নিউজ ডেস্ক: অপারেশন সিঁদুর। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার জবাব দিতে গিয়ে সিঁদুরের বদলে সিঁদুরকেই বেছে নিয়েছিল ভারত। আর এই প্রথম পাকিস্তানের মাটিতে ঢুকে প্রত্যাঘাত করল ভারতীয় সেনা। গুঁড়িয়ে দেওয়া হল ৯টি জঙ্গি শিবির। এখানেই নতুন ভারতের জন্ম। সারা বিশ্বের কাছে নতুন বার্তা। রেয়াত করা হবে না সন্ত্রাসবাদকে। মুখে নয়, কাজে করে দেখাবে ভারত। খোদ প্রধানমন্ত্রীই জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলে দিয়েছেন, অপারেশন সিঁদুরে বিরতি আছে। বেগতিক কিছু দেখলেই যোগ্য জবাব দেওয়া হবে।
এই প্রথম ভারত শতাধিক জঙ্গিকে একসঙ্গে মেরেছে। ধ্বংস করা হয়েছে একের পর এক জঙ্গি শিবির। যেখানে বসে ছিল কান্দাহার বিমান অপহরণ কাণ্ডের মূল কুশিলবরা। যেখান থেকে রাজ করছিল পুলওয়ামা হামলার চক্রান্তকারীরা। যেখানে বসে প্লট সাজানো হয়েছিল মুম্বই হামলার।
কিন্তু ৭ মে ভোর রাতে যে জঙ্গি কারখানা মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ঠিক কী কী কারবার চলতো সেখানে? চলুন দেখে নেওয়া যাক প্রতিটি জঙ্গি শিবির ধরে ধরে।
১. মারকাজ সুবহান আল্লাহ, বাহাওয়ালপুর
২০১৫ সাল থেকে এখানে ঘাঁটি গাড়ে জৈশ এ মহম্মদ। জৈশের মতাদর্শ প্রচারের মূল কেন্দ্রও হয়ে দাঁড়ায় এই বাহাওয়ালপুর কেন্দ্র। তৈরি হয় JeM-এর কার্যকরী সদর দফতর। এখানে বসেই ২০১৯ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় হামলার ষড়যন্ত্র হয়। এই মারকাজেই থাকতো JeM প্রধান মাওলানা মাসুদ আজহার, JeM-এর কার্যকরী প্রধান মুফতি আব্দুর রউফ আসগর, মাওলানা আম্মার এবং মাসুদ আজহারের অন্যান্য পরিবারের সদস্যরা। মাসুদ আজহার এখান থেকে বহুবার ভারতবিরোধী ভাষণ দিয়েছে। যুবকদের ইসলামিক জিহাদে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এই মারকাজ থেকেই JeM নিয়মিত অস্ত্র, শারীরিক ও ধর্মীয় প্রশিক্ষণ পরিচালনা করত।
২. মারকাজ তৈবা, মুরিদকে
২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত, এই মারকাজ লস্কর-ই-তৈবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং একে LeT-এর ‘আলমা মেটার’ বলা হয়। এটি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শেখুপুরা জেলার মুরিদকে শহরের নাঙ্গল সাহদান এলাকায় অবস্থিত। এখানে অস্ত্র ও শারীরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দাওয়াহ ও উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রচার করা হতো। এটা ছিল একপ্রকার জঙ্গি তৈরির কারখান। এই মারকাজ প্রতি বছর প্রায় ১০০০ জন ছাত্রকে বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি করে। ওসামা বিন লাদেন এই মারকাজে একটি মসজিদ ও গেস্ট হাউস নির্মাণের জন্য ১ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিল। পাকিস্তানের আইএসআই-এর নির্দেশে ২৬/১১ মুম্বাই হামলার পরিকল্পনাকারীরা, যেমন আজমল কাসভ এখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। ডেভিড হ্যাডলি থেকে তাহাউর রানার মতো সন্ত্রাসবাদীরাও এখানে নিয়মিত যাতায়াত করত।
৩. সারজাল, তাহরা কালান
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের নারোয়াল জেলার শাকরগড়্ তহসিলের সারজাল এলাকায় অবস্থিত এই জৈশ-ই-মোহাম্মদ (JeM) ঘাঁটি ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে জঙ্গি অনুপ্রবেশের প্রধান কেন্দ্র। এটি একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু এর আড়ালেই চলে যাবতীয় জঙ্গি কার্যকলাপ। আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে মাত্র ৬ কিমি দূরে এটি অবস্থিত। কৌশলগত ভাবে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কেন্দ্র থেকে সীমান্তের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে অনুপ্রবেশ করে জঙ্গিরা। চলে অস্ত্র পাচার। ড্রোনের মাধ্যমেও ভারতের মধ্যে ঢোকানো হয় অস্ত্র ও মাদক। জৈশ জঙ্গিরা যেমন মোহাম্মদ আদনান আলি ও কাশিফ জান এখানে নিয়মিত যায় এবং JeM-এর কার্যকরী প্রধান মুফতি আব্দুর রউফ আসগর পুরোটা দেখভাল করে।
৪. মাহমুনা জোয়া, সিয়ালকোট
এই হিজবুল মুজাহিদিন (HM) সন্ত্রাসী ঘাঁটি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সিয়ালকোট জেলার হেড মারালা এলাকার ভুট্টা কোটলি সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভেতর অবস্থিত। এটি জম্মু অঞ্চলে HM জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ও অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এখানে মোহাম্মদ ইরফান খান ওরফে ইরফান টাণ্ডা কমান্ডার হিসেবে যুক্ত আছে। সে জম্মু শহর সহ নানা অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে যুক্ত। সাধারণত ২০-২৫ জন জঙ্গি এখানে থাকে এবং ভারতের ভেতর অনুপ্রবেশ ও হামলার পরিকল্পনা করে।
