতম করার পণ নিয়েছে ভারত। ভারতীয় নারীদের সিঁদুর যেভাবে চোখের সামনে মুছে দেওয়া হয়েছে, তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করা হয়েছে অপরেশন সিঁদুর। সিঁদুর দিয়েই সিঁদুরের প্রতিশোধ নিতে একাগ্র ১৪০ কোটি ভারতবাসী। একদিকে সারা দেশ যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এককাট্টা, তখন সামরিক দিক দিয়েও এক অন্য ভারত। তিন বাহিনীই বাঁধা এক সুরে। পাকিস্তানকে হাতের তালুর মতো চেনা, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নজর রাখছেন সবদিকে। ব্রিফিং করছেন প্রধানমন্ত্রীকে। সবকিছু তালমিল রাখতে প্রতিদিন বৈঠকে বসছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও তিন সেনাপ্রধান। সবকিছু চলছে তালে তাল মিলিয়ে।
POK কীভাবে পাকিস্তানের দখলে যায় (১৯৪৭-৪৮)
১৯৪৭ সালের অক্টোবর। মাত্র দু মাস কেটেছে স্বাধীনতার। তখন থেকেই সূত্রপাত কাশ্মীর বিবাদের। কাশ্মীরের তৎকালীন মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নেন।এর আগে, পাকিস্তান-সমর্থিত উপজাতি মিলিশিয়ারা কাশ্মীর আক্রমণ করে।ভারত সেনা পাঠিয়ে বড় অংশ পুনর্দখল করলেও, পাকিস্তান এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড দখলে রাখে – সেটিই আজকের POK। ১৯৪৯ সালে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় এবং একটি অস্ত্রবিরতি রেখা নির্ধারিত হয় যা আজ এলওসি বা লাইন অব কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখা নামে পরিচিত।
POK থেকে ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস
লাইনের এপার আর ওপার। এই সীমানাই মাথা ব্যথার কারণ হয় ভারতের। কারণ জন্মলগ্ন থেকেই এখান থেকে ভারতের ওপর অস্থিরতা ছড়াতে ব্যগ্র থাকে পাকিস্তান। কীভাবে কাশ্মীরে অস্থিরতা ছড়ানো যায়, সেদিকে তাকিয়েই সময় কেটে যায় তাদের। ষাটের দশক ও সত্তর দশকের প্রথমে বারবার হামলা চালায় তারা। ৭১-এর যুদ্ধে সমুচিত শিক্ষা পায় তারা। হাতের বাইরে চলে যায় পূর্ব পাকিস্তান। তৈরি হয় বাংলাদেশ। সেসময় থেকেই ভারতের বিরুদ্ধে প্রক্সি ওয়ার শুরু করে ইসলামাবাদ। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শুরু হয় জঙ্গিদের। তোলা হয় ভারত বিরোধী স্লোগান। আটের দশকে কাশ্মীরকে অস্থির করে তুলতে এদিক থেকে নিয়ে যাওয়া হয় অনেক যুবককে। তাদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারতে পাঠানো হয়। শুরু হয় জেহাদ। ভারতে থেকেই ভারত বিরোধী সন্ত্রাস ছড়াতে থাকে ইয়াসিন মালিকের মতো অনেকে। তৈরি হয় জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট বা জেকেএলএফ।কাশ্মীরে সমান্তরাল ভাবে চলতে থাকে তাদের রাজ। এভাবেই ১৯৯১ সালে হয় কারগিল যুদ্ধ। ভেড়া পালকদের বেশ ধরে ওপার থেকে কারগিলে ঢুকে পড়ে জঙ্গিরা। তাদের মদত দেয় পাক সেনাবাহিনী। শুরু হয় যুদ্ধ। ভারতের বীর যোদ্ধারা প্রতিকূল পরিবেশেও অসাধারণ লড়াই করে। হার মানতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। তবে জারি থাকে অশান্তি।
জঙ্গি আস্তানা পিওকে-তে
জইশ-ই-মহম্মদ, লস্কর-ই-তৈবা-র মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির ঘাঁটি POK-এর মধ্যে অবস্থিত। মুজাফফরাবাদ, কোহালা, নীলাম ভ্যালি এলাকায় ঘাঁটি তৈরি করে চলে ভারত বিরোধী জঙ্গি তৈরির কাজ। এখান থেকেই তারা ভারতের কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করে। এভাবেই ২০০১ সালে সংসদে হামলা হয়, ২০০৮ সালে হয় মুম্বই হামলা, ২০১৬ সালে উরিতে হামলা। পাকিস্তানে বসে লস্কর ও জৈশ নেতারা এখান থেকে তাদের মনস্কামনা পূরণ করে। বছরের পর বছর তৈরি হতে থাকে ভারত বিদ্বেষী জঙ্গিরা। অল্পবয়সে চলে মগজধোলাই। মসজিদের আড়ালে বা মাদ্রাসায় শিক্ষার নামে চলে সন্ত্রাসবাদ তৈরির কাজ। জঙ্গি হানায় মারা যায় কত নিরীহ প্রাণ। কিন্তু কিছুতেই থামানো যায় না সন্ত্রাসবাদীদের। পাক মদতে ও অর্থ সাহায্য নিয়ে পাক সেনার সমান্তরাল ভাবে কাজ চালাতে থাকে তারা। এদের নেপথ্যে কাজ করে যায় পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই।
বর্তমানে দখলের জন্য “সেরা সময়” কেন বলা হচ্ছে?
