নিউজ ডেস্ক: গত ২২ এপ্রিল সন্ত্রাসবাদীদের নাশকতার সম্মুখীন হয় কাশ্মীরে ঘুরতে যাওয়া বেশ কিছু পর্যটক। পহেলগাঁওয়ে ঘুরতে আসা পর্যটকের উপর হামলা চালায় এক জঙ্গি গোষ্ঠী। ঐদিন দুপুর আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা ২ থেকে ৩ জন সন্ত্রাসী বৈসরণ এলাকায় এসে ঘোড়ায় চড়ে আসা পর্যটকদের উপর গুলি চালায়। মুহূর্তে শেষ হয়ে যায় ২৬ জনের প্রান। আর এখান থেকেই সূত্রপাত পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার। যার ফল স্বরূপ আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের ও সবশেষে অপরেশন সিঁদুরের।
ফিরে দেখা পহেলগাঁও জঙ্গি হামলা
২২ এপ্রিল: জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে হামলা, বৈসরন উপত্যকায় জঙ্গিদের গুলিতে ঝাঁজরা হয় ২৬ নিরীহ ভারতীয়।
২৩ এপ্রিল: হামলায় পাক মদতপুষ্ট লস্করের যোগ, রাতারাতি পাকিস্তানের উপর কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়ে তোলে ভারত।
২৩ এপ্রিল:বন্ধ করা হয় সীমান্ত, ঐতিহাসিক সিন্ধু জলচুক্তি বাতিল ভারতের, পালটা সীমান্তে শান্তি বজায় রাখার হাতিয়ার শিমলা চুক্তি বাতিল পাকিস্তানের।
২৪ এপ্রিল: ভারত-পাক দু’দেশেই ভিসা বাতিল, ভারতের জন্য আকাশপথ বন্ধ পাকিস্তানের।
২৫ এপ্রিল: সীমান্তে সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন করে পাক সেনার গুলিবর্ষণ, পালটা জবাব দেয় ভারতীয় সেনা। এরপর টানা ১২ দিন এভাবে সীমান্তে উসকানি দেয় পাক সেনারা, তবে প্রতিবারই সব আঘাত প্রতিহত করে ভারতের সেনারা।
বারংবার হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা
তবে এটাই প্রথম বার নয়, গত ২৫ বছরে বারবার রক্তাক্ত হয়েছে ভূস্বর্গ, আর বারবার জঙ্গিদের লক্ষ্য হয়েছেন হিন্দুরা। একের পর এক হামলায় কার্যত হত্যাপুরীতে পরিণত হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর। ২০০০ সাল থেকে ঠিক কতবার জঙ্গিহানায় কেঁপে উঠেছিল নৈসর্গিক এই রাজ্য?
২০০০ সালের ২১ মার্চ
অনন্তনাগের ছত্তিসিংপোড়া গ্রামে ঢুকে পড়ে জঙ্গিরা। হামলা চালানো হয় সংখ্যালঘু শিখদের উপর। মারা যান ৩৬ জন মানুষ।
ওই বছরের অগাস্টে নুনওয়ান বেসক্যাম্পের কাছেও হামলা হয়। ঘটনায় ২৪ জন অমরনাথ তীর্থযাত্রী সহ মোট ৩২ জন মারা যান।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর
আত্মঘাতী জঙ্গির গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ কেঁপে ওঠে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা চত্বর। এই ঘটনায় মারা যান মোট ৩৬ জন।
২০০৩ সালের ২৩ মার্চ
পুলওয়ামা জেলার নন্দীমার্গে জঙ্গিদের হাতে নিহত হন ২৪ জন কাশ্মীরি পণ্ডিত। যাদের মধ্যে ১১ জন নারী ও ২ জন শিশু ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের উপত্যকা ছাড়ার প্রক্রিয়াকে আরও গতি দেয়।
২০০৫ সালের ১৩ জুন
ঘটনাস্থল সেই পুলওয়ামা। সরকারি এক স্কুলের সামনে বিস্ফোরক বোঝাই ভর্তি গাড়িতে বিস্ফোরণ হয়। ১৩ জন সাধারণ মানুষ, ২ স্কুল পড়ুয়া এবং তিনজন নিরাপত্তারক্ষী মারা যান। আহত হন ১০০।
২০০৬ সালের ২৬ মে
শ্রীনগরের উপকণ্ঠে জাকুরার বাটাপোরা এলাকায় সন্ত্রাসীবাদীরা একটি পর্যটক বোঝাই বাসে গ্রেনেড ছুড়লে চার জন পর্যটক নিহত এবং ছ’জন আহত হয়েছিলেন। নিহতেরা ছিলেন গুজরাটের বাসিন্দা। ঘটনাচক্রে, সে সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সে বছরেরই ১১ জুলাই শ্রীনগরেরই লালচকে পর্যটক বোঝাই বাসে ফের গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। ওই ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন এক জন। সে দিন শ্রীনগরের বিভিন্ন প্রান্তে পাঁচটি হামলায় মোট আট জনের মৃত্যু হয়েছিল।
