নিউজ ডেস্ক: এ যেন ঘর শত্রু বিভীষণ- পাকিস্তানকে ভারতের গোপন তথ্য দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফাতার হরিয়ানার ইউটিউবার জ্যোতি মালহোত্রা। ভারতের নানা গোপন তথ্য ইসলামাবাদের কাছে পাচার করছিল ইউটিউবার, এমনটাই অভিযোগ। আইএসআই এজেন্টের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। ইউটিউবারের ফোন থেকে তাঁর নম্বরও পাওয়া গিয়েছে। জ্যোতির সঙ্গে যে পাকিস্তানের যোগ ছিল, তার প্রমাণ মিলল তাঁর ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিয়ো থেকেই।
পাশাপাশি ওই একই অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে আরও ৫ জনকে। এদের সবাই পঞ্জাব ও হরিয়ানার বাসিন্দা। এরা কোনও না কোনওভাবে পাকিস্তানি এজেন্টদের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল।
কে এই জ্যোতি মালহোত্রা?
৩৩ বছরের জ্যোতি মালহোত্রাকে নেট দুনিয়া এতদিন ট্রাভেল ব্লগার হিসেবই চিনত। ‘ট্র্যাভেল উইথ জো’ নামে ইউটিউবে একটি চ্যানেল রয়েছে তার। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৩২ হাজার। তদন্তে উঠে এসেছে ২০২৩ সালে পাকিস্তানে যান জ্যোতি মালহোত্রা। পকিস্তান ভ্রমণের সময় তাঁর যোগাযোগ হয় দিল্লিতে পাক হাইকমিশনের কর্মী এহেসান উল রহিম ওরফে দানিশের সঙ্গে। দানিশের সঙ্গে টানা যোগাযোগ ছিল জ্যোতি। এই দানিশই পাকিস্তানের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন জ্যোতিকে।
হোয়াটসঅ্যাপ, স্নাপচ্যাট ও টেলিগ্রামের মতো মেসেজিং প্লাটফর্ম ব্যবহার করে জ্যোতি যোগাযোগ রাখতেন পাক হ্যান্ডলারদের সঙ্গে। তাদের মধ্যে রয়েছে শাকির ওরফে রানা সাহবাজ। এই শাহবাজের নাম জ্যোতি তাঁর মোবাইলে সেভ করেছিলেন জাট রানধাওয়া নামে। গোয়েন্দাদের দাবি, জ্যোতি ভারতের একাধিক জায়গার তথ্য পাকিস্তানকে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় পাকিস্তানের ভালো ইমেজ তুলে ধরতেন জ্যোতি। এক পাক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এমনকি তার সঙ্গে বালি ও ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
এছাড়াও সোশাল মিডিয়া জ্যোতির অ্যাকাউন্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতের নানান জায়গার পাশাপাশি ব্লগের দৌলতে বিদেশেও নিত্য যাতায়াত ছিল তাঁর। পাকিস্তান ছিল মূল ঘাঁটি। এছাড়াও সিঙ্গাপুর, চিন-সহ নানা দেশে ঘুরে বেড়াতেন ট্রাভেল ব্লগের অছিলায়। সুন্দরী এই মহিলার স্বল্পবসনা বহু ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় রীতিমতো ভাইরাল। পাকিস্তানেরও নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে ভিডিও বানাতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। যেখানে পাকিস্তানের গুণগান করছেন জ্যোতি। পাকিস্তানের হিন্দু মন্দিরের সামনেও বহু ভিডিও রয়েছে তাঁর।
ট্র্যাভেল ব্লগিং-এর নামে কীভাবে পাকিস্তানে গোপন তথ্য পাচার করছিলেন?