এর প্রধান কারণ, ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নত মানের এখন। সবদিক দিয়ে তা অনেক শক্তিশালী। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া অটুট। অন্যদিকে পাক সেনাবাহিনীর মধ্যেই শুরু হয়েছে খেয়োখেয়ি। একদমই তালমিল নেই তাদের মধ্যে। পাকিস্তান এর মধ্যে যে হামলা চালিয়েছে, তা সহজেই নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে ভারত। ভারত বুঝতে পারছে, কোন পথে এগোলে পাকিস্তানের হাত থেকে পিওকে ছিনিয়ে নেওয়া যায়। সেখানকার সাধারণ মানুষও আর পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চাইছে না। কারণ, তারা বুঝতে পারছে, তাদের ঢাল করে খেলা চালাচ্ছে ইসলামাবাদ। আর্থিক পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হচ্ছে না তাদের, শুথু ভারত বিরোধীতার নামে ফায়দা লুঠতে চাইছে পাক নেতারা। সামনে বোরের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের। ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খাপ্পা হয়ে আছে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের সাধারণ বাসিন্দারা।
এছাড়া রাশিয়া, আমেরিকা, ইজরায়েল সহ বিদেশ থেকে যেসব অস্ত্র ভারত আমদানি করেছে, তা প্রকৃতই বিশ্বমানের। যে কোনও আঘাত রুখতে সক্ষম এগুলি। বালাকোট ও গালওয়ান পরবর্তী সেই সেনাবাহিনী আগের চেয়েও এখন আক্রমণাত্ম হয়ে উঠেছে। মনোভাবে ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে তারা আগের চেয়ে আলাদা জায়গায়।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং আইএমএফের কঠিন শর্তে নাভিশ্বাস উঠেছে ইসলামাবাদের।
আন্তর্জাতিক সহানুভূতি, সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ে ভারতের অবস্থান এখন অনেক বেশি বৈধতা পেয়েছে। আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে।
অভ্যন্তরীণ ঐক্য, ভারতের জাতীয়তাবাদী আবহ, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণ সুসংহত হয়েছে।
সময়োপযোগী হয়েছে প্রতিরক্ষা নীতি। ” Start Doctrine”, Surgical & Balakot Strike-এর সফল বাস্তবায়ন দেখিয়েছে যে ভারত দ্রুত হামলা ও আংশিক যুদ্ধ পরিচালনায় সক্ষম।
POK পুনরুদ্ধারের সম্ভাব্য উপায়
সামরিক অভিযান: সীমিত লক্ষ্যভিত্তিক হামলা (Targeted Ground Offensive), যেমন ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছিল।
জনমত ও কূটনৈতিক চাপ: আন্তর্জাতিক মঞ্চে POK-কে অবৈধ দখল বলে তুলে ধরা, উদ্বাস্তু প্রশ্ন তুলে পাকিস্তানের ওপর চাপ।
স্থানীয় বিদ্রোহকে কাজে লাগানো : POK-এ অসন্তুষ্ট জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ক্ষোভ রয়েছে।
প্রতিরক্ষা চুক্তি ও সাইবার স্ট্র্যাটেজি: পাকিস্তানের ইন্টারনাল সিস্টেম দুর্বল করে মোক্ষম আঘাত।
কেন এই যুদ্ধকালীন আবহ “সঠিক সময়”:
পাকিস্তান এখন সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে দুর্বলতম অবস্থানে। অন্যদিকে ভারতের সেনা ও সরকার উভয়ই প্রস্তুত ও আত্মবিশ্বাসী। LOAC বা সীমান্তে সংঘর্ষ এখন কৌশলগত দিক থেকে ভারতকে সুবিধা দিচ্ছে—উল্টোভাবে নয়। জনমতও বর্তমানে সরকার ও সেনার প্রতি সহানুভূতিশীল, ফলে রাজনৈতিক বাধাও কম। আন্তর্জাতিক দুনিয়াও ভারতের ওপর কোনও চাপ সৃষ্টি করছে না। বরং তারা সন্ত্রাসবাদ নির্মুলের প্রশ্নে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে কোণঠাসা হয়ে গেছে পাকিস্তান। একটা কৌশলগত সুযোগ এসেছে ভারতের কাছে। ৭৫ বছর পর তাই কাশ্মীরকে জোড়া লাগিয়ে ভারতের জমি ফিরিয়ে নেওয়ার এক অব্যর্থ সময় এসে গেছে দিল্লির কাছে।