২০১৭ সালের ১১ জুলাই
সাত জন অমরনাথ তীর্থযাত্রীকে হত্যা করা হয়। পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গুলিযুদ্ধও ঘটে। দক্ষিণ কাশ্মীরের বোয়েতাং অঞ্চলে ঘটে এই ঘটনা।
তবে বছর গড়ালেও হুমকি কাটেনি। বারবার রক্তাক্ত হয়েছে ভূস্বর্গ (Jammu Kashmir)। ভিনরাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকেরা খুন হয়েছেন হামেশাই। অমরনাথ, বৈষ্ণোদেবী বা অন্যান্য ধর্মস্থানে আগত পুণ্যার্থীরাও বার বার হামলার শিকার হয়েছেন। প্রায় দু’দশকের ব্যবধানে কাশ্মীর উপত্যকার ফের মঙ্গলবার এত বড় হামলার (Pahalgam Terror Attack) শিকার হলেন পর্যটকেরা। এই ধারাবাহিক হামলাগুলোর দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়, সন্ত্রাসবাদের কোনও মানবিকতা নেই, নেই কোনও ধর্মীয় বোধ। ধর্মের নামে যারা হত্যা চালায়, তারা মানবতা থেকেই বিচ্যুত। তারা কাশ্মীরের ভালো চায় না। কাশ্মীরীদের রুজি-রুটি পর্যটন সেখানেই ধাক্কা দিল জঙ্গিরা। আসলে সন্ত্রাসের লক্ষ্যই হল জন্নত-এ-কাশ্মীরকে জাহান্নামে পরিণত করা।
২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল
কাশ্মীরের পহেলগাঁও-য়ের বৈসরনে পর্যটকদের উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালায় জঙ্গিরা। মৃতের সংখ্যা ২৬।
পহেলগাঁওয়ের তদন্তে উঠে এল ১৪ স্থানীয় জঙ্গির নাম
জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে (pahalgam) গত ২২ এপ্রিল ঘটে যাওয়া ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কেন্দ্রশাসিত এই অঞ্চলে সক্রিয় ১৪ জন স্থানীয় সন্ত্রাসবাদীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সূত্রের খবর অনুযায়ী , এই ব্যাক্তিদের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। নাম প্রকাশিত জঙ্গিরা পাকিস্তান থেকে আগত বিদেশি সন্ত্রাসবাদীদের অস্ত্র সরবরাহ ও স্থানীয় স্তরে সহায়তা প্রদানে সক্রিয়ভাবে জড়িত। এই সন্ত্রাসীরা পাকিস্তান-সমর্থিত তিনটি প্রধান জঙ্গি সংগঠন—হিজবুল মুজাহিদিন, লস্কর-ই-তৈবা (LeT) এবং জৈশ-ই-মোহাম্মদ (JeM)-এর সঙ্গে যুক্ত। তাদের মধ্যে তিনজন হিজবুল মুজাহিদিন, আটজন LeT এবং তিনজন JeM-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
প্রকাশিত তালিকায় নাম রয়েছে, আদিল রেহমান ডেন্টু (২১), আসিফ আহমেদ শেখ (২৮), আহসান আহমেদ শেখ (২৩), হারিস নাজির (২০), আমির নাজির ওয়ানি (২০), ইয়াওয়ার আহমেদ ভাট, আসিফ আহমেদ খান্ডে (২৪), নাসির আহমেদ ওয়ানি (২১), শাহিদ আহমেদ কুতায় (২৭), আমির আহমেদ দার, আদনান সাফি দার, জুবাইর আহমেদ ওয়ানি (৩৯), হারুন রশিদ গনাই (৩২), এবং জাকির আহমেদ গানি (২৯)।
পহেলগাঁওয়ের জঙ্গি হামলা নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য
তসলিমা নাসরিন- লেখিকার মতে, ১৪০০ বছর ধরে ইসলামের কোনও পরিবর্তন হয়নি। যতদিন না এই ধর্মের পরিবর্তন হচ্ছে এটি সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিতেই থাকবে। পহেলগাঁও হামলার ঘটনাকে তিনি ২০১৬ সালে ঢাকায় হোলি আর্টিজেন বেকারি হামলার সঙ্গে তুলনা করেন। তসলিমার কথায়, ‘ঢাকায় মুসলিমদের হত্যা রা হয়েছিল কারণ তাঁরা কলমা পড়তে পারেননি। এমনটাই হয় যখন ভক্তি মানবতার থেকে বড় হয়ে দাঁড়ায়।’ তসলিমা বলেন, ‘ইউরোপে গির্জাগুলিকে জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে। আর মুসলিমরা চতুর্দিকে মসজিদ নির্মাণ করে চলেছেন। হাজার হাজার মসজিদ রয়েছে অথচ তাঁদের আরও চাই। মাদ্রাসা তুলে দেওয়া উচিত। একটা নয়, শিশুদের সমস্ত বই পড়ার অধিকার থাকা উচিত।’
জেডি ভ্যান্স- পাকিস্তানের জঙ্গিদের খুঁজে বের করাই আপাতত প্রধান কাজ ভারতের এবং সেই কাজে ভারতকে সহযোগিতা করা উচিত পাকিস্তানেরও। পহেলগাম হামলার প্রেক্ষাপটে এমনই মন্তব্য করলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি. ভ্যান্স। তিনি আরও বলেন, ওয়াশিংটন আশা করে এই হামলা পরবর্তী ভারতের যে প্রতিক্রিয়া , তা যেন বৃহত্তর কোনও অঞ্চলিক সংঘাতের কারণ না হয়, সেদিকে নজর দেবে ভারত।
ফারুক আবদুল্লা- ‘পহেলগাঁও জঙ্গি হামলায় স্থানীয়দের হাত ছিল! ওদের মদতেই সন্ত্রাসবাদীরা এই মানবহত্যার কাণ্ড ঘটিয়েছে।’ সূত্রের খবর সম্প্রতি এমনই মন্তব্য করেছেন জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা। সূত্রের খবর, জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা জানিয়েছেন, ‘আহত ও নিহতদের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা। পহেলগাঁওতে বৈসরণ ভ্যালিতে পর্যটকদের উপরে যে জঙ্গি হামলা হয়েছে সেই ঘটনায় যে কেও জড়িয়ে থাকতে পারে। যতদিন না অবধি কোন অভিযুক্ত ধরা পড়ছে ততদিন অবধি পরিষ্কার করে কিছু বলা সম্ভব না। এখানে নিশ্চয় স্থানীয়দের মদত ছিল। কারোর সাহায্য ছাড়া এমন ঘটনা ঘটান সম্ভব নয় জঙ্গিদের পক্ষে। সন্ত্রাসবাদীদের নেটওয়ার্ক সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে। ওরা সব জায়গায় আছে। অতীতেও বেশ কিছু জায়গায় জঙ্গি হামলা হয়েছে।’
অমিতাভ বচ্চন- দীর্ঘ শূন্যতা। একটানা ব্ল্যাঙ্ক পোস্ট, তবে অবশেষে পহেলগাঁওতে জঙ্গি হামলা ও অপারেশন সিন্দুর নিয়ে মন্তব্য করলেন অমিতাভ বচ্চন। গত ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওতে নৃশংসভাবে ২৬ জনকে খুন করে জঙ্গিরা। তারপর ২৩ এপ্রিল থেকেই নিজের এক্স(টুইটার) অ্যাকাউন্টে একটি বাক্যও খরচ করেননি বিগ বি। শুধুমাত্র নিজের টুইট সংখ্যা লিখে ব্ল্যাঙ্ক রেখে গিয়েছেন নিজের পোস্টের অংশটি। তাতেই অবাক হন তাঁর অনুরাগীরা। সকলেরই জানা, যে অমিতাভ সোশ্যাল মিডিয়ায় দারুনভাবে সক্রিয়। কিন্তু পহেলগাঁও হামলার পর একটি বাক্যও খরচ করেননি তিনি। তবে গত রবিবার সবটা উজার করে দিয়েছেন তিনি।
অনেকের ধারণা পহেলগাঁওতে জঙ্গি হামলায় ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি। তাই রাগেই কোনও বক্তব্য লেখেননি সিনিয়র বচ্চন। কিন্তু এদিন, পহেলগাঁও হামলার প্রসঙ্গ থেকে অপারেশন সিন্দুর সবটা নিয়েই নিজের বক্তব্য রেখেছেন অমিতাভ। এক্সে তাঁর লেখনিতে উঠে এসেছে পহেলগাঁওয়ের ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা। এবং তা কীভাবে অপারেশন সিন্দুরের সৃষ্টি করল সেকথাও লেখেন তিনি। আর তারপর তুলে ধরেছেন তাঁর বাবা তথা প্রয়াত কবি হরিবংশ রায় বচ্চনের লেখা পঙক্তি। ওই পঙক্তি অমিতাভের ‘অগ্নিপথ’ সিনেমাতেও ব্যবহৃত হয়েছিল। সেটি হল- ‘তু না থামে গা কভি, তু না মুড়েগা কভি, তু না ঝুকেগা কভি/ কর শপথ, কর শপথ, কর শপথ! অগ্নিপথ! অগ্নিপথ! অগ্নিপথ!’ অর্থাৎ পহেলগাঁও হামলার কড়া জবাবের অপেক্ষাতেই ছিলেন অমিতাভ। অপারেশন সিন্দুরের পর শান্তি পেয়েছেন তিনি। তাই, রবিবার এক্সে নিজের বক্তব্য পেশ করেছেন বিগ বি।