৫. মারকাজ আহলে হাদিস, বারনালা, ভিম্বার
পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের (PoJK) বারনালা শহরের উপকণ্ঠে কোটে জামেল রোডে অবস্থিত এই মারকাজ লস্কর-ই-তৈবার (LeT) একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। এটি পুঞ্চ-রাজৌরি-রিয়াসি সেক্টরে জঙ্গি ও অস্ত্র অনুপ্রবেশের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি লস্করের জঙ্গিদের ভারতে অনুপ্রবেশের আগে ‘স্টেজিং সেন্টার’ হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। এখানে ১০০ থেকে ১৫০ জঙ্গি থাকতে পারে। কাসিম গুজ্জর, কাসিম খানদা ও আনাস জারার এই মারকাজে কাজ করে এবং বাস করে। LeT ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলির (Jamaat-ud-Dawa, JK United Movement) কার্যক্রম পরিচালনা ও তদারকি এখানে করা হতো।
৬. মারকাজ আব্বাস, কোটলি
জৈশ-ই-মোহাম্মদের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের কোটলি জেলায় অবস্থিত। এর প্রধান হাফিজ আব্দুল শাকুর ওরফে ক্বারি জাররার, যে JeM কাউন্সিলের ‘শুরা’ সদস্য ও শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুর রউফ আসগরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এই আব্দুল শাকুর। ভারতের NIA-এর মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকাতেও রয়েছে সে। এই মারকাজে ১০০-১২৫ জন JeM জঙ্গি থাকতে পারে এবং এখান থেকেই পুঞ্চ-রাজৌরি সেক্টরের অনুপ্রবেশ পরিচালিত হতো।
৭. মাসকার রাহিল শহিদ, কোটলি
এই HM ঘাঁটি কোটলি জেলায় অবস্থিত এবং এটি হিজবুল মুজাহিদিনের প্রাচীনতম সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলোর একটি। এখানে ১৫০-২০০ জন সন্ত্রাসবাদী একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নিতে পারে। এখানে অস্ত্রচালনা, শারীরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি BAT (Border Action Team), স্নাইপিং, পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধ ও বেঁচে থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
৮. শাওয়াই নাল্লা ক্যাম্প, মুজাফফরাবাদ
এটি লস্কর-ই-তৈবার একটি প্রধান ঘাঁটি এবং Bait-ul-Mujahideen নামেও পরিচিত। এটি মুজাফফরাবাদ-নীলম রোডে চেলাবান্দি ব্রিজের কাছে অবস্থিত। আজমল কাসভ সহ ২৬/১১ মুম্বাই হামলার জঙ্গিরা এখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। এটি LeT সদস্যদের নিয়োগ, নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্র। এখানেই তাদের ধর্মীয় শিক্ষা ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এখানে একসঙ্গে ২০০-২৫০ জন প্রশিক্ষণ নিতে পারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষকরা এখানে অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ দিত।
৯. মারকাজ সাইয়্যেদনা বিলাল, মুজাফফরাবাদ
পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে মুজাফফরাবাদের ‘রেড ফোর্ট’-এর বিপরীতে অবস্থিত এই JeM ঘাঁটি ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যেখান থেকে JeM জঙ্গিদের ভারতে পাঠানো হতো। এখানে একসঙ্গে ৫০-১০০ জন JeM সন্ত্রাসী থাকতো। এখানকার প্রধান ছিল মফতি আসগর খান কাশ্মীরি, যে পাক অধিকৃত কাশ্মীর বা PoJK-তে JeM-এর প্রধান। ভারতীয় পলাতক আশিক নেংরু ও আব্দুল্লাহ জেহাদি এই ঘাঁটি থেকে কাজ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর SSG কমান্ডোরা এখানে JeM সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ দিত।
এই তালিকা দেখলেই বোঝা যায়, ভারতীয় সেনারা কীভাবে সন্ত্রাসবাদীদের আঁতুরঘর গুলি একে একে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। পহেলগাঁও হামলার জবাব দিতে বেছে বেছে স্থির নিশানায় আঘাত হেনেছেন জওয়ানরা। মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে ৯টি জঙ্গি শিবির। কোনও সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয়নি, এতটাই নিখুঁত ছিল এই প্রত্যাঘাত। ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে তার শ্রেষ্ঠত্ব। আর এটাকেই নিউ নরম্যাল বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।