নিউজ ডেস্ক: গতকাল ছিল ২০ মে, ২০১১ সালের ২০ মে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন, যা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে বিবেচিত হয়। এই দিনে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে তিনি রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলায় ফুটেছিল ঘাসফুল। সেই ২০১১ সাল থেকে ২০২৫। টানা ১৪ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর মাঝে তিনি ২০১৬ এবং ২০২১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন। সাম্প্রতিক পোস্টগুলিতে দেখা যায়, ২০ মে ২০২৫-এ অনেকে এই ঐতিহাসিক দিনটিকে স্মরণ করেছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) “মা-মাটি-মানুষ” শ্লোগানের সাথে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে।
মমতার শাসনকালে বাংলায় উন্নয়ন
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে শাসন করছে। তাঁর শাসনকালে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে, যা তাঁর সমর্থকরা প্রায়ই হাইলাইট করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
সামাজিক প্রকল্প: কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, এবং স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পগুলি নারী ক্ষমতায়ন এবং স্বাস্থ্যসেবায় অবদান রেখেছে। কন্যাশ্রী প্রকল্প ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে।
অবকাঠামো: গ্রামীণ রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সরবরাহ, এবং শহুরে অবকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হয়েছে। কলকাতার সৌন্দর্যায়ন এবং মেট্রো রেল সম্প্রসারণ এর উদাহরণ।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: নতুন বিদ্যালয়, কলেজ, এবং হাসপাতাল স্থাপনের পাশাপাশি বিদ্যুতায়ন এবং পানীয় জলের প্রকল্পে জোর দেওয়া হয়েছে।
শিল্পায়ন: সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের বিতর্কের পরেও, সরকার আইটি, পর্যটন, এবং ক্ষুদ্র শিল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছে।
তৃণমূল সমর্থকদের দাবি, এই প্রকল্পগুলি বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে।
দুর্নীতির অভিযোগ
তবে, মমতার শাসনকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে, যা বিরোধী দল এবং কিছু জনগণের মধ্যে ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অভিযোগগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি: স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) নিয়োগ কেলেঙ্কারি একটি বড় ইস্যু। অভিযোগ রয়েছে যে অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য ঘুষ নেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এই দুর্নীতির দায় বিরোধীদের উপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন বলে কিছু সূত্রে উল্লেখ রয়েছে।
কেন্দ্রীয় তহবিলের অপব্যবহার: বিরোধী দল, বিশেষ করে বিজেপি, অভিযোগ করেছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তহবিল (যেমন, পিএম আবাস যোজনা) সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি এবং তৃণমূল নেতারা এই অর্থ লুট করেছেন।
ডিএ (মহার্ঘ ভাতা) বিতর্ক: ২০১১ সালে মমতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে কেন্দ্রীয় হারে সরকারি কর্মচারীদের ডিএ দেওয়া হবে। কিন্তু ২০২৫ পর্যন্ত এই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি, যা সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।
স্বাস্থ্য ও পৌরসভা ক্ষেত্রে দুর্নীতি: পৌরসভাগুলিতে ঠিকাদারি কাজে এবং স্বাস্থ্য খাতে সরঞ্জাম ক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ মহামারীর সময় পিপিই কিট এবং ওষুধ সংগ্রহে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল।
নির্বাচনী সহিংসতা ও রাজনৈতিক দুর্নীতি: তৃণমূলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী সহিংসতা এবং ভোট কারচুপির অভিযোগও উঠেছে, যা রাজনৈতিক স্তরে দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়।
বিরোধী দলের নেতারা, যেমন বিজেপির মঙ্গল পাণ্ডে, দাবি করেছেন যে “মা-মাটি-মানুষ” শ্লোগানের নামে জনগণের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে, এবং মমতার শাসনকালে দুর্নীতি ও লুটপাটই প্রাধান্য পেয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রভাব
শিক্ষা: নিয়োগ কেলেঙ্কারির কারণে যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উপর জনগণের ভরসা কমেছে।
অর্থনীতি: কেন্দ্রীয় তহবিলের অপব্যবহার এবং শিল্পে বিনিয়োগের অভাবের কারণে রাজ্যের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে সমালোচকরা মনে করেন।
স্বাস্থ্য: স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির কারণে গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: দুর্নীতির অভিযোগ এবং সহিংসতার কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে, যা উন্নয়নের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে।
উভয় পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি
তৃণমূলের দাবি: তৃণমূল দাবি করে যে মমতার নেতৃত্বে বাংলা উন্নয়নের নতুন দিগন্তে পৌঁছেছে। তারা বিরোধীদের অভিযোগকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে দেখে এবং বলে যে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের উন্নয়ন তহবিলে বাধা সৃষ্টি করছে।
বিরোধীদের দৃষ্টিভঙ্গি: বিজেপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল মনে করে যে মমতার সরকার দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে, এবং তাঁর প্রতিশ্রুতি কেবল রাজনৈতিক স্লোগানে সীমাবদ্ধ।
তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথগ্রহণের তারিখ (২০ মে ২০১১) বাংলার রাজনীতিতে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তাঁর শাসনকালে উন্নয়নের কিছু কাজ হলেও, দুর্নীতির অভিযোগ তাঁর সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং তহবিল ব্যবহারে স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। এই অভিযোগগুলি কতটা সত্য, তা নির্ভর করে বিচার ব্যবস্থার তদন্ত এবং জনগণের রায়ের উপর। তবে, এই বিষয়গুলি বাংলার রাজনীতিতে উত্তপ্ত আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে।