নিউজ ডেস্ক: সুপ্রিম রায়ে চাকরিহারা ২৬ হাজার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীর কাছে এ প্রশ্নের উত্তর এখনও স্পষ্ট নয়। নিজেদের দাবিতে বিকাশ ভবনের সামনে চলছে ধরনা। এই পরিস্থিতিতে এবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে খোলা চিঠি লিখলেন চাকরিহারারা। পরীক্ষার পথে না হেঁটেই যাতে চাকরি সুনিশ্চিত করা যায়, সেবিষয়েই আন্দোলনকারী শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মীরা আলোচনা করতে চাইছেন বলেই খবর।
কী বলছেন চাকরিহারারা?
বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়ে ইমেইল করলেন চাকরিহারারা। সরকার যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীদের নিয়ে কী ভাবছে, তা তাঁরা জানতে চান। সেজন্যই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান বলে যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের শিক্ষক শিক্ষিকারা জানিয়েছেন। এছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয় তাঁরা জানতে চান বলে চিঠিতে জানিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের তরফে বলা হয়েছে, “আমরা বিগত ১৪ দিন ধরে বিকাশ ভবনের সামনে অবস্থানরত। আপনি জানেন বিগত ৩ তারিখ (৩ এপ্রিল) সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আমাদের চাকরি চলে গিয়েছে। এমত অবস্থায় আমরা অসহায় হয়ে বারবার আমাদের শিক্ষামন্ত্রী এবং আপনার দ্বারস্থ হয়েছি।”এছাড়াও গত ১৫ এপ্রিল বিকাশ ভবনের সামনে চাকরিহারা শিক্ষকদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনার উল্লেখ করে চিঠিতে লেখা হয়েছে, “পরীক্ষার নোটিস বা পরীক্ষা সংক্রান্ত সংবাদের দরুণ বিগত ১৫ তারিখ একটি আন্দোলন সংগঠিত হয়, যেটা সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। আমরা চাই না এরকম কিছু আর ঘটুক। তাই আপনার হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।”
মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠানো চিঠিতে যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ লিখেছে, সরকার যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মীদের নিয়ে কী ভাবছে? রিভিউ পিটিশনের গতিপ্রকৃতি কী? নতুন বিজ্ঞপ্তি নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনা কী? রিভিউ পিটিশন খারিজ হয়ে গেলে সরকার পরীক্ষা ছাড়া যোগ্যদের পুনঃনিয়োগের ব্যবস্থা কীভাবে করবে? এইসব বিষয়ে আলোচনার জন্য বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান চাকরিহারা শিক্ষক শিক্ষিকারা।
চাকরির ভবিষ্যৎ কী?
প্রসঙ্গত, নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৬ সালের গোটা প্যানেল বাতিল করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের এক কলমের আঁচড়ে চাকরি হারান প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মী। হাজারও টানাপোড়েনের পর সিদ্ধান্ত হয় যে, আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শিক্ষকরা স্কুলে যেতে পারবেন। বেতনও পাবেন। তবে অশিক্ষক কর্মীরা আপাতত চাকরিহারা। আবারও নতুন করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে এসএসসিকে। তবে আর পরীক্ষা দিতে নারাজ ‘যোগ্য’ চাকরিহারারা। বিকাশ ভবনে টানা অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
বিকাশ ভবনের সামনে অবস্থানকারীদের দাবি, পরীক্ষা ছাড়াই তাঁদের পূর্বপদে বহাল করুক রাজ্য সরকার। এই নিয়ে ১৪ দিন ধরে অবস্থান বিক্ষোভ করছেন তাঁরা। অন্য দিকে, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সোমবার দাবি করেছেন, চাকরিহারা শিক্ষকদের একটি সংগঠন সরকারের আইনি পদক্ষেপকে সমর্থন করছে। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল আনটেন্টেড টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন’ নামে ওই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন আড়াই হাজার জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। তাঁরা চিঠিও দিয়েছেন তাঁকে।
নতুন করে আলোচনার কোনও অবকাশ নেই: ব্রাত্য বসু
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এসএসসি বা বিকাশ ভবন অবরোধ করাটা কোনো কাজের কথা নয়। আধিকারিকদের কাজ করতে দেওয়া হোক। ব্রাত্যর কথায়, ‘যাঁরা চিঠি দিয়ে জানাচ্ছেন আমরা মুখ্যমন্ত্রীর উপর ভরসা করতে চাই আমি তাঁদেরকেই বিশ্বাস করব।’ নতুন করে চাকরিহারা শিক্ষকদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করা হবে কিনা সে বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আলোচনা যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। নতুন করে আলোচনার কোনো অবকাশ নেই।’
