নিউজ ডেস্ক: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরবঙ্গ সফরের রেশ কাটতে না কাটতেই এ বার আলিপুরদুয়ারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলো। আগামী বৃহস্পতিবার ২৯ মে রাজ্যে আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ওই দিন আলিপুরদুয়ার জেলায় জোড়া কর্মসূচিতে যোগ দেবেন তিনি। প্রশাসনিক সভায় যোগ দেওয়ার পাশাপাশি একটি জনসভাও করবেন আলিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ড ময়দানে। রাজ্য বিজেপি সূত্রে খবর, প্রশাসনিক সভা থেকে প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, বিভিন্ন রাজ্যের জন্য একাধিক প্রকল্পের সূচনা করবেন। তবে প্রশাসনিক সভাটি কোথায় হবে, তা স্পষ্ট নয়। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় দেখছে বলে বিজেপি সূত্রে খবর।
আলিপুরদুয়ারকেই কেন বেছে নিলেন প্রধানমন্ত্রী?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, চিকেনস নেকের গুরুত্ব, চিনের ভৌগোলিক অবস্থান, বাংলাদেশ সীমান্ত ও সর্বোপরি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্সের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেই আলিপুরদুয়ারকে বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
অন্যদিকে, অপারেশন সিঁদুরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল দেশের বায়ুসেনার। মোদী উত্তরবঙ্গের যে এলাকায় সভা করতে চলেছেন তার খুব কাছেই রয়েছে হাসিমারা বায়ুসেনার ছাউনি। স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর এই সভাস্থল নির্বাচন নিয়েও চর্চা বেড়েছে।
‘চিকেনস নেক’ আসলে কী?
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং মূল ভূখণ্ডের মধ্যে একমাত্র স্থলপথ সংযোগ হল শিলিগুড়ি করিডর, যা ভূগোলবিদ ও কৌশলবিদদের কাছে ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও তরাই অঞ্চল ধরে বিস্তৃত এই করিডরটি সবচেয়ে সরু অঞ্চলটি মাত্র ১৭ কিলোমিটার চওড়া। চারপাশে নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ ঘেরা এই ভূখণ্ড কেবল ভৌগোলিক নয়, ভারতের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব
শিলিগুড়ি করিডর ভারতের ‘লাইফলাইন’-এর মতো। কারণ এটি ভারতের মূল ভূখণ্ডকে আটটি উত্তর-পূর্ব রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত রাখে। এই করিডরের উপরই নির্ভর করে সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহ, জরুরি সামরিক যাতায়াত এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জনসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছনো। সীমান্তবর্তী অরুণাচল প্রদেশে চিন আগ্রাসন বা উত্তেজনার সময় এই করিডরের ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই করিডরের সরুতা এবং চারপাশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত একে অত্যন্ত সংবেদনশীল করে তুলেছে। কোনও দেশের সঙ্গে উত্তেজনা তৈরি হলে বা অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে এই করিডর সহজেই লক্ষ্যবস্তু হতে পারে, যার ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চল কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
এছাড়াও শিলিগুড়ি করিডর থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন সেনা ঘাঁটিতে রেল এবং সড়কপথে পৌঁছনো যায়। নিউ জলপাইগুড়ি (NJP) রেলস্টেশন থেকে গুয়াহাটি, তাওয়াং সহ নানা কৌশলগত এলাকায় সরাসরি সংযোগ রয়েছে। তাওয়াং চিন সীমান্তের খুব কাছে অবস্থিত, যেখানে ভারতীয় সেনার গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি আছে। এছাড়া এই করিডরের মাধ্যমে দ্রুত সৈন্য মোতায়েন, অস্ত্র সরবরাহ এবং উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। ২০১৭ সালের ডোকলাম সঙ্কট বা ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষের সময়ও শিলিগুড়ি করিডরের গুরুত্ব নতুন করে সামনে আসে।
নেপাল, ভুটান এমনকী বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য
শুধু ভৌগোলিক বা সামরিক নয়, শিলিগুড়ি করিডর পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, অসম, ত্রিপুরা সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবাহের মূল কেন্দ্র। এই করিডর দিয়েই প্রতিদিন কয়েক হাজার পণ্যবাহী গাড়ি দেশের অন্যান্য অংশ থেকে উত্তর-পূর্বে প্রবেশ করে। এখানকার শিলিগুড়ি শহর বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। নেপাল, ভুটান এমনকী বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যও এই অঞ্চল ঘিরেই পরিচালিত হয়।
শিলিগুড়ি করিডরের গুরুত্ব
