নিউজ ডেস্ক: নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় চাকরি গিয়েছে হাজার হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর। নতুন করে নিয়োগ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বেতন পাচ্ছেন চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কিন্তু চাকরিহারা গ্রুপ সি ও ডি কর্মীদের রেহাই দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। এবার তাঁদের জন্য প্রকল্পের ঘোষণা করলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানালেন, মাসে মাসে চাকরিহারাদের অনুদান দেওয়া হবে।
প্রতি মাসে কত পাবেন চাকরিহারা গ্রুপ সি-গ্রুপ ডি কর্মীরা?
এপ্রিল মাসের হিসাবে অনুসারে গ্রুপ সি কর্মীরা পাবেন ২৫ হাজার টাকা আর গ্রুপ ডি কর্মী পাবেন ২০ হাজার টাকা। সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বুধবার নবান্ন থেকে সাংবাদিক বৈঠক করেন মমতা। সেখানেই এসএসসি-র গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মীদের জন্য রাজ্য সরকারের বিশেষ প্রকল্পের ঘোষণা করেন তিনি।
কেন এই সিদ্ধান্ত?
উল্লেখ্য, এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এসএসির ২০১৬ সালের প্যানেল বাতিল হয়েছে। চাকরিহারা হন প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মীরা। পরে রায়ের কয়েকটি দিক পরিবর্তনের জন্য আবেদন করা হলে আদালত ‘অযোগ্য বলে প্রমাণিত নন’ শিক্ষকদের আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেয়। তাঁরা বেতনও পাচ্ছেন। কিন্তু অশিক্ষক কর্মী অর্থাৎ গ্রুপ সি ও ডিদের ক্ষেত্রে এই রকম কিছু বলা হয়নি। তাঁরা বেতন পাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে চাকরিহারা অশিক্ষককর্মীদের পাশে দাঁড়াল রাজ্য সরকার।
আসলে এমন অনেক স্কুল রয়েছে, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ফলে একাধিক অশিক্ষক কর্মীর চাকরি গিয়েছে। সেই সব স্কুলের নানাবিধ কাজ থমকে রয়েছে। স্কুলপড়ুয়াদের জন্য রাজ্য সরকারের যে প্রকল্প রয়েছে, তাতেও প্রভাব পড়ছে। এই অবস্থায় নেতাজি ইন্ডোরের সভা থেকেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, রাজ্য সরকার বিকল্প পথের সন্ধান করবে। শিক্ষাকর্মীদের জন্য সেই বিকল্প পথে ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, যতদিন না আদালত চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়, ততদিন এই স্কিম চালু থাকবে। এর নাম দেওয়া হয়েছে— ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল লাইভলিহুড অ্যান্ড সোশাল সিকিউরিটি ইন্টারিম স্কিম’। চাকরি হারিয়ে বেশ হতাশই হয়ে পড়েছিলেন গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মীরা। তবে বুধবার ভাতার ঘোষণার পরে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হলেন তাঁরা। এ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, কেউ কেউ হয়তো বলবেন দরকার নেই। এটা তাদের স্বাধীন মতামত। এনিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। তবে আমরা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কী জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী?
দিনভর জল্পনার পর এ দিন মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “চাকরি খোওয়া যাওয়া ছেলেমেয়েরা অনেক কষ্টে আছেন। সংসার চালাতে পারছেন না। অনেকেই বলছেন, তাঁদের কোনও দোষ ছিল না। আদালতের নির্দেশে তাঁদের চাকরি চলে গিয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে আদালতে রিভিউয়ের আবেদন করেছি। আদালতের চূড়ান্ত নির্দেশের অপেক্ষায় আছি। কিন্তু ততদিন ওরা কী খাবে, কীভাবে চলবে ?” সেই মানবিক প্রশ্ন থেকেই এই ‘ইন্টারিম স্কিম’-এর পরিকল্পনা বলে জানান মমতা। এদিন তিনি বলেন, “এই স্কিম রাজ্য শ্রম দফতরের আওতায় চলবে। পয়লা এপ্রিল থেকে এই অনুদান কার্যকর হবে।
এই দুর্নীতির শুরু কোথায়?
