নিউজ ডেস্ক: নতুন করে ফের উত্তেজনা। বৃহস্পতিবারের পর আজ, শুক্রবার সকালেও বিকাশ ভবনে ছড়াল উত্তেজনা। বিক্ষোভরত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা ফের ব্যারিকেড ফেলে দিয়ে পুলিশের সামনেই বসে পড়েন। চাকরি ফেরানোর দাবিতে স্লোগান দিচ্ছেন তারা। মাসের পর মাস, বছরের পর দিনরাত পড়াশোনা করে চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু এসএসসি দুর্নীতি এদের জীবন তছনচ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বিকাশ ভবন অভিযানের ডাক দেন চাকরিহারারা। তাঁদের সাফ কথা, “দুর্নীতি করেছে রাজ্য, ফলে সব দায় রাজ্যকে নিতে হবে। এর দায় যোগ্য শিক্ষকরা কেন নেবেন?”
বিক্ষোভে সামিল চাকরিহারারা
চাকরিহারা শিক্ষকদের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে দিনভর বিকাশ ভবনের সামনে উত্তেজনা ছড়ায়। এ দিন বেলা ১২টা থেকে বিকাশ ভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। সকাল থেকেই চলে এই বিক্ষোভ অভিযান। মাঝে বিধাননগর পুরসভার চেয়ারম্যান সব্যসাচী দত্ত যাওয়ার পর উত্তেজনা আরও বাড়তে থাকে। চাকরিহারা শিক্ষকরা দাবি করেন, সব্যসাচীর অনুগামীরা এ দিন পুলিশের সামনেই আন্দোলনকারীদের মারধর করেন। একাধিক শিক্ষক আহত হয়েছেন। রক্ত ঝরে শিক্ষকদের।
পুলিশের সামনেই বিক্ষোভকারী চাকরিহারারা ব্যারিকেড ভেঙে ফেলেছে বলে অভিযোগ। বসে পড়েছেন বিকাশ ভবনের সামনে। পাল্টা পুলিশের বিরুদ্ধে পাল্টা ক্ষোভ উগরে দিয়ে বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, ‘আমরা যোগ্য চাকরিপ্রার্থী। মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ আমাদের গায়ে হাত তুলেছে। উনি কেন আসছেন না? পুলিশমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে এর দায় নিতে হবে।’ বিকাশ ভবনে যেতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন চাকরিহারাদের। এই উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে কার্যত অবরুদ্ধ বিকাশ ভবন চত্বর। ব়্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স এবং প্রচুর সংখ্যায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বিকাশ ভবনের সামনে। রয়েছেন একজন আইপিএস পদমর্যাদার অফিসার।
উল্লেখ্য, চাকরিহারা শিক্ষকদের বিক্ষোভে বৃহস্পতিবার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বিকাশ ভবনের সামনে। চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপর লাঠিচার্জের অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। একাধিক আহত হন। বিকেল থেকেই প্রচুর সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল বিকাশ ভবন চত্বরে। সন্ধে গড়াতেই পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে শুরু করে। সন্ধ্যা ৭.৩০ এর পর ঘটনাস্থল থেকে চাকরিহারাদের টেনে হিঁচড়ে বের করতে শুরু করে পুলিশ। তখনই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
চাকরিহারাদের দাবি, তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু পুলিশ বিনা প্ররোচনায় লাঠিচার্জ করে। যদিও পুলিশের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। বিক্ষুব্ধদের দাবি, তাঁরা পরীক্ষায় নতুন করে বসবেন না। সেই বার্তা পৌঁছে দিতে চান মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে। তাঁদের সঙ্গে আলোচনাও চান। সেই জন্য অবস্থান করছেন। তবে সেই অবস্থানে লাঠিচার্জ করা হয়।
চলল লাঠি, রক্তাক্ত চাকরিহারা শিক্ষকরা
এদিন সব্যসাচী দত্তকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখালেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। তৃণমূল নেতার গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। পাল্টা তেড়ে গিয়ে শাসানি দেন সব্যসাচী। রাতেই চাকরিহারাদের লাঠিচার্জ করে সরিয়ে দেয় পুলিশ। দুর্নীতির জেরে হকের চাকরি খুইয়েছেন। তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে জুটল মার। পুলিশের লাঠি থেকে তৃণমূল নেতার অনুগামীদের লাথি বাদ গেল না কিছুই।
রাজ্য জুড়ে ধিক্কার দিবস পালনের ডাক
বিকাশ ভবনে চাকরিহারা শিক্ষকদের উপর পুলিশের নির্মম লাঠিচার্জের অভিযোগ তুলে শুক্রবার রাজ্য জুড়ে ধিক্কার দিবস পালনের ডাক দিলেন ‘যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ’-এর সদস্যরা। নাগরিক সমাজ থেকে বুদ্ধিজীবী মানুষদের তাঁদের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি, রাজ্য জুড়ে শুক্রবার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে তাঁদের তরফে।