পর্যটনের ক্ষেত্রেও শিলিগুড়ি করিডর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দার্জিলিং, কালিম্পং, সিকিম সহ পার্বত্য অঞ্চলে যাওয়ার একমাত্র প্রবেশদ্বার এটি। ফলে এই করিডরের নিরাপত্তা ও পরিবহন পরিকাঠামো দেশের পর্যটন শিল্পকেও প্রভাবিত করে।
তবে এই করিডরের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এর ভূগোলিক সরুতা একে অতি সংবেদনশীল করে তুলেছে। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ—ভূমিকম্প, ভূমিধস, বন্যা—এই করিডরের যানচলাচল বন্ধ করে দিতে পারে। একইভাবে, বিদেশি আগ্রাসন বা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহও এখানে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিকল্প পথ গড়ে তোলা, রেল ও সড়কপথ উন্নয়ন এবং সীমান্ত সুরক্ষা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। ভারত সরকার ইতিমধ্যেই আন্তঃরাজ্য সংযোগ মজবুত করতে নতুন হাইওয়ে ও সেতু নির্মাণে জোর দিচ্ছে।
শিলিগুড়ি করিডর কেবল একটি ভূখণ্ড নয়, এটি ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশের জন্য একটি কৌশলগত ‘লাইফলাইন’। এর গুরুত্ব শুধু সীমান্ত সুরক্ষায় নয়, বাণিজ্য, পর্যটন এবং আন্তঃদেশীয় সম্পর্কেও বিরাট। তাই এই করিডরের উন্নয়ন, সুরক্ষা এবং বিকল্প রুট নির্মাণে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করাই হবে ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়াস।
প্রধানমন্ত্রীর জনসভার প্রস্তুতিতে কোনও খামতি রাখতে চাইছে না বিজেপি
তবে প্রধানমন্ত্রীর জনসভার প্রস্তুতিতে কোনও খামতি রাখতে চাইছে না বিজেপি। প্রধানমন্ত্রীর জেলা সফরের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করতে মঙ্গলবার বৈঠক করেন আলিপুরদুয়ারের বিজেপি নেতৃত্ব। সেখান থেকে তাঁরা প্যারেড মাঠ পরিদর্শনে যান। দলে ছিলেন জেলা বিজেপি সভাপতি মিঠু দাস, আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ মনোজ টিগ্গা–সহ আরও অনেকে।
মোদীর আলিপুরদুয়ারে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে বিজেপি নেতা দীপক বলেন, “অপারেশন সিঁদুর-পরবর্তী পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই এখানে একটি প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাজনৈতিক সভাটির প্রস্তুতির দায়িত্বে আমরা রয়েছি। সেই প্রস্তুতি আমরা আজ থেকেই শুরু করে দিলাম।”
নির্বাচনের আগে মোদীর বঙ্গ-সফর যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ
রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হতে এখনও বেশ খানিকটা দেরি। তার আগে প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের কারণ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। বিশেষত ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং ভারত-পাক সামরিক সংঘাতের পর প্রধানমন্ত্রীর এই বঙ্গ-সফর তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে এই সফর আরও গুরুত্ব পেয়েছে। ভারতের আমদানি সীমাবদ্ধ করার সিদ্ধান্তের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান মোহাম্মদ ইউনূসের ” সেভেন সিস্টার্স ” সম্পর্কে একটি মন্তব্য ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নাজুক প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। স্থানীয় বিজেপি নেতাদের মতে, এই সংবেদনশীল অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রীর সফরের যথেষ্ট ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকবে।
আগামী বছর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সাধারণ নির্বাচন এবং উত্তরবঙ্গে বিজেপির শক্তিশালী অবস্থান বজায় রাখার কারণে, প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই সফর দলের আঞ্চলিক কর্মীদের আরও উজ্জীবিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার এবং বালুরঘাট সহ উত্তরবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলি বিজেপি জিতেছিল। তবে, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জন বার্লার তৃণমূল কংগ্রেসে (টিএমসি) যোগদানকে একটি ধাক্কা হিসেবে দেখা হয়েছিল। যদিও দলের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা বিশ্বাস করেন যে প্রধানমন্ত্রীর একটি সফর এবং সমাবেশ বাংলায় বিজেপির মনোবলকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলবে এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে তার উপস্থিতি আরও জোরদার করবে।
নজর ছাব্বিশের ভোটে
২০১৬ সালে ভোট প্রচারে শেষবার আলিপুরদুয়ারে এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। এদিকে প্রধানমন্ত্রী আসার খবর পৌঁছতেই বিজেপি নেতাদের মধ্যে জোর তৎপরতা দেখা গিয়েছে। আসলে ছাব্বিশের ভোটের আগে উত্তরবঙ্গে নিজেদের শক্তি দেখে নিতে চাইছে বিজেপি। আর এতেই বিজেপির হাতিয়ার হতে চলেছে অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য।