নিউজ ডেস্ক: ইউটিউবারদের কাজে লাগিয়ে ভারতের মন্দিরগুলিকে টার্গেট পাক জঙ্গিদের? ইউটিউবার জ্যোতি মালহোত্রাকে জেরা করার পর এমনই সন্দেহ গোয়েন্দাদের। অযোধ্যার রামমন্দির থেকে পুরীর জগন্নাথ মন্দির, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণেশ্বর মন্দির, সব জায়গারই ভিডিও করেছে জ্যোতি। ব্যারাকপুর গিয়ে সেনা ক্যাম্পাস চত্বরের ছবিও করেছে। সবকিছু দেখে এই সন্দেহ দানা বেঁধেছে গোয়েন্দাদের মনে। ইউটিউবারের আড়ালে এভাবেই সব ছবি হস্তগত করার খেলায় নেমেছিল পাকিস্তান ও তার গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে জ্যোতি
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুরীতে গিয়েছিল জ্যোতি।সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয় আর এক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর প্রিয়ঙ্কা সেনাপতির। সেসময় জগন্নাথ মন্দির থেকে শুরু করে পুরীর বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ের ছবি তোলে তারা। ওড়িশার কনক টিভি জানাচ্ছে, জগন্নাথ মন্দিরের ছবি তুলতে ড্রোন ব্যবহার করেছিল জ্যোতি। এভাবে ছবি তোলার জন্য তখন তাকে আটকও করা হয়। কিন্তু স্থানীয় সঙ্গী প্রিয়ঙ্কার অনুরোধে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। পুরীতে একসঙ্গেই ছিল জ্যোতি ও প্রিয়ঙ্কা। তারা পুরী বিচে ঘুরেছে। ভিডিও করেছে। ফটো তুলেছে।
জ্যোতির সঙ্গে পাকিস্তানে প্রিয়ঙ্কা?
জ্যোতি মালহোত্রকে সাহায্য করার জন্য পুরীর বাসিন্দা ইউটিউবার প্রিয়ঙ্কা সেনাপতিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। জানা গিয়েছে, সাত-আট মাসে আগে পুরীতে আসতে জ্যোতি মালহোত্রকে সাহায্য করেছিলেন এই প্রিয়ঙ্কা। জানালেন পুরীর পুলিশ সুপার। চার সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের কর্তারপুরেও গিয়েছিলেন প্রিয়ঙ্কা সেনাপতি। তদন্তে পুলিশ অফিসারদের মুখোমুখি হয়ে জানিয়েছেন পুরীর ইউটিউবারের বাবা রাজকিশোর সেনাপতি। তবে তাঁর দাবি, প্রিয়ঙ্কা জ্যোতি মালহোত্রর সঙ্গে যায়নি। মেয়ের দেশবিরোধী কার্যকলাপে কোনও ভূমিকা নেই বলেও দাবি করেছেন প্রিয়ঙ্কার বাবা। তবে গোয়েন্দারা সবকিছু খতিয়ে দেখতে চাইছেন।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে রেইকি জ্যোতির
দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জ্যোতির চরবৃত্তির হাতেগরম প্রমাণ এখন গোয়েন্দাদের হাতে। এই তদন্তপর্বেই উঠে এসেছে বাংলার নাম। শুধু কলকাতা নয়, এরাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঘুরে ঘুরে ট্রাভেল ভ্লগ করতে দেখা গিয়েছে জ্যোতিকে। দক্ষিণেশ্বর মন্দির, হাওড়া ব্রিজ, বারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট, জেটিঘাট, শিয়ালদহ স্টেশনের পাশাপাশি বাগডোগরা বিমানবন্দর, শিলিগুড়ির করোনেশন ব্রিজ, সেভক কালীবাড়ি, সুকনা, হাসিমারা, ভুটান গেটের মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা রয়েছে সেই তালিকায়। গোয়েন্দাদের মতে, জ্যোতির এই বঙ্গ সফরগুলি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সুকনায় রয়েছে ভারতীয় সেনার ৩৩ কোরের সদর দপ্তর। হাসিমারা ভারতীয় বায়ুসেনা ঘাঁটি ও জয়গাঁ ভুটানের প্রবেশদ্বার। চিকেন’স নেক-এর এই গুরুত্বপূর্ণ তিন অংশের পাশাপাশি কলকাতায় রয়েছে সেনার ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তর। বারাকপুরে সেনা ছাউনির পাশাপাশি রয়েছে বায়ুসেনা স্টেশনও। বাংলায় সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলির পাশাপাশি শিয়ালদহ স্টেশন, হাওড়া ব্রিজ ও দক্ষিণেশ্বরের ছবি ও ভিডিও আইএসআই হ্যান্ডলারদের কাছে পাঠানো হয়েছে বলেই অনুমান তদন্তকারীদের একাংশের। ইতিমধ্যে পাক চরের বাংলা সফর নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে রাজ্য পুলিস। রাজ্যের কোন কোন জায়গায় গিয়ে জ্যোতি কতদিন ছিল, কী কী করেছে, সেই সমস্ত তথ্য জানতে জেলা প্রশাসনের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।
জ্যোতির সঙ্গে বাংলার কারা?