২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এসএসসি-তে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই বছরই ২৭ নভেম্বর ওএমআর শিটে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর দু’বছর পর ২০১৮ সালের ১২ মার্চ প্রকাশ করা হয় চূড়ান্ত প্যানেল। ২৮ অগস্ট প্রকাশিত হয় প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের মেধাতালিকা। ২০১৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষক হিসাবে চাকরি পান নির্বাচিতেরা। ২০১৬ সালের সেই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০২১ সালে। কলকাতা হাই কোর্টে দায়ের হয় একগুচ্ছ মামলা। অভিযোগ ওঠে, গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মী, নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগে যথেচ্ছ দুর্নীতি হয়েছে। এর পর থেকে জল গড়িয়েছে বহু দূর।
সুপ্রিম কোর্টে এই মামলাটি মোট ২০ বার শুনানির জন্য ওঠে। বিভিন্ন পক্ষের প্রায় ৪০০ আইনজীবী মামলায় যোগ দেন। শেষমেশ ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানি শেষ হয় প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চে। রায় ঘোষণা স্থগিত রাখে আদালত। সম্প্রতি ওই মামলাতেই রায় ঘোষণা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার জনের নিয়োগ।
বিকাশ ভবনে চাকরিহারাদের বিক্ষোভ
এসবের মধ্যেই বৃহস্পতিবার সকালে বিকাশ ভবন অভিযানে শামিল হন তাঁদের একাংশ। আর এই অভিযান ঘিরেই তুলকালাম বেঁধে যায় সল্টলেকে। ব্যারিকেড ভেঙে বিকাশ ভবনে ঢোকার চেষ্টা চালায় তারা। তবে পুলিশ প্রাথমিকভাবে তাদের প্রতিহত করে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে চাকরিহারা এসএসসির ২৬ হাজার শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মী। রাজ্য সরকার তাঁদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। প্রয়োজনীয় আইনি লড়াইয়ের আশ্বাস দেন। এনিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে দেখাও করেন। বৈঠক হয়। সেই সময় রাজ্য বলেছিল, রিভিউ পিটিশন ফাইল করা হবে। চাকরিহারাদের সঙ্গে কথা বলে আইনি পদক্ষেপ করা হবে। প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে চাকরিহারাদের অবগত করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না বলে অভিযোগ চাকরিহারাদের। তাঁরা নাকি শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখাও করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা হয়নি। এরপরই বৃহস্পতিবার বিকাশ ভবন অভিযান করেন তারা।
প্রথমে বিকাশ ভবনের গেটে ব্যারিকেড দিয়ে তাঁদের আটকানো হয়। সেখানে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি বেঁধে যায়। তারপরই গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়েন আন্দোলনকারীরা। তাঁদের দাবি, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল মে মাসের মধ্যে নতুন করে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। তা হয়নি। রাজ্য উদ্যোগ নিচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেবে এসএসসি দুর্নীতি মামলা?
উল্লেখ্য, গতকাল অর্থাৎ ১৪ই মে, ২০২৫ তারিখে দেশের ৫২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন বিচারপতি ভূষণ রামকৃষ্ণ গাভাই। বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ১১ই নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে ভারতের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রায় ছয় মাসের সংক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ কার্যকালে একাধিক উল্লেখযোগ্য মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে, পশ্চিমবঙ্গের চাকরিপ্রার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসএসসি মামলার রিভিউ পিটিশনের শুনানি তাঁর অবসরের আগের দিন তালিকায় থাকলেও, শেষ পর্যন্ত তা বিচারপতি খান্নার বেঞ্চে ওঠেনি। ফলে, এই মামলার ভবিষ্যৎ এবং চাকরিপ্রার্থীদের ভাগ্য এখন পরবর্তী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল।
বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার অবসরের পর, নতুন প্রধান বিচারপতি বি.আর. গাভাইয়ের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট কীভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির নিষ্পত্তি করে, সেদিকেই তাকিয়ে থাকবে সারাদেশ, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী এবং তাঁদের পরিবারবর্গ। আশা করা হচ্ছে, শীঘ্রই এই মামলার শুনানির জন্য নতুন বেঞ্চ গঠন করা হবে এবং ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত হবে।