নিউজ ডেস্ক: শিক্ষা হল জাতির মেরুদণ্ড। তাই যেকোনও দেশকে উন্নত হতে হলে আগে শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা উচিত। সম্প্রতি মিজোরামকে ভারতের প্রথম সম্পূর্ণ সাক্ষর (শিক্ষিত) রাজ্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং লাইফ-লং লার্নিং ফর অল ইন সোসাইটি’ (উল্লাস বা ইউএলএলএএস)। সম্পূর্ণ ভাবে সাক্ষর অর্থাৎ, রাজ্যের প্রত্যেক নাগরিক লিখতে ও পড়তে পারেন। মিজোরাম বিশ্ববিদ্যালয়-এর অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানে গত ২০ মে উল্লাস-এর (Understanding Lifelong Learning for All in Society -ULLAS) পক্ষ থেকে এই ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা।
কী জানালেন মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা?
কেন্দ্রীয় শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা দফতরের প্রতিমন্ত্রী জয়ন্ত চৌধুরী এবং মিজোরামের শিক্ষামন্ত্রী ড. ভানলালথলানার উপস্থিতিতে মুখ্যসচিব খিল্লি রাম মীনার পৌরোহিত্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা এই অর্জনকে মিজোরামের জন্য একটি ‘রূপান্তরের মাইলফলক’ এবং গর্বের মুহূর্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এই অৰ্জন কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং আমাদের জনগণের শৃঙ্খলা, দৃঢ়সংকল্প এবং দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রমাণ। মিজোরামের জন্য এই প্রাপ্তি শেষ নয়, একটি নতুন সূচনা।’ বিশেষ করে ১,৬৯২ জন প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন মুখ্যমন্ত্ৰী লালদুহোমা, যাঁরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক বাধা অতিক্রম করে পরবর্তী জীবনে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
একইসঙ্গে লালদুহোমা আরও বলেন, ‘এই প্ৰাপ্তি সুযোগ, ক্ষমতায়ন এবং অন্তর্ভুক্তির যুগের সূচনা হোক।’ তিনি নাগরিকদের ডিজিটাল সাক্ষরতা, আর্থিক সাক্ষরতা এবং উদ্যোক্তাকে পরবর্তী সীমানা হিসেবে অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়ন্ত চৌধুরী মিজোরামের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে এই অর্জনকে কেবল রাজ্যের জন্য নয়, সমগ্র দেশের জন্য এক গর্বের দিন বলে অভিহিত করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে মিজোরামের অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করে আশাবাদ ব্যক্ত করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, রাজ্যটি আজীবন শিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়নে নেতৃত্ব প্রদান অব্যাহত রাখবে বলে আশাবাদী তিনি।
দেশের মধ্যে এই প্রথম
দেশের উত্তর-পূর্বে প্রান্তে অবস্থিত মিজোরাম। যে কোনও বিষয়ে অসম-মেঘালয় যাও বা আলোচনায় উঠে আসে, মিজোরাম থেকে যায় উপেক্ষিতই। কিন্তু সেই মিজোরামই এবার অনন্য নজির স্থাপন করল। প্রসঙ্গত, সর্বশেষ পর্যায়ক্রমিক শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩-২৪ (পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে, সংক্ষেপে পিএলএফএস ২০২৪-২০২৫) অনুসারে মিজোরাম ৯৮.২ শতাংশ সাক্ষরতার হার অর্জন করেছে, যা সম্পূর্ণ শিক্ষিত রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং লাইফ-লং লার্নিং ফর অল ইন সোসাইটি’-র ৯৫ শতাংশ সাক্ষরতার প্রয়োজনীয়তাকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে দেশের প্রথম সম্পূর্ণ ভাবে সাক্ষর রাজ্য হিসেবে উঠে এল মিজোরাম। রাজ্য সাক্ষরতা মিশন কর্তৃপক্ষের অধীনে স্কুল শিক্ষা বিভাগের নিরন্তর এবং সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ সমগ্র শিক্ষা এবং নতুন ভারত সাক্ষরতা কর্মসূচি (নব ভারত সাক্ষরতা কার্যক্রম) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই উদ্যোগটি এসসিইআরটি-র অধীনে স্টেট সেন্টার ফর লিটারেসি রাজ্যের সব জেলায় শিক্ষার্থীদের জন্য মিজো ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতেও শিক্ষা উপকরণ তৈরি করেছিল।
মিজোরামের এই সাফল্যে রাজ্য সরকারের ভূমিকা
মিজোরামের এই সাফল্য অর্জনে রাজ্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। State Centre for Literacy (SCERT) গড়ে তোলা হয় সেখানে। মিজো ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয় যেমন, ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়। এছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে প্রকল্পে যোগ দেন শিক্ষক-শিক্ষিকা, কলেজ পড়ুয়া, শিক্ষিত মানুষজন। অক্ষরজ্ঞান নেই রাজ্যের এমন ৩০২৬ জন নাগরিককে চিহ্নিত করা হয়, যাঁদের মধ্যে ১৬৯২ জন শিখতে-পড়তে আগ্রহ দেখান।
এত গেল মিজোরামের সাফল্যের কথা, এবার আসি সাক্ষরতার নিরিখে ভারতের কোন রাজ্য তালিকায় কোন স্থানে আছে সেই প্রসঙ্গে। প্রাচীনকাল থেকে ভারত শিক্ষা ও সংস্কৃতির আঁতুরঘর হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে ভিনদেশী শাসকদের শাসনকালে তাতে অবনতি ঘটেছে। তবে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের সাক্ষরতার হারে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, বিশ্ব সাক্ষরতা সূচকে ভারত ১০৫ তম স্থানে রয়েছে। ভারতে সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৬.৩২ শতাংশ। যদিও এখনও পুরুষ ও মহিলাদের সাক্ষরতার হারের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ব্যবধান রয়েছে।
সর্বাধিক শিক্ষার হার সমৃদ্ধ রাজ্যের তালিকায় কোন কোন রাজ্য?
(১) কেরালা- কেরালাকে ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত রাজ্যের তকমা দেওয়া হয়। ২০১১ সালের সেনসাস অনুসারে, কেরালার সাক্ষরতার হার ছিল ৯৪ শতাংশ। তবে সম্প্রতি এই হার বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৯৬.২ শতাংশ।
(২) লাক্ষাদ্বীপ- লাক্ষাদ্বীপ হল ভারতের একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, যেখানে সাক্ষরতার হার ৯১.৮৫ শতাংশ। দেশের এই দ্বীপের শিক্ষাব্যবস্থা ও আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতির ব্যবহার এই পরিসংখ্যানের নেপথ্যে রয়েছে।
(৩) গোয়া- গোয়া রাজ্যটি মূলত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য বিশ্ববিখ্যাত। তবে এই রাজ্যের উচ্চ সাক্ষরতার হার এটিকে একটি অন্য মাত্রা দেয়। বর্তমানে গোয়ার সাক্ষরতার হার ৮৮.৭০ শতাংশ।
(৪) ত্রিপুরা- উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আরেকটি রাজ্য ত্রিপুরার সাক্ষরতার হার ৮৭.২২ শতাংশ। রাজ্যের সরকার বিভিন্ন শিক্ষামূলক উদ্যোগের মাধ্যমে সাক্ষরতার উন্নতির জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা করেছে। “শিক্ষার অধিকার আইন” এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(৫) দমন ও দিউ- দমন ও দিউ, একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। এই অঞ্চলে সাক্ষরতার হার ৮৭.১০ শতাংশ। ল আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতির ব্যবহার এবং প্রাথমিক শিক্ষার উপর জোর দেওয়া এই অঞ্চলে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করে।
(৬) আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ- আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সাক্ষরতার হার হল ৮৬.৬৩ শতাংশ। এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা তার অনন্য ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট দ্বারা সজ্জিত। তাই এখানের মানুষ শিক্ষাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
(৭) দিল্লী- ভারতের রাজধানী শহর দিল্লির সাক্ষরতার হার ৮৬.২১ শতাংশ। আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি, ডিজিটাল ক্লাসরুম এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির প্রবর্তন দিল্লির শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করেছে।
(৮) চণ্ডীগড়- চণ্ডীগড় হল ভারতের একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং পাঞ্জাব ও হরিয়ানা উভয়েরই রাজধানী। এই অঞ্চলের সাক্ষরতার হার ৮৬.০৫ শতাংশ। আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি, ডিজিটাল ক্লাসরুম এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির প্রবর্তন চন্ডীগড়ের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করেছে।
(৯) হিমাচল প্রদেশ- হিমালয়ের মধ্যে অবস্থিত হিমাচল প্রদেশের সাক্ষরতার হার ৮২.৮০ শতাংশ। হিমাচল প্রদেশ সরকারের প্রবর্তিত বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ এই রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করে তুলেছে।
(১০)সাক্ষরতার নিরিখে কত নম্বরে পশ্চিমবঙ্গ?
পশ্চিমবঙ্গের সাক্ষরতার হার জাতীয় গড় (৭৪.০৪%) থেকে বেশি। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, ভারতের ৩৬টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে সাক্ষরতার হারের দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ২০তম স্থানে রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে সাক্ষরতার হার ৭৬.২৬ শতাংশ। এই হার পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে আলাদা, পুরুষের হার ৮১.৬৯ শতাংশ এবং মহিলাদের হার ৭০.৫৪ শতাংশ।
বিস্তারিত তথ্য-
পশ্চিমবঙ্গের সাক্ষরতার হার: ৭৬.২৬%
পুরুষদের সাক্ষরতার হার: ৮১.৬৯%
মহিলাদের সাক্ষরতার হার: ৭০.৫৪%
জাতীয় গড় সাক্ষরতার হার: ৭৪.০৪%
সাক্ষরতার নিরিখে কেন পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ?
পশ্চিমবঙ্গের সাক্ষরতার হার অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে থাকার কারণগুলি হল-
অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য: রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বিদ্যমান, যা শিক্ষার সুযোগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা: বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা শিক্ষা ব্যবস্থার গুণমানকে প্রভাবিত করেছে।
শিক্ষার মান: বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার মান বজায় রাখা এবং উন্নত করার জন্য পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বৈষম্য: নারী এবং পুরুষের মধ্যে সাক্ষরতার হার এবং বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে।
অবকাঠামো: পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং উন্নত অবকাঠামোর অভাব দেখা যায়।
অর্থের অভাব: শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না হওয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ব্যাহত হয়।
সচেতনতার অভাব: শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা কম, যা সাক্ষরতার হার বাড়াতে বাধা সৃষ্টি করে।
প্রাইভেট টিউশন: প্রাইভেট টিউশনের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা শিক্ষার গুণমানকে প্রভাবিত করে।
ভূমি অধিগ্রহণ নীতি: দুর্বল ভূমি অধিগ্রহণ নীতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি সংগ্রহ করতে বাধা দেয়।
এই কারণগুলির কারণে পশ্চিমবঙ্গ সাক্ষরতার ক্ষেত্রে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পিছিয়ে আছে।