পাক গুপ্তচর সন্দেহে ধৃত জ্যোতির সঙ্গে বাংলার ১৫ জন ভ্লগারের যোগাযোগের তথ্য মিলেছে। বাংলায় প্রায় সব জায়গাতেই জ্যোতির সঙ্গী ছিল কয়েকজন স্থানীয় ভ্লগার। সূত্রের খবর, ‘ট্রাভেল উইথ জো’ চ্যানেলে গত বছরের ২৪ মে পোস্ট করা একটি ভিডিও নজরে আসে পুলিসের। দেখা যায়, শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে ভ্লগ শ্যুট করছে জ্যোতি। সেখান থেকে সে ট্যাক্সি করে পার্ক সার্কাসে যায় বিরিয়ানি খেতে। এরপর হাওড়া ব্রিজ। সেখানে ভ্লগ বানিয়ে শিয়ালদহে ফেরা। গোটা পর্বে জ্যোতির সঙ্গে ছিল আসানসোলের ইউটিউবার সৌমিত ভট্টাচার্য। গত বছরের ৩১ আগস্ট পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ভুটান যাওয়ার জন্য বাগডোগরায় এসেছিল জ্যোতি। সঙ্গী তিন ভ্লগার। সুকনা, হাসিমারা, জয়গাঁ হয়ে ভুটান যায় তারা। গত ফেব্রুয়ারিতে ফের কলকাতায় আসে জ্যোতি। মোহিত সিং নামে এক ইউটিউবারের বিয়েতে। সঙ্গে ছিল সৌমিত। কলকাতা ও বারাকপুর ঘুরে শেওড়াফুলি যায় তারা।
হিসার পুলিস সূত্রে খবর, বাংলার অন্তত ১৫ জন ভ্লগারের সঙ্গে জ্যোতির যোগাযোগের তথ্য মিলেছে। শীঘ্রই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের ডেকে পাঠানো হবে বলে খবর।
অযোধ্যার রামমন্দিরে জ্যোতি
রামমন্দির উদ্বোধনের আগেই সেখানে হাজির ছিল জ্যোতি মালহোত্রা। ঘুরে ঘুরে সেখানে ভিডিও করতে দেখা গেছে তাকে। ওই সময়ই তার সঙ্গে আলাপ হয় বাংলার সৌমিত ভট্টাচার্যের। এমনই দাবি করেছেন সৌমিত। সেই জানাশোনাই পরে বন্ধুত্বের পর্যায়ে পৌঁছয়। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, এভাবেই বিভিন্ন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ছবি তুলে ফেলতো জ্যোতি। তারপর সে পাঠিয়ে দিত পাকিস্তানে। দিল্লির পাক হাইকমিশন তাকে এই কাজে ব্যবহার করতো।
অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে জ্যোতি
২০২২ সালের ৩১ আগস্ট। নিজের ফেসবুক চ্যানেলে একটি রিল পোস্ট করে জ্যোতি। তাকে গ্রেফতারের পর এনিয়ে তদন্তে নামে গোয়েন্দারা। দেখা যায়, সেই সময় স্বর্ণমন্দিরের যাবতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এমনকি ওপরের ছবিও তুলেছে জ্যোতি। এককথায়, পুরো ডকুমেন্টেশন করেছে সে। সাধারণ ভ্লগাররা এতো কিছু সাধারণত তোলে না। কিন্তু তার ভিডিও করার ধরণ দেখেই সন্দেহ হচ্ছে গোয়েন্দাদের। কারণ, পহেলগাঁও হামলার পর ভারত-পাক সংঘর্ষের সময় এই স্বর্ণমন্দিরকে টার্গেট করেই হামলা চালিয়েছিল পাকিস্তান। মাঝ আকাশেই তা ভেস্তে দেয় ভারতীয় সেনা। কিন্তু ৩ বছর আগে থাকতেই সবকিছু হাসিল করে ফেলে তারা। স্বর্ণমন্দিরের যাবতীয় ছবি তাদের হাতে চলে আসে। যেখানে দাঁড়িয়ে জ্যোতি ভিডিও করেছিল, সেই জায়গাটাকেই পাকিস্তানি ড্রোন জিপিএসে ট্র্যাক করেছিল। আর তাই জ্যোতির মন্দির কানেকশন নিয়ে সন্দেহ করছে গোয়েন্দারা।
সন্ত্রাসে হাতিয়ার সোশাল মিডিয়া
জ্যোতি কাণ্ড সামনে আসার পরই তদন্তে নামে গোয়েন্দারা। দেখা যায়, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, চিনের মতো জায়গা থেকে ৪৮৭টি ভিডিও আপলোড করেছে সে। আর সেই ভিডিওয় দেখা যাচ্ছে, জেনে বুঝেই ভারতের বিভিন্ন মিলিটারি এলাকার ছবি ও তথ্য দেওয়া হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে ভারতের বিভিন্ন মন্দিরের ছবি, সেখানকার যাবতীয় তথ্য। এমনকি ভারতের বিভিন্ন শহরের জনবহুল এলাকার ছবিও সেখানে দেওয়া হয়েছে।
এই সবকিছু দেখেই চোখ কপালে উঠেছে গোয়েন্দাদের। তাঁরা মনে করছেন, অনেকদিন ধরেই জ্যোতিকে টার্গেট করেছে পাক গুপ্তচররা। তারপর তাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে। আর বৈভবে ভেসে গিয়ে, ওপর মহলে যোগাযোগের সূত্রে নিজেই স্পাই হয়ে গেছে জ্যোতি