সুন্দরী এই গুপ্তচরকে গ্রেপ্তারের পর তদন্তকারীদের তরফে জানা গিয়েছে, একদিকে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপারেশন সিঁদুর চলছে সেই সময় ভারতের একের পর এক গোপন তথ্য পাকিস্তানে পাচার করছিলেন তিনি। পেশায় ট্রাভেল কনটেন্ট ক্রিয়েটার এই মহিলা এর আগে তিন তিন বার পাকিস্তান গেছেন। সবই ট্রাভেল ভিডিও বানানোর আছিলায়।
গত বছরের ৩০ মার্চ পোস্ট করা ভিডিওটিতে জ্যোতি হাইকমিশনের ইফতার পার্টির বর্ণনা দিয়েছে। ভিডিয়ো চলাকালীন রহিমের মুখোমুখি হয়ে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় সে। কথা শুনেই বোঝা যায় তারা পূর্বপরিচিত। ভিডিয়োতে হাইকমিশনে এসে কতটা খুশি তা নিয়ে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছে জ্যোতি। লাইভ ভিডিয়োতেই পাকিস্তানের ভিসাও চাইতে দেখা গিয়েছে ইউটিউবারকে।
জ্যোতির বিরুদ্ধে একাধিক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। একাধিকবার পাকিস্তান গিয়ে সেখানে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে ভারতীয় সেনা ও সামরিক গুপ্ত তথ্য পাচার করেছে এই ইউটিউবার বলে অভিযোগ। শনিবার গ্রেপ্তারির পর তাকে পাঁচ দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠানো হয়েছে।
ভারতেই লুকিয়ে পাকিস্তানের একাধিক গুপ্তচর
জ্যোতি ছাড়াও পঞ্জাবের মালেরকোটলা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে গাজালা(৩২) নামে এক বিধবা মহিলাকে। এবছর ২৭ ফেব্রুয়ারি দিল্লির পাক হাই কমিশনে সে গিয়েছিল পাকিস্তানের ভিসার জন্য। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় দানিশের সঙ্গে। তার পর থেকে দানিশের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। দানিশ দাগালাকে পরামর্শ দেয় হোয়াটসঅ্যাপ নয় কথা টেলিগ্রাম অ্যাপে কথা বলতে। চ্যাট ও ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে গাজালার সঙ্গে সে একটা রোমান্টির সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এদিকে, তদন্তে উঠে এসেছে প্রায়ই গাজালাতে টাকা পাঠাতো দানিশ। গত ৭ মার্চ একটি পেমেন্ট অ্য়াপের মাধ্যমে গাজালাকে ১০,০০০ টাকা পাঠায় দানিশ। গত ২৩ মার্চ গুগল পে-র মাধ্যমে ২০,০০০ টাকা পাঠায় দানিশ। এরপর বেশ কয়েকজনকে ওই টাকা থেকে মোট ১০,০০০ টাকা পাঠাতে বলে দানিশ।
জানা গিয়েছে, গত ২৩ এপ্রিল পাকিস্তান হাই কমিশনে যায় গাজালা। তার সঙ্গে ছিল নাসরিনা বানো নামে এক মহিলা। সেও বিধবা। এদের দুজনকেই পাকিস্তানের ভিসা পাইয়ে দেয় দানিশ। এদের সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়েছে মালোরকোটলার বাসিন্দা ইয়ামিন মহম্মদ নামে একজনকে। এছাড়াও গ্রেফতার করা হয়েছে কৈথলের বাসিন্দা দেবিন্দর সিং ধীলোঁকে, নুহ জেলার আরমান নামে যুবককে।
হরিয়ানার নুহ্ জেলা থেকে শনিবার আরমান গ্রেফতার করা হয়েছে। নুহ্ পুলিশ জানিয়েছে, ভারতীয় সেনা এবং সামরিক পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাকিস্তানে পাঠাতেন এই যুবক। দিল্লির পাক দূতাবাসের এক কর্মচারীর মাধ্যমে তিনি এই কাজ করতেন। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কাছ থেকে এই খবর পেয়েছিল নুহ্ পুলিশ। তার পরেই যুবককে গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরেই পাকিস্তানের গুপ্তচরের কাজ করছিলেন আরমান। সমাজমাধ্যম ব্যবহার করে, বিশেষত হোয়াট্সঅ্যাপে এই সংক্রান্ত তথ্য তিনি শেয়ার করতেন। পাকিস্তানের একাধিক নম্বরের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ হোয়াট্সঅ্যাপ চ্যাট পাওয়া গিয়েছে। অনেক ছবি এবং ভিডিয়োও তিনি ওই নম্বরে পাঠিয়েছেন। আরমানকে গ্রেফতারির পর আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। আপাতত তাঁকে ছ’দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার একাধিক ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে।
এছাড়াও তালিকায় রয়েছে নোমান ইলাহী উত্তরপ্রদেশের কৈরানার বাসিন্দা ও উত্তরাখণ্ডের রুরকির রাকিব খান, যে ভাতিন্দা ক্যান্টনমেন্টে দর্জির কাজ করত। অন্যদিকে এই একই অভিযোগে বিহারের সমস্তিপুরের মুচি সুনীল কুমারকে গ্রেফতার করা হয়েছে, বর্তমানে তার ফোন ফরেনসিক পরীক্ষার অধীনে আছে। গত ৩ মে, সেনা সেনানিবাস এবং বিমানঘাঁটির তথ্য ছবি তোলার অভিযোগে অমৃতসরে পলক শের মাসিহ এবং সুরজ মাসিহ নামে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অমৃতসর কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দী হরপ্রীত সিং ওরফে পিট্টু ওরফে হ্যাপির মাধ্যমে তারা আইএসআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বলে জানা গেছে। তদন্তকারীদের অনুমান, গুপ্তচরদের কাছে তথ্য পাচার করার একটি চক্র তৈরি হয়েছে এ দেশে। এই চক্র মূলত পঞ্জাব এবং হরিয়ানায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে।