নিউজ ডেস্ক: অভিযোগটা উঠেছিল আগেই। মুর্শিদাবাদে আক্রান্ত হয়েছে হিন্দুরা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের বাড়িঘর। নির্মম ভাবে খুন করা হয়েছে ২ জনকে। এবার সেই অভিযোগের সত্যতা স্পষ্ট হল আদালতের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির রিপোর্টে। ওই অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রেখে এই হামলা চালিয়েছে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা।
কী আছে রিপোর্টে?
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি মুর্শিদাবাদ হিংসা নিয়ে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে লেখা আছে, স্থানীয় কাউন্সিলরের নির্দেশে এই হামলা চালানো হয়। এই হিংসার সময় স্থানীয় পুলিশ সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় ও অনুপস্থিত ছিল। তৃণমূল কংগ্রেস নেতা মেহবুব আলম এই হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলেও জানা যাচ্ছে।
কখন হামলা হয়?
১১ এপ্রিল, ২০২৫, দুপুর ২.৩০ মিনিট। শুক্রবার দুপুর গড়াতেই মূল হামলাটি ঘটে। স্থানীয় কাউন্সিলর হাজির হয় দুষ্কৃতীদের নিয়ে। সামসেরগঞ্জ, হিজলতলা, শিউলিতলা, দিগরির বাসিন্দারা হামলার সময় মুখ ঢেকে এসেছিল বলে প্রতিবেদন জানানো হয়েছে।
নিষ্ক্রিয় দর্শক পুলিশ
প্রত্যক্ষদর্শীরা তদন্তকারীদের জানিয়েছে, আমিরুল ইসলাম এসে দেখে যায় কোন কোন বাড়িতে আক্রমণ করা হয়নি। সেগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেয় আক্রমণকারীরা। বেতবোনার গ্রামবাসীরা তখন পুলিশকে ফোন করে। কিন্তু পুলিশ কোনও সাড়া দেয়নি। সেদিন তৃণমূল বিধায়কও হাজির ছিলেন বলে খবর। তিনি ভাঙচুর দেখে চলে যান।
কেন এই হামলা?
হামলার সূত্রপাত ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে। সংসদে এই বিলটি পাশ করানোর সময় বিরোধীদের সঙ্গে সরকারপক্ষের বাগবিতণ্ডা হয়। আর তার জন্য আক্রান্ত হতে হয় হিন্দুদের। পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ধুলিয়ান, সামসেরগঞ্জ সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় হিন্দুদের বাড়ি, দোকানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ২ জনকে কুপিয়ে খুন করা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কয়েকদিন ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় ওই এলাকায়।
রিপোর্টে আর কী বলা আছে?
হাইকোর্টের গড়ে দেওয়া ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির রিপোর্ট বলছে, ১২ এপ্রিল অর্থাৎ শনিবার হিন্দু পরিবারের এক ব্যক্তি ও তার ছেলেকে মুসলিম প্রতিবেশীরা হত্যা করে। বাড়ির দরজা ভেঙে প্রথমে হরগোবিন্দ দাস ও তার ছেলে চন্দন দাসকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। বাগানে নিয়ে গিয়ে পিঠে কুড়ুল দিয়ে মারা হয়। যতক্ষণ না তাঁরা মারা যাচ্ছেন, সেখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছিল এক আক্রমণকারী।
পুলিশের সামনেই দোকান ছাই, আক্রান্ত মন্দির
মুসলিম দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবে হিন্দুদের মুদির দোকান, হার্ডওয়ারের দোকান, বৈদ্যুতিক ও টেক্সটাইলের দোকান ধ্বংস হয়ে যায়। স্থানীয় পুলিশ স্টেশন ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে থাকলেও তারা কেউ এর প্রতিকারে আসেনি। ঘোষপাড়ায় ২৯টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লুট হয় একটি শপিং মল। বেতবোনা গ্রামে ১২৩টি বাড়ি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হিংসার সময় মন্দিরগুলিতেও হামলা চলে। হামলা চলাকালীন বারবার ফোন করা হয় স্থানীয় থানায়। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার, তারা নির্বাক দর্শক হয়ে থাকে। আতঙ্কের জেরে হিন্দু পরিবারের অনেকেই নদী পেরিয়ে মালদায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন। প্রাণে বাঁচতে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় তাঁরা ছুটতে থাকেন।
তদন্ত কমিটিতে কারা?
মুর্শিদাবাদ হিংসার তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করে কলকাতা হাইকোর্ট। ওই কমিটিতে ছিলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রেজিস্ট্রার (আইন) যোগিন্দর সিং; পশ্চিমবঙ্গ আইন পরিষেবা কর্তৃপক্ষের সদস্য সচিব সত্য অর্ণব ঘোষাল এবং পশ্চিমবঙ্গ বিচার বিভাগীয় পরিষেবার রেজিস্ট্রার সৌগত চক্রবর্তী। ওই কমিটিকে বলা হয়েছিল, হিংসার কারণ খতিয়ে দেখতে এবং বাস্তুচ্যুতদের ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিতকরণ এবং মূল্যায়ন করতে। হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে রিপোর্টটি পেশ করে কমিটি। রিপোর্ট জমা দেওয়ার আগে ওই কমিটি হিংসা বিধ্বস্ত গ্রামগুলি পরিদর্শন করে ও আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলে। তারা যে রিপোর্টটি জমা দিয়েছে তার কপি এনডিটিভির কাছে আছে বলেও জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এখন প্রশ্ন
সেদিনের হিংসার নেপথ্যে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা দেখা গেছে তৃণমূল নেতা মেহবুব আলমের। হাইকোর্টে যে রিপোর্ট জমা হয়েছে, সেখানেই তার উল্লেখ আছে বলে জানা যাচ্ছে। তাহলে, হিন্দুদের ওপর আক্রমণের দায়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে ওই নেতার বিরুদ্ধে? তৃণমূল কংগ্রেস কি দলীয় স্তরে ব্যবস্থা নেবে মেহবুব আলমের বিরুদ্ধে? যে বিধায়ক সেদিন ওখানে হাজির ছিলেন, তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে দল? হাইকোর্টের নির্দেশে মুর্শিদাবাদ হিংসার রিপোর্ট জমা পরার পর হাজারো প্রশ্ন উঁকি মারছে রাজনৈতিক মহলে ও সামাজিক স্তরে।