এরপরেই অবস্থানরত শিক্ষকদের উদ্দেশে ব্রাত্য বলেন, ‘আমরা যে আইনি লড়াই লড়ছি সেটার জন্য অপেক্ষা করুন। আমরা যে আইনি পুনর্বিবেচনার জন্য সর্বাত্মক লড়াই করছি আপনাদের ‘পয়েন্ট’গুলো নিয়ে সেটার উপর ভরসা রাখুন। সরকার আপনাদের কাউকেই যোগ্য বা অযোগ্য বলেনি। সরকার তো ভাগাভাগি করতে পারে না। আমরা সার্বিকভাবেই রিভিউ পিটিশন দাখিল করছি। আপনারা অপেক্ষা করুন। সেইসঙ্গে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছেন তা যেন আমরা পালন করতে পারি তার জন্য আমাদের মতোই আপনারা দায়িত্ববান হোন।’ শিক্ষামন্ত্রী জানান, তাঁর অফিস থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল কেন তাঁরা বসে আছেন। কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। সেইসঙ্গে লিখিতভাবে অবস্থানরত শিক্ষকদের থেকে কোনও দাবি তাঁর কাছে আসেনি বলে তিনি জানান। এদিন শিক্ষামন্ত্রী বলেন, চাল ও কাঁকর তিনি আলাদা করে বাছতে যাবেন না। তাঁর কাছে সবাই সমান।
অবস্থানরত শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর আবেদন, ‘এই ধরনের কোনো হঠকারি জায়গা থেকে সরে এসে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করুন।’ ব্রাত্যর কথায়, ‘এটা মাথায় রাখতে হবে চাকরি আমরা দিয়েছিলাম। চাকরি খেতে চেয়েছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলি।’
তবে এই মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গে রয়েছেন। বুধবার তাঁর ফেরার কথা। ফলে এদিন চাকরিহারা শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করবেন কি না, তা নিয়ে এখনও রাজ্য সরকারের তরফে যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের ইমেলের জবাব দেওয়া হয়নি বলে জানা গিয়েছে।
দুর্নীতির জেরে ভুক্তভুগি শিক্ষার্থীরা
তবে সবকিছুই মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। দুর্নীতির জেরে আখেরে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা। ভুক্তভোগী হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর থেকেই রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন স্কুলে শুরু হয়েছে হাহাকার। শিক্ষক সংকটে প্রভাব পড়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ছাত্র ছাত্রীদের পঠন পাঠনের ওপরেও।
যদিও এরই মাঝে সম্প্রতি চাকরিহারা শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের স্কুলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাউকে এখনো বরখাস্ত করা হয়নি, তাও জানিয়েছেন তিনি। তবে মুখ্যমন্ত্রীর এই বার্তার পরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে চাকরি হারা শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের অন্দরে। অনেকেই চাইছেন স্কুলে যেতে, আবার এমনও অনেকে রয়েছেন যারা স্কুলে যেতে চাইছেন না। আবার কেউ সমবেতভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে। এমত পরিস্থিতিতে বারংবার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে রাজ্যের ছাত্র ছাত্রীরাই।
কীভাবে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি?
প্রসঙ্গত এবার যে প্যানেলটি বাতিল হল তার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল ২০১৬ সালে এবং নিয়োগ হয়গ২০১৯ সালে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের একসঙ্গে নিয়োগ এই প্যানেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল। তবে শুরু থেকেই এই নিয়োগ নিয়ে একাধিক অভিযোগ উঠতে থাকে। এলাকায় শাসক দলের ঘনিষ্ঠ দালালরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তার ঘনিষ্ঠ আধিকারিকদের চক্র, শাসক দলের ছোট বড় নেতা এবং এসএসসি আধিকারিকরা এই দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জলিত ছিলেন। পরীক্ষার তিন বছর পর নিয়োগ আসলে ছিল দুর্নীতি সুযোগকে প্রসারিত করার একটি কৌশল।
এরপর সিবিআই তদন্ত শুরু করলে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসতে থাকে। সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পাওয়া, ওএমআর শিটের কারচুপি, মেধা তালিকা পরিবর্তন এবং দুর্নীতিগ্রস্থদের চাকরি দেওয়ার জন্য মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পর নতুন পদ সৃষ্টি-সবই ছিল দুর্নীতির নমুনা। তদন্ত চলাকালীন ইডির অভিজানে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার এবং পরবর্তীতে এসএসসির একাধিক কর্মকর্তার গ্রেফতারি মামলাটিকে নতুন মাত্রা দেয়। এই পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে প্রথমবার পুরো প্যানেল বাতিল হয়। তবে এই প্যানেলের একটি অংশ দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও বহু যোগ্য প্রার্থী তাদের মেধার ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছিলেন। হাইকোর্টের পর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন সেই সমস্ত যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকারাও। তাই এবার নিজেদের হকের চাকরি ফিরে পেতে মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়ে আবেদন জানালেন যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের (জেএসএসএএম) শিক্ষক শিক্ষিকারা।
বিকাশ ভবনের সামনে ওই সংগঠনের সদস্যদের অবস্থান ১৪ দিনে পা দিয়েছে। তাদের তরফে জানানো হয়েছে, সোমবার মুখ্যমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রীকে ইমেল মারফত চিঠি পাঠিয়েছিলেন সদস্যেরা। সেই চিঠির জবাব না মেলায় মঙ্গলবার খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন তাঁরা। পরীক্ষা ছাড়া তাঁদের যাতে চাকরিতে বহাল করা হয়, সেই নিয়ে আলোচনা চাইছেন তাঁরা।