এ প্রসঙ্গে এই সংগঠনের আহ্বায়ক মেহবুব মণ্ডল বলেন, ‘যে ভাবে আমাদের উপর লাঠিচার্জ করা হলো, তার প্রতিবাদে আমরা আগামীকাল ধিক্কার দিবস পালন করব। আমরা প্রতিটি শিক্ষক, শিক্ষা কর্মীদের অনুরোধ করব, রাজ্যের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ রাখার জন্য।’
চাকরিহারাদের তরফে বলা হয়, ‘অনেক শিক্ষক হাসপাতালে আছে। এঁদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। একজনের চোখে এমন আঘাত করেছে, জানি না সেই চোখ আদৌ ঠিক হবে কি না। অনেক শিক্ষকের হাত, পা ভেঙে দিয়েছে। জীবনে বাঁচার লড়াই করছেন তাঁরা। পুলিশ চাইছে একদম মেরে ফেলতে। পুলিশ শিক্ষকদের মেরে পর্যন্ত ওদের লাঠি ভেঙে দিয়েছে। আমরা কাল অর্থাৎ শুক্রবার গোটা বঙ্গবাসীকে, সকল সাধারণ নাগরিকদের আবেদন জানাচ্ছি, তাঁরা যেন এই নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের পাশে থেকে কাল রাস্তায় নামেন। কাল যেন সকলে ধিক্কার দিবস পালন করে। কাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার আবেদন জানাচ্ছি।’
শিক্ষকদের বিরুদ্ধে স্বতঃ প্রণোদিত মামলা
ইতিমধ্যেই চাকরিহারা শিক্ষকদের ওপর বিধাননগর পুলিশের লাঠিচার্জ নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অতিসক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে ই-মেলে অভিযোগ জানিয়েছেন আইনজীবী রাজনীল মুখোপাধ্যায়। বিধাননগর কমিশনারেটের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ করুক আদালত, আর্জি আইনজীবীর। শুক্রবার এই নিয়ে প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এনে এবার বিধাননগর পুলিশের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে স্বতঃ প্রণোদিত মামলা করা হল। ২০১৬ সালে এসএলএসটি যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের করেছে বিধাননগর পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা দেওয়া এবং অবৈধভাবে সরকারি কর্মীদের অভিযোগ আনা হয়েছে। একাধিক ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশের এই পদক্ষেপকে ধিক্কার জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। তাদের বক্তব্য, “আমরা কোনও ভাঙচুর করিনি। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলাম। পুলিশ কয়েকটা ছবি নিয়ে এখন আন্দোলনকে বিমুখ করার চেষ্টা করছে। এভাবে আমাদের আটকাতে পারবে না। আমাদের হকের চাকরি ফিরিয়ে দিতেই হবে।”
এই দুর্নীতির শুরু কোথায়?
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে এসএসসি-র নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি মহম্মদ সব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ। গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি, নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশের সমস্ত নিয়োগ, অর্থাৎ ২০১৬ সালের পুরো প্যানেল বাতিল করে দিয়েছিল হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। সেই রায়ই বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। এসএসসি প্যানেল বাতিলে চাকরি হারায় ২৫ হাজার ৭৫২ জন শিক্ষক শিক্ষিকারা। এরপর থেকেই সরগরম রাজ্য থেকে রাজনীতি। আদালত জানিয়েছে, নতুন করে নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে কমিশনকে। অভিযোগ, এর ফলে অনেক ‘যোগ্য’ শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীরও চাকরি গিয়েছে। এরপর ২৬ হাজার চাকরি বাতিলের প্রতিবাদে গত মাসের ২১ থেকে ২৪ তারিখ এসএসসি ভবনের সামনে অবস্থানে বসেছিলেন চাকরিহারারা। এরপর চলতি মাসের ৭ তারিখ থেকে বিকাশ ভবনের সামনে অবস্থান শুরু করেন চাকরিহারাদের একাংশ। চাকরি হারিয়ে মূলত লাগাতার বিক্ষোভে সামিল হন শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
তবে যত দিন গড়াচ্ছে বিকাশ ভবনের আন্দোলন ক্রমেই প্রশাসন বনাম শিক্ষকদের সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে। একদিকে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার নামে পুলিশের কড়া পদক্ষেপ, অন্যদিকে চাকরি হারানো ‘যোগ্য’ প্রার্থীদের বেঁচে থাকার লড়াই। বিচারাধীন একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্র ও রাজনীতি বর্তমানে দুই-ই প্রবল চাপে।